ব্যয়ের ধাক্কা সামাল দিতে আয় বাড়ানোর পথ খুঁজছে সাধারণ মানুষ

অর্থনীতি

30 May, 2022, 02:20 pm
Last modified: 30 May, 2022, 02:32 pm
সম্প্রতি খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি বেড়েছে নিত্য ব্যবহারের তেল-সাবান-টুথপেষ্ট-ডিটারজেন্ট পাউডারসহ সব পণ্যের দাম। বর্তমান আয় দিয়ে এই ব্যয়ের চাপ সামাল দিতে পারছেন না অনেকেই। কিছু মানুষ চেষ্টা করছেন একাধিক কাজ করে আয় বাড়ানোর।  

বিশ হাজার টাকা বেতনে বেসরকারি হাসপাতালের কর্মচারী আনোয়ার হোসেনের সংসারে টানাপোড়েন আগে থেকেই ছিল। এর উপর নিত্যদিনের খাওয়া ও ব্যবহারের সব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার চাপ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা তিনি আর সামাল দিতে পারছিলেন না। উপায় না দেখে নিজের জমানো কিছু টাকা ও আত্নীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার-দেনা করে মাসখানেক হলো মগবাজারে ছোট্ট একটি মুদি দোকান দিয়েছেন।

সকাল বেলায় দোকান খুলেন আনোয়ার হোসেন। তিনি অফিস গেলে স্ত্রী বেচা-বিক্রি সামলান। অফিস থেকে ফিরে আনোয়ার হোসেন আবার নিজেই দোকান সামলান। নতুন দোকান থেকে প্রতিদিন গড়ে ৫শ টাকার মত আয় হচ্ছে।   

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে নিত্যপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা চলছে। এর প্রভাবে দেশে সব খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি বেড়েছে নিত্য ব্যবহারের তেল-সাবান-টুথপেষ্ট-ডিটারজেন্ট পাউডারসহ সব পণ্যের দাম। 

এই চাপ সামাল দিতে সীমিত আয়ের অনেকেই মাছ মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। কারণ তাদের আয় দিয়ে এই ব্যয়ের চাপ সামাল দিতে পারছেন না। কিছু মানুষ চেষ্টা করছেন একাধিক কাজ করে আয় বাড়ানোর।  

আনোয়ার হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, তার বাসা ভাড়া বাবদ দিতে হয় ১২ হাজার টাকা। তিন জনের পরিবারের খাওয়ার খরচ ৭-৮ হাজার থেকে বেড়ে ১০ হাজা টাকা ছাড়িয়েছে। কলেজ পড়ুয়া ছেলের পড়াশোনার পেছনে ৩-৪ হাজার টাকা খরচ। নিজের প্রতিদিনের যাতায়াত খরচ সামাল দিতে বিকল্প আয়ের সংস্থান না করলে চলছিল না। 

আনোয়ার হোসেন বলেন, "চাকরি করে ৭০ হাজার টাকার মত জমিয়েছিলাম। কিন্তু গত দুই মাসেই জমানো টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা বাড়তি খরচ হয়ে গেছে। ভাবলাম এভাবে চললে জমানো টাকাগুলোও সব শেষ হয়ে যাবে। পরে নিজের ৫০ হাজার টাকা ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে নেওয়া দুই লাখ টাকা দিয়ে দোকানটি করেছি। চাকরির পাশাপাশি দোকান চালানো কষ্টকর হলেও কোনো উপায় নেই।"

থাই এ্যালুমিনিয়াম বিক্রি করে এমন একটি দোকানের ম্যানেজার ইয়াসির হোসেন। চাকরি করার পাশাপাশি তিনি নিজেই ছোট্ট একটি হার্ডওয়্যারের দোকান দিয়েছেন। যেটা তার ভাই দেখাশোনা করছেন, তিনি বসছেন চাকরি নির্দিষ্ট সময়ের পরে। প্রাথমিক অবস্থায় কন্ট্রাকে বিভিন্ন বাসাবাড়িতে জানালা, দরজা লাগানোর কাজ নিচ্ছেন এবং ভাইকে দিয়ে করাচ্ছেন।  

ইয়াসির হোসেন বলেন, "এখনও হার্ডওয়ার দোকান থেকে খুব বেশি আয় হয় না। দোকান ভাড়া ও কর্মচারির বেতন দিয়েই শেষ হয়ে যায়। তবে আশা করছি সামেনে কিছু আয় হবে। অল্প হলেও আয়ের একটি উৎস থাকায় কিছুটা চিন্তামুক্ত লাগছে।"

"যেভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে তাতে বাড়তি কোনো ইনকাম না করলে সংসার চালানো কষ্টকর। ৫ সদস্যের পরিবার টানতে গিয়ে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে," বলেন তিনি।

একই অবস্থায় মধ্যে ব্যয় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেন। শ্যামলীর এই বাসিন্দা চাকরির ২০ হাজার টাকা দিয়ে ঘরভাড়া, সন্তানের স্কুলের খরচ, খাওয়ার খরচ টানতে পারছিলেন না। শেষে ধারদেনা করে একটি বাইক কিনে চাকরির সময় শেষে রাইড শেয়ারিং করছেন।  

তিনি বলেন, "আমার আয় বিশ হাজার, কিন্তু এখন প্রতিমাসে ব্যয় ২৫ ছুঁয়েছে। তাও আবার খাবার তালিকা থেকে অনেক কিছু কমিয়ে দিয়েছি, গরুর মাংস, চা একেবারেই বাদ দিয়েছি। শেষে উপায় না দেখে চাকরির পরের সময়টাতে রাইড শেয়ারিং করছি। প্রতিদিনই বাড়ি ফিরতে হয় ১১ টার পর। কিন্তু কিছু আয় তো বাড়ছে।" 

এছাড়া, অনেক বাবা-মা ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ টানতে ব্যর্থ হওয়ায় ছাত্র অবস্থায়ই অনেককে আয়ের পেছনে ছুটতে হচ্ছে। এরকম ঢাকা কলেজের বিবিএর শেষ বর্ষের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় টিবিএসের। 

আলমগীর কবির নামের এই শিক্ষার্থীর গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা। থাকেন ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বরে। পরিবার এতদিন টাকা দিলেও মাসদুয়েক হলো টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ঢাকায় থাকা খাওয়া পড়ার খরচ জোগাতে বাধ্য হয়েই রাইড শেয়ারিং করে টাকা উপার্জন করতে হচ্ছে। 

সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে মেসে খাবারের অবস্থা এখন খুবই নিম্নমানের বলে জানান তিনি। 

আলমগীর বলেন, "মেসে প্রতি বেলা খাবার খরচ আগে হতো ৪৫ টাকা, এখন হয় ৫৫ টাকা। তাও বেশিভাগ সময়ই ডাল, ডিম ও সবজি রান্না হয়। সপ্তাতে দুই দিন মাছে ও একদিন ব্রয়লার মুরগি রান্না হয়। মাছ ও মুরগির পিসও এখন ছোট হয়ে গেছে। তারপরও থাকা ও খাওয়াবাবদ ৪ হাজার টাকা খরচ। যা এখন আমাকেই যোগাড় করতে হচ্ছে।" 

তিনি বলেন, সারাদিন মটরসাইকেল চালিয়ে ৫০০ টাকা মতো আয় তার। তবে সপ্তাহে ৪ দিনের বেশি চালানো যায় না। বাকি তিনদিন ক্লাস ও পড়াশোনার জন্য রাখতে হয়। 

মগবাজার মোড়ে কথা হয় রিক্সা চালক সহিদুল ইসলামের সঙ্গে। 

তিনি বলেন, "আগে সপ্তাহে ৫ দিন রিক্সা চালাতাম। রিক্সা চালালে শরীর ব্যথা হয়ে যায়, তাই দুই দিন বিশ্রাম নিতাম। এখন প্রতিদিন রিক্সা চালিয়েও সংসারের আয় মেটাতে পারি না। কল্যাণপুর বস্তিতে থাকি। পরিবারের ৩ জন সদস্যকে নিয়ে কোন মতে শাক, ভাত, ডাল খেয়ে বেঁচে আছি।"

মোহাম্মদপুরের দুটি বাসায় কাজ করেন গৃহপরিচারিকা সেলিনা বেগম। দুই বাসা থেকে তার আয় সাড়ে ছয় হাজার টাকা। দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যয় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন নিম্ন আয়ের এই মানুষটিও। তিনি দুটি কাজের পাশাপাশি আরও কাজ খুঁজছেন বলে জানালেন।

চাল, ডাল, তেল, বিস্কুট, রুটি, পাউরুটি, দুধ, ডিম, মাংস থেকে শুরু করে গায়ে মাখা, কাপড় ধোয়া সাবান, টুথপেষ্টসহ সব ধরনের ব্যবহার্য পণ্যের দাম বেড়েছে। এই বাড়তি ব্যয় সামাল দিতে অনেকেই খাওয়া কমিয়ে দিচ্ছে, অনেকে আবার অতিরিক্ত আয়ের উপায় খুঁজছেন।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.