ইইউ’র গ্রিন ডিল: দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশের রপ্তানিতে?

অর্থনীতি

17 May, 2022, 08:10 pm
Last modified: 17 May, 2022, 08:18 pm
ইইউ’র এমন উদ্যোগ নিয়ে অবশ্য উদ্বিগ্ন নন দেশের পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা...

ইউরোপের দেশগুলোকে দীর্ঘমেয়াদে কার্বন নিরপেক্ষ করে তোলার উদ্দেশ্যে কয়েকটি খাতে কার্বন ট্যাক্স আরোপের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক তালিকায় বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক, লেদার আইটেম না থাকলেও ঝুঁকির তালিকায় থাকায় ভবিষ্যতে যে কোনো সময় যুক্ত হতে পারে।

সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের এসব পণ্য বাড়তি প্রতিযোগিতায় পড়তে পারে, যা রপ্তানিকে ক্ষতির মুখে ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশ অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, কেবল বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বের বাণিজ্য আবহ বদলে করে দিতে পারে এই গ্রিন ডিল।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনা এবং ইউরোপের বাজারে ভবিষ্যতে সম্ভাব্য কার্বন ট্যাক্স এড়ানোর অংশ হিসেবে চীনও ইতিমধ্যে কার্বন ট্যাক্স আরোপ করেছে। ভিয়েতনাম, ভারতসহ বাংলাদেশের একাধিক প্রতিযোগি দেশ ইতিমধ্যে এ উদ্যোগ নিয়েছে।

বাংলাদেশকেও ভবিষ্যতে সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবেলার লক্ষ্যে এখন থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। এর অংশ হিসেবে দেশেও কার্বন ট্যাক্স এবং কার্বন মার্কেট চালু করা এবং ধীরে ধীরে রিনিউয়েবল এনার্জিতে মনোনিবেশ করার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন তারা।

ইইউ'র কার্বন ডিল এর অংশ হিসেবে সেখানে কার্বন ট্যাক্স, কার্বন মার্কেট তৈরি, বিশ্ব বাণিজ্য ও বাংলাদেশে এর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র‍্যাপিড)।

প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ড. এম এ রাজ্জাক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ইউরোপ প্রাথমিকভাবে ৬টি খাতকে কার্বন ট্যাক্সের তালিকায় এনেছে এবং এখনো বিদেশ থেকে আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে এটি চালু করেনি। ফলে এখনই বাংলাদেশের উপর প্রভাব পড়ার কোন আশঙ্কা নেই।

'কিন্তু আমাদের তৈরি পোশাক, লেদার এর মত পণ্য ঝুঁকির তালিকায় রয়েছে এবং ২০২৬ সালের পর থেকে এটি চালু করা হলে আমাদের পণ্য সেখানে প্রবেশে কর পরিশোধের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, যা আমাদের বাড়তি প্রতিযোগিতায় ফেলতে পারে', বলেন তিনি।

বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর ইউরোপের জিএসপি প্লাস সুবিধার আওতায় শুল্ক সুবিধা পাওয়ার জন্য যেসব শর্ত নিয়ে এখন পর্যন্ত আলোচনা রয়েছে, তাতে প্রধান রপ্তানি পণ্য অ্যাপারেলের ওই সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা কম। এর মধ্যে নতুন করে কার্বন ডিলের আওতা কিংবা এনভায়রনমেন্টাল, সোশ্যাল এন্ড গভর্নেন্স (ইএসজি) কমপ্লায়েন্সের মত পরিস্থিতি বাংলাদেশের রপ্তানি বাজারকে আরো কঠিন করে তুলতে পারে।

ইউরোপীয় সবুজ চুক্তি আসলে একটি প্রবৃদ্ধি অর্জনের কৌশল, যার আওতায় ইইউ অঞ্চলে- আধুনিক ও সম্পদসাশ্রয়ী সুষ্ঠু সামাজিক সমৃদ্ধি অর্জন এবং প্রতিযোগিতায় সক্ষম অর্থনীতি তৈরির লক্ষ্য রয়েছে। এই কৌশলের আওতায় ২০৫০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ না করার নেট লক্ষ্য রাখা হয়েছে।   

ইইউ'র নতুন গ্রিন ডিল অনুযায়ী, কার্বন ব্যবহারের জন্য প্রত্যেকটি শিল্পকে মূল্য দিতে হবে।

কার্বনের মূল্য নির্ধারণের (প্রাইসিং) দুটি প্রধান মেকানিজমের একটি হলো এমিশন ট্রেডিং সিস্টেম (ইটিএস) এবং কার্বন ট্যাক্স। বর্তমানে ২২% গ্রিনহাউস গ্যাস (জিএইচএস) নিঃসরণ কার্বন মূল্য নির্ধারণ উদ্যোগের আওতাধীন। এর মাধ্যমে মূলত ইউরোপ একটি কার্বন মার্কেট চালু করেছে।

