রাঙ্গুনিয়ায় দেশের প্রথম বেসরকারি ইপিজেড প্রকল্প: যে স্বপ্ন আলোর মুখ দেখেনি

অর্থনীতি

23 April, 2022, 07:00 pm
Last modified: 15 May, 2022, 10:09 am
কর্ণফুলী নদীর তীরে আইটি হাব ও এগ্রো ভ্যালি গড়ে তোলা গেলে সেখানে ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যেত।

১৯৯৯ সালে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় দেশের প্রথম বেসরকারি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এরপর ২৩ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও চালু হয়নি ইপিজেডটি।

কর্ণফুলী নদীর তীরে আইটি হাব ও এগ্রো ভ্যালি গড়ে তোলার সেই স্বপ্ন আজও আলোর মুখ দেখেনি। যেখানে ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান গড়ে তোলার কথা ছিল, সেই জঙ্গল ঘাটচেক এলাকা এখনও বনজঙ্গলেই ছেয়ে রয়েছে।

১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার 'প্রাইভেট এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (ইপিজেডএস)' নামে একটি বিল পাস করে, যা এক মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে আইনে পরিণত করা হয়। ইপিজেডএস-এর বোর্ড অভ গভর্নরদের প্রথম সভাতেই চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় দেশীয় মালিকানাধীন প্রথম বেসরকারি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল গঠনের প্রস্তাব ওঠে। 

১৯৯৮ সালের ২৯ মার্চ সরকার সে প্রস্তাব অনুমোদন দিলে গঠন হয় 'চিটাগং ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক লিমিটেড (সিআইপিএল)'। ১৯৯৯ সালের ১০ অক্টোবর এই রাঙ্গুনিয়া ইপিজেডের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দেশীয় মালিকানাধীন প্রথম বেসরকারি এই রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল গড়ার এ উদ্যোগটির শুরু যতটা স্বপ্নিল, প্রকল্প পাসের পরের ইতিহাস ততটাই মলিন। ১৯৯৯ সালে ভূমি জরিপের পর ২০০০ সালে ১৩ জন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীকে হস্তান্তর করা হয় জমির দলিল। 

কিন্তু ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতা প্রহণের পর প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে প্রকল্পটি আবারও চালুর উদ্যোগ নেয়। ২০১০ সালের ৭ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বেসরকারি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল পরিচালনা বোর্ডের এক সভায় চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় ইপিজেডের জন্য প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

কী ছিল সেই মহাপরিকল্পনায়?

রাঙ্গুনিয়া ইপিজেডের প্রকল্প এলাকাটি চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার ও রাঙ্গামাটির কাপ্তাই উপজেলা থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। দুই কিলোমিটারের মধ্যে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়ক ও কর্ণফুলী নদীর অবস্থান এলাকাটিকে যোগাযোগের জন্য সহজতর করেছে। 

পার্বত্য চট্টগ্রামের খুব কাছাকাছি হওয়ায়, পাহাড়ে উৎপাদিত কৃষি পণ্যের গন্তব্যে পরিণত হওয়ার সুযোগ ছিল এই ইপিজেডের। ভৌগোলিক সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে ভারতের সেভেন সিস্টার, ভুটান, সিকিম, নেপাল ও চীনে ব্যবসা সম্প্রসারণেরও সুযোগ ছিল। 

বেপজা সূত্রে জানা গেছে, রাঙ্গুনিয়া ইপিজেডে ইনফরমেশন টেকনোলজি ভ্যালি (আইটি ভ্যালি) এবং অ্যাগ্রিকালচার ভ্যালি (অ্যাগ্রো ভ্যালি) গড়ে তোলার প্রাথমিক লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছিল। সেই লক্ষ্যে ২০০০ সালেই সাবমেরিন ক্যাবল সিস্টেমের শীর্ষস্থানীয় ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি ব্যাকটেলের সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করা হয়েছিল। ব্যাকটেল এ ইপিজেডে প্রাথমিক পর্যায়ে ৭০০ কোটি টাকা এবং পরে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়েছিল। পাহাড় আর সমতলের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এই ইপিজেডে হেলিপ্যাড, কন্ট্রোল টাওয়ার ও সীমানাপ্রাচীরসহ কিছু স্থাপনাও গড়ে তোলা হয়। 

চিটাগং ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক লিমিটেডের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হযেছে, ইতিমধ্যে কোম্পানির নামে ৮৭ একর জমি রেজিস্ট্রি হয়েছে। আরও ১৮২ একর জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে। ইতিমধ্যে জোনের অবকাঠামোর জন্য উপকরণ ও সরঞ্জাম শুল্কমুক্ত আমদানির জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে সম্মতি পেয়েছে।

ভুল হাতে বড় উদ্যোগ?

স্থানীয়রা বলছেন, রাঙ্গুনিয়া ইপিজেড গঠনের প্রক্রিয়াটি অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় মৃত্যু হয়েছে এই স্বপ্নের। 

সাংবাদিক ও গবেষক এনায়েতুর রহিম জানান, চিটাগং ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাইয়ুম চৌধুরী তার পৈত্রিক সম্পত্তিতে এই ইপিজেড তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। স্থানীয় কয়েকজনও তাদের জমি ইপিজেডের জন্য তাকে দিয়েছিলেন। 

কিন্তু জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কাইয়ুম চৌধুরী সমন্বয় না করায় এবং আশপাশের বাকি জমিগুলো অধিগ্রহণ করা সম্ভব না হওয়ায় প্রকল্পটি ভেস্তে যায়।

ইপিজেডে ভূমিদাতা মো. আব্দুল কাইয়ুম তালুকদার বলেন, 'এই ইপিজেড ঘিরে আমরা দীর্ঘদিন ধরে স্বপ্ন দেখছি। শুধুমাত্র এলাকার উন্নয়নের জন্য, মানুষের কর্মক্ষেত্র তৈরির জন্য ইপিজেডকে জমি দিয়েছিলাম, যা গত ২৪ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি।'

রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম বলেন, 'রাঙ্গুনিয়া ইপিজেড এবং কোরিয়ান ইপিজেড সমসাময়িক প্রকল্প। শুরুর দিকে দুটো অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানিসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি রাঙ্গুনিয়া ইপিজেডে বিনিয়োগের জন্য এসেছিল।' 

অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, 'সে সময়ের বাস্তবতায় হয়তো রাঙ্গুনিয়ায় ইপিজেড তৈরির উদ্যোগটি ঠিক ছিল। তবে বর্তমানে সারা দেশে যে ১০০টি ইপিজেড গড়ার প্রক্রিয়া চলছে, তাতে দেশে আর ইপিজেডের প্রয়োজন হবে না।'

তবে পার্বত্য এলাকায় উৎপাদিত বিপুল ফল ও শাকসবজি সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য রাঙ্গুনিয়ার ওই অঞ্চলটিতে রপ্তানিমুখী কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপন করা যেতে পারে বলে মত দেন তিনি।

এদিকে রাঙ্গুনিয়া ইপিজেডের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চিটাগং ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে গত এক সপ্তাহ ধরে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারেনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। মুঠোফোন বার্তা ও মেইলেরও জবাব দেননি তিনি।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.