ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বেকারি পণ্যের দাম বৃদ্ধির শঙ্কা 

অর্থনীতি

21 April, 2022, 12:40 pm
Last modified: 21 April, 2022, 01:39 pm
বর্তমানে সরকারের গমের মজুদ ১ লাখ ৪৯ হাজার টনে নেমেছে। এই পরিমাণ গম দিয়ে চলতি অর্থবছর পর্যন্ত টেস্ট রিলিফ, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির চাহিদাও মেটানো সম্ভব নয়।

বিশ্বের প্রধান দুই গম রপ্তানিকারক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে জড়ানোর পর আন্তর্জাতিক বাজারে এমনিতেই গমের সরবরাহ ঘাটতির পাশাপাশি দাম অনেকটাই বেড়ে গেছে। এ সময় খাদ্যের বাড়তি মজুদ গড়তে চলতি বছর বৈশ্বিক বাজারের অর্ধেকেরও বেশি গম একাই কেনার পরিকল্পনা করছে চীন, যা সরবরাহ সংকটসহ দাম আরও উস্কে দিতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। 

এমন পরিস্থিতিতে আসন্ন গ্রীষ্ম মওসুম শেষে দেশে গম ও আটার চাহিদা বাড়ার সময় সে অনুযায়ী গম না পাওয়ার আশঙ্কা করছে ফুড ইন্ডাস্ট্রিগুলো। এতে নুডুলস, পাস্তা, বেকারি, ব্রেড, বিস্কুটসহ আটার দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন এ শিল্পের কর্মকর্তারা। বিশ্ববাজারে সংকট ঘনীভূত হওয়ার আগেই আমদানি করে মজুদ করে রাখার মতো সংরক্ষণাগারও নেই দেশের ফুড ইন্ডাস্ট্রিগুলোর।

তারা বলছেন, ১২০ কোটিরও অধিক জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে চীন যখন বৈশ্বিক বাজার থেকে কোন পণ্য অধিকহারে কিনতে শুরু করে, তখন স্বাভাবিক বিশ্ব পরিস্থিতিতেও ওই পণ্যের সরবরাহ সংকট তীব্র হয়ে উঠে। আর যুদ্ধের কারণে এবছর ইউক্রেনে গমের আবাদ কমে যাওয়াসহ বন্দর বেহাত হওয়ায় রপ্তানি সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। গত দু'মাসে দামও ২০% এর বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।

ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অফ এগ্রিকালচারের (ইউএসডিএ) বরাত দিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত দ্য ইকোনোমিস্ট পত্রিকার এক রিপোর্টে বলা হচ্ছে, খাদ্যের বাড়তি মজুদ গড়তে বৈশ্বিক বাজার থেকে সরবরাহকৃত ভু্ট্টার ৬৯ শতাংশ, গমের ৫১ শতাংশ ও ৬০ শতাংশ চাল কেনার পরিকল্পনা করেছে চীন। যা এই বছরের মধ্যেই কেনার পরিকল্পনা।

২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সময় চীন বৈশ্বিক বাজার থেকে বিপুল পরিমাণ ভোজ্যতেল আমদানি করা শুরু করে। তার প্রভাবে চলতি বছর আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ২০০০ ডলারে উঠে গেছে, যার প্রভাবে গত কয়েকমাস ধরে বাংলাদেশের ভোক্তারা প্রবলভাবে ভুগছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর গম আমদানির জন্য বাংলাদেশসহ বিশ্বের জন্য মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে ভারত, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। কিন্তু বৈশ্বিক চাহিদা মেটানোর মতো পর্যাপ্ত মজুদ ও উৎপাদন- কোনটিই সম্ভব নয় দেশগুলোর পক্ষে। যুদ্ধ যতো দীর্ঘ হবে, সংকট ততোও বাড়বে।

বাংলাদেশের বেসরকারি খাত এখনও চাহিদা অনুযায়ী ভারত থেকে গম আমদানি করতে পারছে। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া থেকে গম আমদানির সুযোগ আছে, তবে তা অনেক বেশি ব্যয়বহুল। বিশ্বজুড়ে ফার্টিলাইজারের দাম বৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন অঞ্চলে এবছর গমের উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় চীন আগ্রাসীভাবে আমদানি শুরু করলে আগামী দিনগুলোতে বাড়তি মূল্যেও গম না পাওয়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।

