দুই বছর পর ঈদ ফিরেছে ফ্যাশন হাউজগুলোতে 

অর্থনীতি

18 April, 2022, 04:30 pm
Last modified: 19 April, 2022, 12:13 am
৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি স্থানীয় ফ্যাশনের বাজারে ৭৫ শতাংশই বিক্রি হয় পহেলা বৈশাখ ও ঈদে। করোনার কারণে গত দুই বছর এর অর্ধেক বেচাবিক্রিও করতে পারেননি ব্যবসায়ীরা।

গত শুক্রবার রাজধানীর বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সের আড়ং থেকে বাচ্চাদের জন্য ৮৭০০ টাকার পোশাক কিনেছেন যাত্রাবাড়ির আনিসুর রহমান। তবে বিল পরিশোধে কাউন্টারে লাইনে দাঁড়িয়ে ৪৫ মিনিটের বেশি অপেক্ষা করতে হয়েছে তাকে।

নিয়মিত কেনাকাটা করলেও মানুষের ভিড়ের কারণে এই প্রথম এতো দীর্ঘসময় লাইনে দাঁড়িয়েছেন বলে টিবিএসকে জানান আনিসুর রহমান। 

শুধু আড়ং নয়, প্রতিটি ব্র্যান্ড শপেই মানুষের ভিড় জানিয়ে তিনি বলেন, "আড়ং, ইয়েলো, একসটেসি, ইনফিনিটি, এপেক্স, বাটাসহ প্রায় সব ব্র‌্যান্ডের দোকানে অনেক ভিড়। আমি বসুন্ধরায় আড়ংয়ের সাতটি ফ্লোরের প্রতিটিতে ঘুরেছি। মানুষের ভিড়ে কেনাকাটা করা দায়!"

ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবারের ঈদকে কেন্দ্র করে রোজার আগে থেকেই ক্রেতাদের প্রচুর ভিড় দেখছেন তারা। করোনার কারণে গত দুই বছর যেসব কাস্টমার পোশাক-জুতা, অলংকার কিনতে পারেননি তারাও ভিড় করছেন মার্কেটগুলোতে। 

বাংলাদেশ ফ্যাশন ডিজাইনার অ্যসোসিয়েশনের সভাপতি ও অঞ্জনস শোরুমের মালিক শাহীন আহমেদ বলেন, "গত দুই বছরে পহেলা বৈশাখ ও ঈদুল ফিতরের উৎসবে করোনার কারণে ফ্যাশন হাউসগুলোর প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এবার পরিবেশ খুব ভালো। এখন পর্যন্ত বিক্রির অবস্থা বলছে এবার আমরা লোকসান করবো না।"

তিনি বলেন, "রোজার মধ্যে পহেলা বৈশাখ পড়ে যাওয়ায় নববর্ষকেন্দ্রিক বিক্রি কিছুটা কম ছিল। তবে ঈদ সেল অনেক ভালো। আশা করছি স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও বেশি বিক্রি হবে।"

সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি স্থানীয় ফ্যাশনের বাজারে ৭৫ শতাংশই বিক্রি হয় পহেলা বৈশাখ ও ঈদে। করোনার কারণে গত দুই বছর এর অর্ধেক বেচাবিক্রিও করতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। 

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের প্রতিনিধি রাজধানীর মৌচাক, গাউসিয়া, নিউ মার্কেট, বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সে কাপড়, কসমেটিকস ও জুতার দোকানগুলোতে ঘুরে ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ করেছেন। তবে ঢাকার বাইরে দেশের অন্যান্য শহরগুলোতে ঈদের কেনাকাটা এখনো পুরোপুরি জমে ওঠেনি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় প্রতিনিধিরা।  

বসুন্ধরা আড়ংয়ের শোরুম সুপারভাইজার সিহাব হোসাইন বলেন, "ঈদ কেনাকাটা করোনার আগের সময়ের অবস্থায় ফিরে এসেছে। করোনার আগে এই সময় যেমন বিক্রি হতো এখনও সেভাবেই বিক্রি হচ্ছে।"

বারিধারা থেকে ব্যবসায়ী তৌহিদুল ইসলাম পরিবার নিয়ে বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সে কেনাকাটা করতে এসেছেন। শুক্রবার বিকেলে তার হাতে ১৫টি শপিংব্যাগ ভর্তি কাপড় দেখা গেল। 

তিনি বলেন, "গত দুই বছর আত্মীয় স্বজনদের পোশাক-আশাক দেওয়া হয়নি। এবার সবার জন্য কিনেছি।" 

মৌচাক মার্কেটে ইমন ফেব্রিকস স্টোরের বিক্রেতা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, "করোনার জন্য এবার কোন বিধিনিষেধ নেই। তাই বেশ ভাল বিক্রি হচ্ছে।"

