সয়াবিন তেলের দাম এখন লিটারে ১৯৮ টাকা
লোকসানের আশঙ্কায় মিল মালিকরা বাজারে ভোজ্যতেল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার পর বৃহস্পতিবার প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম ৩৮ টাকা বাড়িয়ে ১৯৮ টাকা নির্ধারণ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। দেশের ইতিহাসে এটিই সয়াবিন তেলের সর্বোচ্চ দাম বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিনের দাম বাড়িয়ে ৯৮৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আগে এর মূল্য ছিল ৭৬০ টাকা। অর্থাৎ, যেসব ক্রেতা পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের বোতল কিনবেন, তাদের প্রতি লিটারে ৪৫ টাকা করে বাড়তি খরচ করতে হবে।
বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষের সভাপতিত্বে মিল মালিকদের অনুষ্ঠিত এক সভায় নতুন এই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, যা তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর করবে মিলগুলো।
নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮০ টাকা, যা এতোদিন ছিল ১৪৩ টাকা। আর প্রতি লিটার খোলা পাম অয়েলের মূল্য ১৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৭২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সভার পর মিল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স এন্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন নতুন দাম সমন্বয় করার কথা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে।
নতুন দামে শুক্রবার থেকে তেল সরবরাহ করবে মিলগুলো, তবে শনিবারের আগে তা খুচরা পর্যায়ে পৌঁছানোর সম্ভাবনা নেই বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা।
আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে গত এক মাসেরও বেশি সময় ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়ে নির্ধারণ করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চাপ দিয়ে আসছিলেন মিল মালিকরা। মন্ত্রণালয় তাতে সম্মতি না দেওয়ায় ঈদের আগে যখন সারাদেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা বেড়ে যায়, তখন সয়াবিন ও পাম অয়েলের সরবরাহ বন্ধ করে দেয় মিলগুলো।
এতে বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের তীব্র সংকট দেখা দেয়। ঈদের আগে অনেকেই রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ও সুপারশপগুলো ঘুরেও বোতলজাত সয়াবিন তেল কিনতে পারেননি। কোথাও কোথাও এক-দুই লিটারের বোতল পাওয়া গেলেও সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যে তা বিক্রি হয়েছে।
বৃহস্পতিবারও রাজধানীর বাজারগুলোতে বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া যায়নি। কোথাও কোথাও খোলা সয়াবিন পাওয়া গেলেও তা বিক্রি হয়েছে ১৯৫-২০০ টাকা লিটার।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রিফাইনারির কর্মকর্তারা জানান, প্রতি টন ভোজ্যতেলের আমদানি ব্যয় ১৪০৭ ডলার হিসাব করে ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সয়াবিন তেল রপ্তানিকারক দেশ আর্জেন্টিনা রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করায় আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে যায়। এখন মিলগুলো বাজারে যে সয়াবিন তেল সরবরাহ করবে, তার আমদানি ব্যয় ১৬০৫ ডলার। এ হিসাবেই তেলের দাম বাড়িয়ে নির্ধারণ করে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয় ও মিলগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, ইন্দোনেশিয়া ২৮ এপ্রিল থেকে পাম অয়েল রপ্তানি নিষিদ্ধ করার পর আন্তর্জাতিক বাজারে পাম অয়েলের তীব্র সংকট দেখা দেওয়ার পাশাপাশি ভোজ্যতেলের দাম আরও বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে প্রতি টন সয়াবিন তেলের এফওবি মূল্য ২০৩০ ডলারে উঠেছে, যা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইতিহাসের সর্বোচ্চ দাম।
বর্তমান আন্তর্জাতিক দরে আমদানি করা সয়াবিন তেল বাজারে সরবরাহ হলে তখন দাম আরও অনেক বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার পর পাশের দেশ ভারতেও ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে, তবে আগামী দুই মাসের চাহিদা মেটানোর মতো ভোজ্যতেলের মজুদ থাকায় পাকিস্তানের নতুন কোয়ালিশন সরকার নিজ দেশের নাগরিকদের জন্য দাম বাড়ায়নি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি মাসে ১.৩০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে এবং দেড় মাসের চাহিদা মেটানোর মতো ভোজ্যতেলের মজুদ চট্টগ্রাম বন্দরে সরকারের বন্ডেড ওয়্যারহাউজ, মিলগুলোর গুদাম ও ডিলারদের কাছে রয়েছে।