২৪ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আন্তর্জাতিক বাজারে গমের সরবরাহ সংকট ও দাম বাড়ার পর বেকারি পণ্যের দাম কিছুটা বৃদ্ধি কিংবা পণ্যের আকার ছোট হলেও রমজানে চাহিদা কম থাকায় খুব বেশি ভুগতে হয়নি বাংলাদেশের ভোক্তাদের। তবে বর্ষাকাল থেকে আটা-ময়দাসহ তা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন পণ্যের সরবরাহ ৩০-৩৫% কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।

বসুন্ধরা মাল্টিফুড লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার মো. রেদোয়ানুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এখন আমরা দাম বেশি দিয়ে কিনতে পারছি। কিন্তু চায়না এগ্রেসিভলি কেনা শুরু করলে আন্তর্জাতিক বাজারে তার প্রভাব কতোটা ভয়ংকর হয়ে উঠে তা আমরা ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে দেখছি।"

"করোনার শুরুর বছরেই চীন ভোজ্যতেলের বাড়তি মজুদ গড়ে। দুই বছর পরে এসে এখন তেলের দাম আকাশচুম্বী। আমাদের গম আমদানির সোর্সগুলোর মধ্যে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত রয়েছে। বর্ষাকাল থেকে যখন দেশের ভেতরে আটাসহ বেকারি পণ্যের বাড়তি চাহিদা মেটাতে অতিরিক্ত গম আমদানির প্রয়োজন হবে, তখন থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে গম না পাওয়ার আশঙ্কা করছি আমরা", যোগ করেন তিনি।

মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সিনিয়র সহকারী মহাব্যবস্থাপক তাসলিম শাহরিয়ার টিবিএসকে বলেন, এখন আমরা ভারতের কাছ থেকে যথেষ্ট গম আমদানি করতে পারছি, যদিও চড়া দাম। তবে ভবিষ্যতে গমের সরবরাহে সংকট তৈরি হবে কিনা এখনই বলা যাচ্ছে না। এটা অনেকটাই যুদ্ধের স্থায়িত্বের উপর নির্ভরশীল।

বেসরকারিখাতই নয়, সরকারিভাবেও গমের মজুদ কমে আসছে। বর্তমানে সরকারের গমের মজুদ ১ লাখ ৪৯ হাজার টনে নেমেছে। এই পরিমাণ গম দিয়ে চলতি অর্থবছর পর্যন্ত টেস্ট রিলিফ, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির চাহিদাও মেটানো সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের চাহিদা মেটাতে ভুট্টার একটা বড় অংশ চাষ হলেও গমের আবাদ তলানিতে। দেশে প্রতি বছর প্রায় ৬০ লাখ টনের বেশি গমের বিপরীতে উৎপাদন মাত্র ১২-১৩ লাখ টন।

ইউক্রেন যুদ্ধের পর সরকারিভাবে ভারত থেকে ৪০৯ ডলার দরে ৫০ হাজার টন গম আমদানির প্রস্তাব অনুমোদন করেছিল সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি, যা ইতোমধ্যে দেশে এসেছে। বুধবার কমিটি ভারত থেকে ৩৯১ ডলার দরে আরও ৫০ হাজার টন গম আমদানির অনুমোদন করেছে। আর কানাডিনায় গমের দাম ৩০০ ডলার থেকে বেড়ে এখন ৫১০-৫২০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। 

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, যুদ্ধ শুরুর পর গম আমদানির জন্য দরপত্র আহ্বান করার পর সরবরাহ আদেশ ইস্যু করা হলেও সরবরাহকারীরা গম সরবরাহ করতে পারছেন না। মূলত, টেন্ডারকালীন সময়ের তুলনায় পরে গমের দাম বেড়ে যাওয়া ও জ্বালানী তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সমুদ্রপথে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় অধিক লোকসানের ভয়ে গম সরবরাহ থেকে বিরত থাকছেন তারা।     

এদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সরবরাহকারীরা টেন্ডারে অংশ নিয়েও সরকারের কাছে গম সরবরাহ করছে না। এর মধ্যেই রাশিয়া থেকে ৫০ হাজার টন গম কেনার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

খাদ্য প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, চায়না যখন কোন পণ্যের বাড়তি মজুদ গড়তে শুরু করে তখন সবকিছুর দাম বেড়ে যায়। চায়নাকে হটিয়ে কোন কিছু কেনার সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই, আবার এসব পণ্য কিনে দীর্ঘমেয়াদে মজুদ করার কোন ব্যবস্থাও খুব বেশি কোম্পানির নেই।  

তবে এখনো বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে গম কিনতে পারছেন, যদিও এর জন্য বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। তবে ক'দিন পর গমের এই সরবরাহ কতটা স্বাভাবিক থাকবে বা সব দেশ থেকে সরবরাহ পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তখন হয়তো কিছুটা পাওয়া গেলেও দাম থাকবে আকাশচুম্বী।  

আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা করে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ফুড প্ল্যানিং অ্যান্ড মনিটরিং ইউনিট (এফপিএমইউ)। এই ইউনিটের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে টিবিএসকে বলেন, দু'টি বড় সরবরাহকারীর রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিশ্বব্যাপী সরবরাহে সমস্যা হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। এই সমস্যার মধ্যে বাংলাদেশও পড়তে বাধ্য।

"এ বছর সংকট তো থাকবেই, পরবর্তী মৌসুমে এই সংকট আরও বেড়ে যাবে। কারণ, বিভিন্ন দেশে উৎপাদন কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশ্বব্যাপী গম উৎপাদনে ব্যবহৃত সারের বড় অংশের যোগান আসে রাশিয়া থেকে। সারের সরবরাহ কমে যাওয়ায় উৎপাদনে একটা ধাক্কা আসবে",  জানান তিনি। 

খাদ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (সংগ্রহ) মো. মনিরুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, "আমরা ইন্ডিয়া থেকে গম পাচ্ছি, কোন সমস্যা হচ্ছে না। কোন কারণে ইন্ডিয়া থেকে আমদানি ব্যাহত হলে বা ইন্ডিয়াতে সরবরাহ সংকট দেখা দিলেও যাতে আমদানি অব্যাহত রাখা যায়, সেজন্য আমরা কয়েকটি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। বুলগেরিয়ার সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা নিজেরাই আগ্রহ দেখিয়েছে।"

তিনি বলেন, "অস্ট্রেলিয়া-কানাডা থেকে গম আনলে হয়তো খরচ বেশি হবে, কিন্তু সংকট হবে না।"

বিশ্ববাজারে গমের সরবরাহ সংকট দূর করতে রপ্তানি বাড়িয়েছে ভারত। কিন্তু দেশটি চাহিদার কতোটা মেটাতে পারবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। মঙ্গলবার বিবিসি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছর ভারতের ১৬ মিলিয়ন টন গম রপ্তানি করার সক্ষমতা রয়েছে। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর রিসার্চ অন ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক রিলেশনস-এর কৃষি বিভাগের অধ্যাপক অশোক গুলাতি এই মত জানিয়েছেন।

বিবিসিকে অশোক বলেন, "ডব্লিউটিও যদি সরকারী মজুদ রপ্তানির অনুমতি দেয় তবে তা আরও বেশি হতে পারে। এটি বৈশ্বিক দরকে কিছুটা প্রশমিত করতে এবং বিশ্বজুড়ে আমদানিকারক দেশগুলোর ওপর বোঝা কমাতে সহায়তা করবে"।

দিল্লিভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের সিনিয়র ফেলো হরিশ দামোদরন বিবিসিকে বলেছেন, "আমাদের কাছে এই মুহূর্তে পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। তবু কিছুটা উদ্বেগের ব্যাপার তো রয়েই যায়। বিশ্বকে খাদ্য সরবরাহ প্রসঙ্গে আমাদের তাই অতি-উৎসাহী হওয়াটা সমীচীন হবে না।"

মার্কিন কৃষি বিভাগের চলতি দেওয়া পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি মওসুমে গমের বৈশ্বিক বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়াবে ২০ কোটি ১ লাখ টন, এটি গতমাসের তুলনায় ৩০ লাখ টন কম।

ওয়ার্ল্ড এগ্রিকালচারাল সাপ্লাই অ্যান্ড ডিমান্ড এসটিমেটস রিপোর্টে ইউএসডিএ জানায়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), ইউক্রেন, যুক্তরাষ্ট্র ও কাজাখস্তানের দুর্বল রপ্তানি পরিস্থিতির কারণে নিম্নমুখী বাণিজ্যের প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়া, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার রপ্তানি বাড়ার সম্ভাবনা থাকলেও তা বাজারে সৃষ্ট ঘাটতি মোকাবেলায় সক্ষম হবে না।

ফেব্রুয়ারী মাসে এসে ইউএসডিএ বলে, ২০২১-২২ এ গমের বৈশ্বিক উৎপাদন হবে ৭৭৬ মিলিয়ন মে. টন, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে মাত্র ০.১ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে একই সময়ে বিশ্ববাজারে ২০৮.৪ মিলিয়ন টন গম বিক্রি হবে যা আগের বছরের তুলনায় ৫ শতাংশ বেশি।  
 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.