টুয়েলভ লাইফ স্টাইলের চিফ অপারেটিং অফিসার মতিউর রহমান টিবিএসকে বলেন, "গত তিন বছরের মধ্যে এবার আমরা ফাল্গুনে ভাল বিক্রি করেছি। আমাদের বিক্রির গ্রোথ ৪০ শতাংশ। আশা করছি এই ঈদে আরও ভাল বিক্রি হবে।"

ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর বড় প্রস্তুতি

পহেলা বৈশাখ ও ঈদকে কেন্দ্র করে বছরজুড়েই প্রস্তুতি নেন বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসের উদ্যোক্তারা। দেশীদশ, ইয়েলো, সেইলর, জেন্টলপার্ক, এপেক্স, বাটা, ইনফিনিটিসহ দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলোর বিক্রির বড় অংশই হয় এ সময়। আগের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এবং মানুষের চাহিদার বিবেচনায় এবার সবারই বড় প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা।

দেশীদশের অন্যতম ব্র্যান্ড কে-ক্রাফট। প্রতিষ্ঠানটির সারাদেশের ২৫টি শো-রুম এখন ঈদ কালেকশনে ভরপুর। ঈদ উপলক্ষে এবার অন্তত ৫০০ ডিজাইনের পোশাক এনেছে তারা। 

কে-ক্রাফটের বসুন্ধরা শাখার ম্যানেজার শাহজাহান ফিরোজ দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, "এবার কালেকশন অন্যবারের চেয়ে বেশি।"

স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি প্রস্তুতি নিয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড ইয়েলো। ইয়েলোর হেড অব রিটেইল অপারেশনস হাদি চৌধুরী বলেন, "করোনার কারণে মানুষ গত দুই বছর পোশাক-আশাক সেভাবে ক্রয় করেনি। তাই এবার প্রত্যাশা বেশি। আমাদের প্রস্তুতিও যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।"

লোকাল ব্র্যান্ডের অন্যতম রঙ বাংলাদেশের এলিফ্যান্ড রোড শাখার প্রধান মনিরুল হক পারভেজ বলেন, "ঈদ ও নববর্ষ উপলক্ষে আমাদের অন্তত ৭০০-৭৫০ আইটেমের নতুন পোশাক এসেছে।"

আড়ংয়ের ই-কমার্স ও বিপণন বিভাগের উপ-মহাব্যবস্থাপক তানভীর হোসাইন টিবিএসকে জানান, তাদের প্রায় এক হাজার কোটির বাৎসরিক টার্নওভারের ৪০ শতাংশের ওপর আসে বাংলা নববর্ষ এবং ঈদ-উল-ফিতরের সময়। 

"আমরা এই সময়ের জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত। এখন পর্যন্ত আমাদের বিক্রি যথেষ্ট ভালো," যোগ করেন তানভীর।

দুই বছর পর লোকসান কাটানোর আশা তাঁতীদের

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে দুই যুগ ধরে দেশীয় বাটিকের পোশাক উৎপাদন ও বিপণন করছেন মো. বাচ্চু মিয়া। ২০২০ সালের ঈদে প্রায় ১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে লোকসান করেছেন মারিয়া বাটিক হাউজের স্বত্বাধিকারী এ উদ্যোক্তা। 

গত বছরও একই রকম লোকসানে পড়তে হয়েছে তাকে। তবে ব্যাংক ঋণ করে এবার ফের বিনিয়োগ করে সফল তিনি।

মো. বাচ্চু মিয়া বলেন, "কিছু ব্যাংক ঋণ ও ধার দেনা করে এবার প্রথমে ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছি। প্রথম দিকের পণ্য সব বিক্রি করে ওই টাকা আবার বিনিয়োগ করেছি। বিপুল চাহিদাও রয়েছে।"

মারিয়া বাটিক হাউজের মতোই অবস্থা আড়াইহাজারের ৮-১০ হাজার উদ্যোক্তার। সবার ব্যবসাই এবার রমরমা।

সারাদেশে বিক্রিত স্থানীয় পোশাকের ৭০-৮০ শতাংশের যোগান দেয় ঢাকার কেরানীগঞ্জসহ বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী এলাকার উৎপাদকরা। নিম্ন ও মধ্যবিত্তের পোশাক উৎপাদনের কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিচিত কেরানীগঞ্জের ব্যবসায়ীদের উৎপাদিত পোশাকের ৭০ শতাংশ বিক্রি হয় ঈদ-উল-ফিতরে।