জানা গেছে, ইইউ'র কার্বন বর্ডার অ্যাডজাস্টমেন্ট মেকানিজমের (সিবিএএম)  আওতায়, লোহা ও ইস্পাত, সিমেন্ট, সার, অ্যালুমিনিয়াম, বিদ্যুৎ উৎপাদন- এই খাতগুলো কার্বন ট্যাক্সের আওতায় এসেছে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ইইউভুক্ত বায়ার পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ২০২৬ সাল থেকে কার্বন ট্যাক্স আরোপ করা হবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের পণ্য আমদানিকারকরা জাতীয় কর্তৃপক্ষের সিবিএএম রেজিস্টারের আওতায় থাকে; যেখানে তারা সিবিএএম সার্টিফিকেটও কিনতে পারে। সাপ্তাহিক- ইমিশন ট্রেডিং সিস্টেম (ইটিএস) অনুমোদন সাপেক্ষে সার্টিফিকেটের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। ইইউ আমদানিকারকদের তাদের আমদানিতে সংযুক্ত ( এমবেডেড) ইমিশন ঘোষণা করতে হবে এবং প্রতি বছর সংশ্লিষ্ট সংখ্যক সার্টিফিকেট জমা দিতে হবে। আমদানিকারকরা যদি প্রমাণ করতে পারে যে আমদানিকৃত পণ্য উৎপাদনের সময়ই একটি কার্বন মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে, তাহলে ওই পরিমাণ অর্থ ছাড় পাবে তারা।

যেমন প্রতিটন আমদানি করা পণ্যে ২৮ ডলার কার্বন মূল্য দিলে ২ শতাংশ আমদানি শুল্ক ছাড় পাবে।

বাংলাদেশের ওপর সম্ভাব্য প্রভাব

আলোচ্য খাতগুলোর অধীনে বেশকিছু পণ্য রয়েছে, যা ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশ তেমন রপ্তানি করে না। ফলে বর্তমান নীতিমালা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকলে গ্রিন ডিল ইস্যুতে বাংলাদেশের জন্য বড় ধরণের উদ্বেগ তৈরি করবে না। কিন্তু র‍্যাপিড- এর এ সংক্রান্ত প্রাথমিক মূল্যায়ন অনুযায়ী, অ্যাপারেল,লেদার, ফুটওয়্যার ইত্যাদি কার্বন লিকেজের ঝুঁকিতে আছে এমন ৬৩টি সাব-সেক্টরের মধ্যেই রয়েছে। ইইউ পরবর্তীতে এই আইটেমগুলোকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।

এছাড়াও, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে পূর্ণ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটবে বাংলাদেশের।   ২০২৯ সাল পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের ইবিএ (অস্ত্র বাদে সব) চুক্তির আওতায় সুবিধাসমূহ অব্যাহত থাকবে।

জিএসপি প্লাস সুবিধার আওতায় না আসতে পারলে তখন থেকে তৈরি পোশাক পণ্যে প্রায় ১২% শুল্ক পরিশোধ করতে হবে সেখানকার আমদানিকারকদের। একই সময়ে ভিয়েতনাম ইইউ'র সঙ্গে ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্টের কারণে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে।

বাংলাদেশের পণ্যের উপর অতিরিক্ত কার্বন ট্যাক্স রপ্তানি ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (আঙ্কটাড) মতে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর টার্গেটকৃত কার্বন-নিবিড় খাতের রপ্তানি ১.৪% থেকে ২.৪% হ্রাস পেতে পারে।

অবশ্য ইইউ'র এমন উদ্যোগ নিয়ে উদ্বিগ্ন নন পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা। নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত বিশ্বের অন্যতম গ্রিন ফ্যাক্টরি প্লামি ফ্যাশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ ফজলুল হক টিবিএসকে বলেন, 'ইউরোপ এমন কোন উদ্যোগ নেবে না, যেখানে কেউই কমপ্লাই করতে পারবে না। তাহলে তাদের সাপ্লাই চেইন নষ্ট হবে। আর গ্রিন ইনিশিয়েটিভের যে বিষয়টি আলোচনা হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের তুলনায় বরং এগিয়ে থাকবে। কেননা এখানে এখনই ১৬০টির বেশি গ্রিন ফ্যাক্টরি রয়েছে, এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য উদ্যোক্তাদের জন্য ওই পথে হাঁটা কঠিন হবে না।'

তবে তিনি বলেন, ইউরোপ গ্রিন ডিল নিয়ে কী করতে যাচ্ছে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।

উত্তরণের উপায়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রুমানা হক স্বাস্থ্য এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করছেন। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের এখন থেকেই বিস্তারিত স্টাডি করে ক্রেতা দেশগুলোর স্ট্যান্ডার্ডের আলোকে প্রস্তুতি নিতে হবে। নইলে রপ্তানি বাণিজ্যে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে পড়তে পারে।'

ড. এম এ রাজ্জাক বলেন, ইউরোপের কার্বন ট্যাক্সের নীতিমালা হলো, তাদের তালিকাভুক্ত পণ্য যে কোনো জায়গায় ট্যাক্স পরিশোধ করলে, তার উপর ডাবল ট্যাক্সেশন হবে না। সেক্ষেত্রে একটি বিকল্প হতে পারে, বাংলাদেশ যদি এখন থেকেই কার্বন ট্যাক্স আরোপের বিষয়ে প্রস্তুতি নেয়, তাহলে ইইউভুক্ত দেশে পণ্য রপ্তানির সময় পরিশোধ করতে হবে না। আরেকটি বিকল্প হলো, রিনিউয়েবল এনার্জির প্রতি মনোনিবেশ করা। এ বিষয়ে আমাদের শিল্পোদ্যোক্তা, নীতি নির্ধারকদেরদের সচেতন হতে হবে।

চীন ইতিমধ্যে কার্বন মার্কেট চালু করছে, ভিয়েতনামও চালু করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। বাংলাদেশে এখনো কার্বন ট্যাক্স বা কার্বন মার্কেট নেই। তবে কয়েক বছর আগে থেকে পরিবেশ দূষণকারী শিল্পের উপর ১% হারে সারচার্জ আরোপ করা হয়েছে।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.