বেশি দামে আমদানি করায় মিলগুলো বাজারে ভোজ্যতেল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। অন্যদিকে, ঈদের পরে দাম বাড়লে বেশি দামে বিক্রি করে বাড়তি মুনাফার আশায় ডিলাররা খুচরা পর্যায়ে তেল সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ায় ঈদের আগে বাজারে সয়াবিনের জন্য হাহাকার করতে হয় ক্রেতাদের।
ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণী বৈঠকগুলোতে নিয়মিত উপস্থিত থাকেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এমন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ঈদের আগে মিল মালিকরা স্বাভাবিকভাবে সয়াবিন তেল সরবরাহ করলে প্রতি লিটারে তাদের অন্তত ৩০ টাকা লোকসান হতো।
সে কারণে তারা তেলের সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় বাজারে সংকট দেখা দেয়। কিন্তু ঈদের এক-দুইদিন আগে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দিলে মন্ত্রণালয় ও সরকারের বিরুদ্ধে ক্রেতাদের ক্ষোভ বাড়তো। এই প্রেক্ষাপটেই ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি বাজারে তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে ঈদের পর প্রথম কার্যদিবসে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
নতুন দামে শুক্রবার থেকেই বাজারে তেল যাবে বলে জানিয়েছেন ভোজ্যতেল পরিশোধন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন।
তবে শনিবারের আগে মার্কেটে তেল পৌছানোর সম্ভাবনা কম বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
দেশে ভোগ্যপণের সবচেয়ে বড় বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির সেক্রেটারি এবং আর এন এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আলমগীর পারভেজ বলেন, খাতুনগঞ্জে এখনো ঈদের ছুটি শেষ হয়নি। আগামী শনিবার মার্কেট অপেন হবে।
"ডিলার ও পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা আগামীকাল মিল মালিকদের কাছ থেকে তেল সংগ্রহ করবেন। শনিবার থেকে তারা এসব তেল বাজারে বিক্রি শুরু করবেন," যোগ করেন তিনি।
ইন্দোনেশিয়া পাম অয়েল রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে গত শুক্রবার, যা কার্যকর হয়েছে ২৮ এপ্রিল থেকে। ওই দিন থেকেই দেশের বাজারে তেলের সংকট তৈরি হয়। দাম বাড়ার পাশাপাশি প্রায় তেলশূন্য হয়ে পড়েছে বাজার।
তবে গতকালও ডিলারদের মাধ্যমে বাজারে স্বল্প পরিমাণ খোলা তেল বিক্রি হয়েছে রাজধানীর কারওয়ানবাজার ও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে। ১৯৫ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত লিটার বিক্রি হয়েছে এসব তেলের।
কারওয়ানবাজারের রিফাত স্টোরের মালিক রিফাত হোসাইন বলেন, প্রতিদিন আমার দোকান থেকে দুই ড্রাম (প্রতি ড্রামে ২০৪ লিটার তেল) তেল বিক্রি হয়। ঈদের তিনদিন আগে থেকে সাপ্লাই কম। কিছু পরিচিত হোটেল ব্যবসায়ী রয়েছেন, যারা তেলের সঙ্গে অন্য পণ্যও কিনেন শুধু তাদের কাছেই কম কম করে তেল বিক্রি করছি। ডিলারদের কাছ থেকে ১৯৫ টাকা করে কিনতে হচ্ছে এসব তেল।
তবে তেলের বর্ধিত দাম এবং সরবরাহ সংকট নেই বলে দাবি করছেন সিটি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক বিশ্বজিত সাহা।
তিনি বলেন, আমরা এখনো তেল সরবরাহ করছি। লোকসান দিয়ে প্রতিদিন অন্তত ২ লাখ লিটার তেল বাজারে সরবরাহ করছি। নতুন দামে আগামীকাল থেকেই বাজারে দেয়া হবে।
তবে শনিবারের আগে তেল হাতে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
রোজার আগে ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ নিয়ে সভা করেছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তখন ব্যবসায়ীদের দাম বাড়ানো নাকচ করে দিয়ে ঈদের পর দাম সমন্বয়ের আশ্বাস দিয়েছিলেন মন্ত্রী। তবে রমজান ও ঈদ উল ফিতরের সময় যাতে নির্ধারিত দামে তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকে, সেজন্য মিল মালিকদের অনুরোধ করেছিলেন তিনি। মিলাররা তার সে অনুরোধ রাখেনি।
এদিকে, ওই সভার পর ভোজ্যতেল আমদানির উপর আরোপিত ১৫% মূল্য সংযোজন কর কমিয়ে ৫% করার সিদ্ধান্ত নেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। কিন্তু ওই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে চট্টগ্রাম বন্দরে বন্ডেড ওয়্যারহাউজে খালাসের অপেক্ষায় থাকা ভোজ্যতেল খালাস করার সময় আগের হারেই ভ্যাট আদায় করে এনবিআর।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে এনবিআরকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করলেও তা কার্যকর করা হয়নি। এক্ষেত্রেও লোকসানের শিকার হন ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছর ২০ টন অপরিশোধিত ভোজ্যতেল ও সয়াসিড আমদানি করেছে মিলগুলো। এর মধ্যে ১৩ লাখ টন ছিল পাম অয়েল, যার প্রায় ৯০% আমদানি হয়েছে ইন্দোনেশিয়া থেকে। বাকি ৭ লাখ টন সয়াসিড ও অপরিশোধিত পাম অয়েল আমদানি হয়েছে।
এছাড়া প্রায় এক লাখ টন পরিশোধিত সূর্যমুখী ও ক্যানোলা তেল আমদানি হয়েছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে।