আন্তর্জাতিক ব্যবসা থেকে শত শত কোটি ডলার মুনাফা করছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী

আন্তর্জাতিক

টিবিএস ডেস্ক
10 September, 2020, 07:50 pm
Last modified: 11 September, 2020, 03:47 am
এমইএইচএল নামের একটি কোম্পানির গোপন নথি ফাঁস করেছে মানবাধিকার গোষ্ঠী অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল। কোম্পানিটি ১৮শ’ কোটি ডলার লভ্যাংশ স্থানান্তর করেছে সামরিক বাহিনীর কাছে। 

মিয়ানমারের একটি গোপন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক ব্যবসা সংযোগকে কাজে লাগিয়ে বিপুল মুনাফা করছে। যার একটি বড় অংশ প্রতিষ্ঠানটি আবার তুলে দিচ্ছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হাতে। বিশেষ করে, সামরিক বাহিনীর যেসব শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যা পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে- তারা সরাসরি পাচ্ছে এই লভ্যাংশ।

আজ বৃহস্পতিবার (১০ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠী- অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এ অভিযোগ আনে। অ্যামনেস্টি বলছে, ইয়াঙ্গুনভিত্তিক কোম্পানি মিয়ানমার ইকোনমিক হোল্ডিং লিমিটেড (এমইএইচএল) থেকে শীর্ষ সামরিক নেতৃত্ব বিগত কয়েক বছরে ১৮শ' কোটি ডলার পেয়েছে। এমনকি কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ সম্পূর্ণরূপে উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণে। 

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর উপর ইইউ, যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও বেশ কিছু দেশের নিষেধাজ্ঞা থাকার প্রেক্ষিতে কোম্পানিটির আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাধাগ্রস্ত হতে পারতো। কিন্তু, বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, তা কোনোটাই হয়নি, বরং উত্তরোত্তর বেড়েছে এর মুনাফার পরিমাণ। 

অ্যামনেস্টির ব্যবসা, নিরাপত্তা এবং মানবাধিকার শাখার প্রধান মার্ক ডুম্মেট বলেন, 'সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের আয়োজকরা এমইএইচএল- এর বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সরাসরি লাভবান হয়েছেন।' 

বৃহস্পতিবার প্রকাশিত প্রতিবেদনটি কোম্পানিটির ফাঁস হয়ে যাওয়া নথিপত্রের ভিত্তিতে প্রকাশ করে মানবাধিকার সংস্থাটি। 

''মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী যে এমইএইচএল- এর বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য থেকে মুনাফা লুটছে- ফাঁস হয়ে যাওয়া নথিপত্র সেই বিষয়ে নতুন প্রমাণ তুলে ধরেছে। এটা আরও প্রমাণ করে, সামরিক জান্তা এবং কোম্পানিটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।'' 

এমইএইচএলের শেয়ারহোল্ডার রেকর্ডে দেখা যায়,  কোম্পানিটি পুরোপুরিভাবে সামরিক বাহিনীর বর্তমান ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মালিকানায় পরিচালিত। 

সামরিক বাহিনীর কিছু ইউনিট- যেমন রাখাইন রাজ্যে মোতায়েন করা কিছু লড়াকু ডিভিশন কোম্পানিটির এক-তৃতীয়াংশ শেয়ারের মালিক।  

সবচেয়ে বেশি মুনাফা পাওয়া সামরিক অফিসার হলেন- মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লিয়াং। ২০১০ থেকে ২০১১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি কোম্পানির ৫ হাজার শেয়ারের মালিক ছিলেন। ওই এক বছরেই তাকে লভ্যাংশ বাবদ কমপক্ষে আড়াই লাখ মার্কিন ডলার দেয় এমইএইচএল। অ্যামনেস্টির হাতে আসা নথিপত্র সেদিকে স্পষ্ট ইঙ্গিত করছে। 

অথচ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত গণহত্যায় মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে এই জেনারেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে খোদ জাতিসংঘ তাকে তদন্ত এবং বিচারের সম্মুখীন করার আহ্বান জানায়।

গত মঙ্গলবারেই স্বপক্ষত্যাগী মিয়ানমারের দুই সেনা স্বীকারোক্তি দেন যে, শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের নির্দেশ মেনেই তারা রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উপর বর্বর গণহত্যায় অংশ নিয়েছে। তারা জানান, রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে হত্যা, ধর্ষণ আর ধবংসযজ্ঞ চালাতে তাদের উপর সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছিল। 

ওই তাণ্ডবের কারণেই ২০১৭ সালে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। 

এদিকে অ্যামনেস্টির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি জেনারেল অং হ্লিয়াং বা সামরিক বাহিনী। তবে ইতোপূর্বে তারা রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর অন্যান্য সব প্রতিবেদন নাকচ করে দিয়েছিল। 

ক্রমবর্ধমান ব্যবসায়িক স্বার্থ: 

অ্যামনেস্টির রিপোর্ট নিয়ে এমইএইচএল কোম্পানিও এপর্যন্ত কোনো বিবৃতি দেয়নি। মানবাধিকার গোষ্ঠীটি, মিয়ানমার সরকারের প্রতি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সম্পর্কচ্ছেদ করার আহ্বান জানিয়েছে।  

ব্যাংকিং, খনি পরিচালনা এবং নানা পণ্য উৎপাদন ব্যবসায়ে বিস্তৃত্ব এমইএইচএল- এর ব্যবসা। চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং সিঙ্গাপুর ভিত্তিক বেশকিছু আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসা সহযোগী হিসেবেও কাজ করে।

এমইএইচএল- এর ফাঁস হওয়া নথিপত্রে সহযোগী হিসেবে উল্লেখ আছে জাপানি পানীয় প্রস্তুতকারক কিরিন হোল্ডিংসের নাম। আরও আছে দক্ষিণ কোরিয়ার আবাসন সম্পত্তি ডেভেলপার ইন্নো গ্রুপ, তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্যান-প্যাসিফিক এবং ইস্পাত উৎপাদক পোস্কো। 

গত মঙ্গলবার শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশে রাখাইন রাজ্যে গণহত্যা পরিচালনার কথা স্বীকার করে জবানবন্দী দেয় স্বপক্ষত্যাগী দুই সেনা সদস্য। ছবি: আল জাজিরা

ব্যবসায়ে আরও সহযোগী আরএমএইচ সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুরভিত্তিক এ তহবিলটির মিয়ানমারে তামাক উৎপাদনের ব্যবসা আছে। এছাড়া, চীনের ধাতব খনিজ উত্তোলক ওয়ানবাও মাইনিং- মিয়ানমারে তাদের কার্য্যক্রম পরিচালনা করে এমইএইচএলের সহায়তায়। 

এছাড়া, মিয়ানমারের স্থানীয় ব্যবসায়িক সহযোগীদের মধ্যে রয়েছে দুটি কোম্পানি; এভার ফলো রিভার গ্রপ পাবলিক কো. লিমিটেড এবং কানবাওয়াজা গ্রুপ (কেবিজেড) । প্রথমটি একটি লজিস্টিকস কোম্পানি আর কেবিজেড জড়িত চুনি ও পান্না খনির ব্যবসায়ে।  

মিয়ানমারে ন্যায়বিচার এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতের জন্য কাজ করা অধিকার গোষ্ঠী- জাস্টিস ফর মিয়ানমার- এর মাধ্যমে শেয়ারহোল্ডার নথি অ্যামনেস্টির হাতে আসে।   

এর মাধ্যমে ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত এমইএইচএল- এর অংশীদাররা প্রতিবছর যে বিপুল পরিমাণ লভ্যাংশ পাচ্ছে- তা উঠে আসে। 

