ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে চুক্তির চেয়েও অতিরিক্ত সুদ আদায় করছে

অর্থনীতি

01 May, 2022, 01:10 pm
Last modified: 01 May, 2022, 02:25 pm
সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) আমানত ও ঋণের সুদহার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কিছু কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান উচ্চ সুদ হারে আমানত গ্রহণের ফলে অযৌক্তিকভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিল ব্যয় বাড়ছে।

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের বাসিন্দা হাসিনা বেগম একটি বাড়ি নির্মাণ করতে ইসলামি ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিঃ এর কাছে ঋণ নেন। নারায়ণগঞ্জ শাখা থেকে ৮০ লাখ টাকার ঋণ মঞ্জুর করা হয়, এই ঋণের মেয়াদ ছিল ১০ বছরের। মাসিক কিস্তির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৫২ হাজার টাকা।   

ঋণের মঞ্জুরী পত্রে লভ্যাংশ বা মুনাফা উল্লেখ করা হয়নি। পরবর্তীতে ঋণ নেওয়ার ৮ বছর পর জানা যায় এ ঋণের মুনাফার হার ছিল ২০ শতাংশ। ১০ বছরে কিস্তির সংখ্যা ধরা হয়েছে ১২০টি। আসল ও মুনাফা মিলে পরিশোধ করতে হবে ১ কোটি ৮২ লাখ টাকা।

প্রতিষ্ঠানটি ২০১৩ সালের ২২ ডিসেম্বর থেকে বিভিন্ন অনিয়মিত কিস্তির মাধ্যমে বাড়ি নির্মাণ ও সংস্কার কাজের জন্য গ্রাহককে ৫৫ লাখ টাকা দিয়েছে। বাকি ২৫ লাখ টাকা ঋণের কিস্তি হিসেবে শাখা কর্তৃক আদায় করে নিয়েছে, যদিও প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহককে বলছে ২৫ লাখ টাকাও হাসিনা বেগমকে দেওয়া হয়েছে। বাকি টাকা না পাওয়ায় গ্রাহকের বাড়ির কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যায় এবং বাড়ির আয় থেকে বঞ্চিত হয় গ্রাহক।

হাসিনা বেগম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ঋণের মঞ্জুরী পত্রটি ছিল ইংরেজি ভাষার। স্বল্প পড়ালেখার কারণে তিনি শর্তগুলো বুঝেননি। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারাও তাকে এসব শর্ত সঠিকভাবে অবহিত করেননি। "আমি যদি অলিখিত ও গোপনীয় মুনাফার হার জানতাম তাহলে এ ঋণটি আমি নিতাম না, জীবন মরণ সংকটেও পরতাম না।" 

এই ৮০ লাখ টাকার বিপরীতে গ্রাহক ৮ বছরে আসল ও মুনাফা বাবত ৯৭ লাখ ৮১ হাজার ০২৯ টাকা বিবিধ মাসিক কিস্তির মাধ্যমে পরিশোধ করেছেস। তিনি ইতোমধ্যেই আসল টাকার চেয়ে ১৭ লাখ ৮১ হাজার টাকা বেশি পরিশোধ করেছেন। যার আরোপিত সুদের হার ঋণের শুরু থেকেই ছিল ২০ শতাংশ। যদিও গ্রাহক থেকে মুনাফার হার পরিবর্তনের আবেদন করলেও পরিবর্তন করা হয়নি।

সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) আমানত ও ঋণের সুদহার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কিছু কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান উচ্চ সুদ হারে আমানত গ্রহণের ফলে অযৌক্তিকভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিল ব্যয় বাড়ছে। এর প্রভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উচ্চ সুদ হারে গ্রাহকদের ঋণ সুবিধা দিতে হচ্ছে। এতে গ্রাহকদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা হ্রাস, খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও হার বৃদ্ধি এবং উৎপাদনসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। 

এ অবস্থায় চলতি বছরের এপ্রিলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানতের ওপর সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ এবং ঋণের ওপর সর্বোচ্চ ১১ শতাংশ সুদ নির্ধারণ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক, আগামী ১ জুলাই থেকে এটি কার্যকর হবে। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত এক বছরে ৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানত সংগ্রহ করেছে ১২ শতাংশের চেয়ে বেশি সুদে। 

এছাড়া গত ৩ বছরের বেশি সময় ধরে ছয়টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ১২-১৩ শতাংশ সুদে আমানত গ্রহণ করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স, ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, হজ ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিং এবং ইউনিয়ন ক্যাপিটাল।

এদিকে ঋণ বিতরণে চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আটটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৭-১৮ শতাংশ।