কেরানীগঞ্জ জেলা পরিষদ মার্কেটে নিজের কারখানার জিন্স প্যান্ট পাইকারি বিক্রি করেন গোলেনুর গার্মেন্টসের মালিক মুক্তার দেওয়ান। ২০১৯ সালের ঈদে আড়াই কোটি টাকার জিন্স প্যান্ট বিক্রি করলেও গত বছর তা ৫০ লাখও ছাড়ায়নি। তবে এ বছর ৩ কোটি টাকার বেশি বিক্রির আশা করছেন তিনি। 

মোক্তার দেওয়ান দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, "দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খুচরা বিক্রেতারা এসে পোশাক কিনছেন। এ বছর এখন পর্যন্ত ২ কোটি টাকার পোশাক বিক্রি হয়েছে। ২০ রোজা পর্যন্ত ৩ কোটি টাকা ছাড়াবে।"

ঢাকার বাইরে মিশ্র গতি বিকিকিনির

সিলেটে জমে উঠতে শুরু করেছে ঈদের বাজার। মধ্যরাত পর্যন্ত বিপণিবিতান ও ফ্যাশন হাউসগুলোতে ভিড় লেগে থাকছে। তবে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এখন ক্রেতার চেয়ে দর্শনার্থীই বেশি।

সিলেটের সিটি হার্ট শপিংমলের অনন্যা ফ্যাশনের স্বত্বাধিকারী আশরাফুল ইসলাম বলেন, "মার্কেটে ক্রেতারা আসতে শুরু করেছেন। তবে এখন কেনার চাইতে দেখছেন বেশি। আরও কিছুদিন পর থেকে ঈদের বাজার পুরো জমে উঠবে।"

প্রবাসী-নির্ভর সিলেটে ঈদের বাজার অনেকটাই প্রবাসীদের উপর নির্ভরশীল জানিয়ে সিলেট মহানগর ব্যবসায়ী পরিষদের সভাপতি আব্দুর রহমান রিপন বলেন, "এইবার করোনার ঝামেলা নেই। ফলে অনেক প্রবাসী দেশে আসছেন। রেমিটেন্সের প্রবাহও ভালো। তাই আশা করছি এবার ভালো ব্যবসা হবে।"

কুমিল্লা ইস্টার্ন প্লাজায় তিন শতাধিক ফ্যাশন হাউজ রয়েছে। এই মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম।

তিনি বলেন, "সব দোকানেই বিক্রি আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ঈদ উপলক্ষে এবার এই মার্কেটে একশ কোটি টাকার বেশি পণ্য বিক্রি হতে পারে।"

বগুড়ার জলেশ্বরীতলাকে অভিজাত শপিং এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই এলাকায় দেশের নামী-দামি সব ব্র্যান্ডের কাপড় পাওয়া যায়। ফড়িং গার্মেন্টসের ম্যানেজার হাবিব বলেন, "এবার ঈদে পাঞ্জাবির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তবে বেশি দামের পাঞ্জাবি কম বিক্রি হচ্ছে।"

রাজশাহী নগরীর সাহেব বাজার জিরোপয়েন্টের নিউ প্রজাপতি কালেশনের বিক্রেতা সাদেকুল ইসলাম অনি জানান, শুক্রবার থেকে তাদের বেচাবিক্রি একটু ভালো হচ্ছে।

তিনি বলেন, "দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে এখনো ঠিক সেভাবে বেচাবিক্রি জমে ওঠেনি। বেতন, বোনাস পাওয়ার পর হয়তোবা বেচাবিক্রি জমবে।"

নগরের হাসান মার্কেটের সোহাগ বস্ত্র বিতানের স্বত্বাধিকারী সাইফুল ইসলাম বলেন, "আমাদের ক্রেতা মূলত গ্রামের মানুষ। গ্রামে এখন ধান কাটার মৌসুম। ফলে তারা এখনও কেনাকাটায় আসেননি।"

গত শনিবার যশোরের কাপুড়িয়াপট্টি, এইচ এমএম রোড, মুজিব সড়ক, কালেক্টরেট মসজিদ মার্কেট, পৌর হকার্স মার্কেট ঘুরে দেখা মেলে ঈদের আবহ। শহরের ছিটকাপড় ও টেইলার্স ঘুরে দেখা গেছে, কাপড় তৈরি কারিগরদের এখন দম ফেলার ফুরসত নেই।

তবে শপিংমলগুলোতে এখনও তেমন বিক্রি শুরু হয়নি। সিটিপ্লাজা শপিং কমপ্লেক্সের দোকানি সুজন জানান, এখনও তাদের বিক্রি জমে উঠেনি। 

তিনি বলেন, "এখন প্রতিদিন ২০-৩০ হাজার টাকার মতো বিক্রি হচ্ছে। আশা করছি ২০ রোজা থেকে জমে উঠবে বিক্রি।"   

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.