এছাড়া, অন্য বেশ কিছু দলিলও ছিল । যার মধ্যে রয়েছে মিয়ানমারের বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কর্তৃপক্ষকে (ডিকা) দেওয়া এমইএইচএল-এর একটি দলিল। ডিকা মিয়ানমারে কোম্পানি নিবন্ধনের অনুমতি দিয়ে থাকে।  

ডিকায় জমা দেওয়া দলিলে কোম্পানিটি জানায়, এর মালিকানা তিন লাখ ৮১ হাজার ৬৩৬টি স্বতন্ত্র শেয়ারহোল্ডারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত। অংশীদারদের প্রত্যেকে বর্তমান বা প্রাক্তন সেনা সদস্য। এছাড়া, প্রাতিষ্ঠানিক শেয়ারহোল্ডার ১,৮০৩টি। এদের মধ্যে সেনাবাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ড কাঠামো যেমন; ডিভিশন ও ব্যাটালিয়ন পর্যায় অন্তর্ভুক্ত আছে। আরও আছে সেনা সদস্য এবং সাবেক সৈনিকদের কল্যাণে গঠিত কিছু সংস্থা। 

গোপনীয়তার চাদরে মোড়া:
গত ২০ বছরে মোট ১০ হাজার ৭শ' কোটি কিয়াত (স্থানীয় মুদ্রা) লভ্যাংশ দেওয়া হয়েছে অংশীদারদের। ওই সময়ের আন্তর্জাতিক বাজারের মুদ্রা বিনিময় দর হিসাব করে –এই অংক ১৮শ' কোটি ডলার বলে জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। 

এমইএইচএল- সাড়ে ৯ হাজার কোটি কিয়াত বা ১৬শ' কোটি ডলার সরাসরি বিভিন্ন সামরিক ইউনিটকে দিয়েছে, এরমধ্যে রাখাইন রাজ্যে গণহত্যায় অংশ নেওয়া সেনা ইউনিটও ছিল। রোহিঙ্গা গণহত্যার পর বর্তমানে এসব সেনারা বিদ্রোহী আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়ছে। 

রাখাইনের এসব সামরিক ইউনিট এমইএইচএল-এর ৪৩ লাখের বেশি শেয়ারের অধিকারী। ২০১০ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে এ ইউনিটগুলো মোট ১২৫ কোটি কিয়াত বা ২০ কোটি ডলার লভ্যাংশ পায়। এটা ছিল শুধুমাত্র এক বছরের আয়, এভাবে প্রত্যেক বছরই মুনাফা পাচ্ছে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধে জড়িত সেনাবাহিনী।

''জাতীয়ভাবে পাওয়া বিপুল বাজেটের পাশাপাশি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের আয়; মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা দিচ্ছে। কিন্তু, এই সম্পর্ক গোপনীয়তার চাদরে মোড়ানো'' অ্যামনেস্টি জানিয়েছে। 

২০১৭ সালের গণহত্যার প্রেক্ষিতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়। ছবি: আল জাজিরা

সংস্থাটি এমইএইচএল- এর মুনাফা দিয়ে মিয়ানমার সরকারকে একটি তহবিল গঠনের আহ্বান জানায়। ওই তহবিল থেকে সামরিক বাহিনীর হাতে নির্যাতন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার ব্যক্তি ও সম্প্রদায়কে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পরামর্শও দেয় অ্যামনেস্টি। 

গোপন নথিতে নিজ সম্পৃক্ততা ফাঁসের প্রেক্ষিতে দক্ষিণ কোরিয়ার প্যান-প্যাসিফিক গ্রুপ বলছে, তারা এমইএইচএল-এর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কচ্ছেদের প্রস্তুতি নেওয়া আগেই শুরু করেছিল।  

জাপানি কোম্পানি কিরিন এবং মিয়ানমারের কেবিজেড- অ্যামনেস্টিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, তারা এমইএইচএলের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রাখার বিষয়টি পুনঃবিবেচনা করবে। 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.