এর সঙ্গে আগের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে মিডাস ফাইন্যান্সিং, ফিনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টস, এবং প্রিমিয়ার লিজিং।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানে উচ্চ হারে আমানত গ্রহণ করে অধিক সুদে ঋণ বিতরণ করছে। এরই ফলে ঋণের টাকা উত্তলন করতে গিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান হোচট খাচ্ছে যার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। 

এছাড়া কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের ঋণ মঞ্জুরী নথীতে ঋণের সুদ হার উল্লেখ না করে নির্ধারিত সুদের হারের চেয়ে অতিরিক্ত সুদ গ্রহণ করছে যার ফলে ভালো ভালো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছেও জিম্মি হয়ে আছে অসংখ্য গ্রাহক।

ইসলামী ফাইন্যান্সের ভুক্তভোগী গ্রাহক হাসিনা বেগম ২০১৭ ও ২০১৯ সালে  প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর আবেদন করেন মুনাফার হার কমাতে। কিন্তু মুনাফার হার পরিবর্তন করা হয়নি। "যদি সরকারের নির্ধারিত এই হারে অথবা যৌক্তিক হারে আমার ঋণ হিসাবটি নিরূপণ করা হয় তাহলে অবশিষ্ট পাওনার পরিমাণ অর্ধেক নেমে আসবে।" 

হাসিনা আরও জানান, কোভিডের সময়ে কিছু কিস্তি বকেয়া হওয়ার কারণে তার ও তার স্বামীর বিরুদ্ধে ১০টি মামলা করা হয়,  ফলে অন্যের বাড়িতে রাত কাটাতে বাধ্য হন তারা। 

"বর্তমানে আমার কাছে এ ঋণের দায় গলার ফাঁস তুল্য । মামলা পরিচালনা করতে খরচের ব্যয়ভার বহনে আমাদেরকে অসহায় ও অক্ষম করে তুলেছে।" 

এছাড়া ইসলামি ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের নুর মোহাম্মদ নামে আরেক গ্রাহককে দেড় কোটি টাকা হাউজ লোন দেওয়া হয়। যার ঋণের সুদের হার নির্ধারণ করা হয় ১৫ শতাংশ।

আইডিএলসি থেকে হাউজ লোন নিয়ে বেকায়দায় গ্রাহক সিহাব উদ্দিন

মৌলভীবাজারের সিহাব উদ্দিন আইডিএলসি থেকে ১০ শতাংশ সুদে ২০১৬ সালের ২০ অক্টোবর ১৫ বছর মেয়াদি ২০ লাখ টাকা ঋণ নেন। মাসিক ২৫৩০০ টাকা কিস্তিতে এ গ্রাহক নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করে আসছেন। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ১০ শতাংশ সুদ গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়।

২০২১ সালের ১৮ জুলাই প্রতিষ্ঠানটির হিসাব বিবরণীতে দেখতে পান,  ১৬.৫০ শতাংশ সুদ চার্জ করা হচ্ছে। যা ঋণ বিতরণের নীতিমালার পরিপন্থী। এ গ্রাহক প্রতিষ্ঠানটির কাছে তার হিসাব বিবরণীর পত্র চাইলে তা দিতে অস্বীকৃতি জানায় আইডিএলসি।

গ্রাহকের ঋণ চুক্তির তিন শতাংশ বেশি সুদ নিচ্ছে ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট  

যাত্রাবাড়ীর ১নং গেইট এলাকার বাসিন্দা হাসিবুর রহমান ন্যাশনাল হাউজিং এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড থেকে ২০১৭ সালে ২ কোটি টাকার হোম ঋণ নেন। 

"সুদের হার ১১% মর্মে এ ঋণ নেই আমি। কয়েক কিস্তির টাকা পরিশোধ করার পরবর্তীতে অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্ট নেওয়ার পর দেখা যায় সুদের হার ১৪% নেওয়া হচ্ছে। ২০১৮ সালে আমি সুদের হার কমাতে আবেদন করি। এর কোন ব্যবস্থা না হওয়ায় পরবর্তীতে ২০১৯ সালে পুনরায় চিঠি দেওয়া হয়, কিন্তু তাও কোনো উত্তর পাইনি।" 

"আজ নয় কাল বলে বিলম্ব করতে থাকে, তারপরও আমি নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করছিলাম। এরই মধ্যে ২০২০ সালে কোভিড শুরু হলে আমার সকল ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়, এমনকি বাড়ির ভাড়াটিয়ারা ভাড়া পরিশোধ করছিল না। এছাড়া অনেকে বাসা ছেড়ে চলে যায়। কোভিডকালে কিস্তি আদায় বন্ধ রাখার নির্দেশ থাকলেও এই প্রতিষ্ঠান প্রত্যেক কিস্তির চেক ব্যাংকে জমা দিয়ে ডিজঅনার করে তা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদসহ আমার একাউন্টে ঋণ দেখায়।" 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.