আজীবন ক্ষমতায় থাকার নীতিমালা কার্যকর করতে চলেছেন শি জিনপিং 

আন্তর্জাতিক

জেনি মার্শ, ব্লুমবার্গ ওপিনিয়ন
08 November, 2021, 07:25 pm
Last modified: 09 November, 2021, 03:42 am
৪০ বছরের ইতিহাস নিয়ে চীনা সমাজতন্ত্রী দলের প্রকাশিত আনুষ্ঠানিক ঘোষণা চলতি বছরে দেশটির সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ঘটনা হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে

চীনের সমাজতন্ত্রী দলের দুজন নেতা দৃঢ়তা বা সংকল্পের ইতিহাস রচনা করেছেন। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তৃতীয় ব্যক্তিটি হবেন কিনা সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা। 

আগামী বছর চীনা কম্যুনিস্ট পার্টি কংগ্রেসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশন । দুই দশকে মাত্র একবার অনুষ্ঠিত হওয়া এই সম্মেলনে নেওয়া হয় দেশটির ভাগ্য ও নীতিনির্ধারণী সব সিদ্ধান্ত। এ অধিবেশনে গত ৪০ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তৃতীয়বার ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেন শি জিনপিং, যা তার আজীবন শাসনের পথ নিশ্চিত করবে।   

এর আগে মাও সেতুং ও ডেং জিয়াওপিং এর মতো বিখ্যাত দুই নেতা চীনের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বাঁক পরিবর্তনের মুহূর্তে দেশটির অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠেছিলেন। আজীবন ক্ষমতায় থাকার সুযোগ কাজে লাগিয়ে তারা শেষনিঃশ্বাস ফেলার আগপর্যন্ত নিজ দল ও দেশের ভবিষ্যৎ রচনায় প্রধান ভূমিকা রেখেছেন। তাই সর্বময় ক্ষমতা চিরকাল ধরে রাখলে, শি জিনপিং দলের মহান এ দুই নেতার কাতারে যেমন উঠে আসবেন, ঠিক তেমনি তা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতিতে আসন্ন বড় পরিবর্তনেরও সংকেত দিচ্ছে।

কিন্তু, তার আগে আজ  ৮ নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে আগামী ১২ তারিখ পর্যন্ত চলবে 'সিক্সথ প্লেনাম' শীর্ষক সম্মেলন। চীনের জন্য যা গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনী প্রচারণার মতোই টানটান উত্তেজনাকর এক মুহূর্ত। তাই এ বৈঠকে নিজ ক্ষমতা চিরস্থায়ীকরণ এবং ভবিষ্যৎ নির্ধারণের চেষ্টায় শি জিনপিং দলীয় সমর্থন চান। গত এক দশক ধরে দলের ভেতরে প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমন ও জাতীয় মর্যাদা বৃদ্ধিতে তৎপর শি জিনপিং, এ সমর্থন পেলে সত্যিকার অর্থেই চীনের ইতিহাসে সর্বোচ্চ নেতাদের সাড়িতে নাম লেখাবেন।  

সিক্সথ প্লেনাম কী? 

দুটি দলীয় কংগ্রেসের মাঝখানের সময়টাতে সমাজতন্ত্রী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা সাতবার 'প্লেনাম' নামক বৈঠকে যোগ দেন।  এখানে জাতীয় অর্জন, দলের নীতিনির্ধারণ, অর্থনীতিসহ অনেক বিষয় আলোচনায় প্রাধান্য পায়। রাজ্য পর্যায়ের নেতৃত্ব, সামরিক বাহিনীগুলোর প্রধান ও আঞ্চলিক শাসকসহ প্রায় ৪০০ জনের বেশি নেতা রাজধানী বেইজিংয়ে সামরিক বাহিনী পরিচালিত ও সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বেষ্টনী ঘেরা এক হোটেলে করেন এ বৈঠক। 

তবে চীনের শীর্ষ পর্যায়ের রাজনীতি সব সময়েই রহস্যের চাদরে মোড়া। তাই এ বৈঠকের প্রধান এজেন্ডাও থাকে 'টপ সিক্রেট'। বৈঠকের পর সমাজতন্ত্রী দলের বিবৃতিতে যা জানানো হয়, তার বাইরে জনসাধারণের জানার সুযোগ খুবই কম। যেমন- বিবৃতি উহ্য রাখে অভ্যন্তরীণ কোন্দল বা বিতর্কের ঘটনা।  

চীনের পাঁচ বছর মেয়াদি রাজনৈতিক চক্রের সর্বশেষ বৃহৎ বৈঠক হওয়ায় 'সিক্সথ প্লেনাম' অন্য সম্মেলনগুলোর থেকে অনেক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ।  আগামী বছরের পার্টি কংগ্রেসের আগে এটিই শীর্ষ আইনপ্রণেতাদের গোপনীয় দর কষাকষির শেষ সুযোগ।  যার প্রস্তুতি হিসেবে চলতি বছর পলিটব্যুরো কমিটি 'শত বছরে সমাজতন্ত্রী দলের শীর্ষ অর্জন ও ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা' শীর্ষক একটি খসরা প্রস্তাবনা তৈরি করেছে বলে বার্তাসংস্থা শিনহুয়া জানায়। 

খসরা প্রস্তাবের এই শিরোনামই পর্যবেক্ষকদের ভ্রু কুঁচকে দিয়েছে। চীনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা জানেন, ১৯৮১ সালে পূর্বসূরী মাও সেতুং এর অনেক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে ডেং জিয়াওপিং তার ঐতিহাসিক প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন। সেখানে তিনি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কারণে দুর্ভিক্ষ ও অজস্র মানুষের মৃত্যুর জন্য মাওকেই দায়ী করেন। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত একই পর্যায়ের এক সম্মেলনে সমাজতন্ত্রী দল শি জিনপিংকে 'প্রধান' নেতা হিসেবে উল্লেখ করেছে। ইতোপূর্বে, ডেং, মাও ও জিয়াং জেমিনকে এমন বিশেষণে দেওয়া হয়েছিল, যারা প্রত্যেকেই দলের প্রতিটি সিদ্ধান্তে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। 

ঐতিহাসিক প্রস্তাবনাগুলো কী? 

সরল কথায় এগুলোকে দলীয় ভাষা ও দৃষ্টিকোণের বিবরণ বলা যায়। তবে বাস্তবে এগুলোই ক্ষমতা বদলের খেলায় মূল নিয়ামক। 

যেমন-১৯৪৫ সালে  দেশের চীনা কম্যুনিস্ট পার্টি দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার চার বছর আগে নিজের ঐতিহাসিক প্রস্তাবনা পেশ করেছিলেন মাও সেতুং। 'কিছু প্রশ্নের উত্তর ও আমাদের দলের ইতিহাস' শীর্ষক ওই নথিতে পরিষ্কার লক্ষ্যের ঘোষণা দেন তিনি। মাও সেখানে দলকে নেতৃত্বদানে তার অবস্থানকেই 'সঠিক রাজনৈতিক পথ' বলে উল্লেখ করেন। ফলে কয়েক দশক ধরে ব্যক্তি-নির্ভর রাজনীতির পথ সুগম হয়।  

১৯৮১ সালে ডেং যখন তার প্রস্তাবনার ভাষণ দেন, তখন মাও এর মৃত্যুর পর দলের ভেতরে নেতৃত্ব নিয়ে আরেকটি দ্বন্দ্ব চলছিল। তখন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সর্বব্যাপী ক্ষতির কথা উল্লেখ করে প্রয়াত চেয়ারম্যানের দূরদর্শীতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ডেং। এভাবে চীনকে নেতৃত্বদানে নিজের লক্ষ্যকেই সঠিক পথ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।

এরপর ডেং প্রেসিডেন্ট না হয়েও চীনের অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করার পাশাপাশি ব্যক্তি-পূজারী মতাদর্শে বিশ্বাসী নেতাদের কোণঠাসা করেছিলেন।  এজন্যই এসব প্রস্তাবনাকে অসীম গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন কানাডার ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উ গুগুয়াং। তিনি একে 'নথির রাজনীতি' বলে উল্লেখ করেন- যে নথি ক্ষমতাসীন অভিজাতদের সিদ্ধান্তকে লিখিত রুপ দেয়।  

'দলের অভিজাতবর্গের মধ্যে প্রস্তাবনা নথি তৈরির প্রক্রিয়া নিয়ে সমর্থন ও বিরোধিতার গোপন রাজনীতি চলে। প্রস্তাবনার পেছনে চাই সিংহভাগ নেতাদের সমর্থন। তাই এ ধরনের প্রস্তাবনা প্রকাশিত হওয়ার ঘটনা শি জিংপিংয়ের পেছনে ঐক্যমত্যের সমর্থন তুলে ধরেছে।'


 

  • সূত্র: ব্লুমবার্গ 
     

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.