বিরাট অংকের ঋণের বোঝা নিয়ে চলছে চট্টগ্রাম ওয়াসা  

অর্থনীতি

06 April, 2022, 09:50 am
Last modified: 06 April, 2022, 09:54 am
বিদেশি তিন সংস্থা থেকে চার প্রকল্প বাস্তবায়নে ৬ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদী এসব ঋণের জন্য প্রায় ৬২৮ কোটি সুদ পরিশোধ করতে হবে সংস্থাটিকে।

চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষের (ওয়াসা) কাঁধে ঋণের বোঝা। গত এক যুগে পানির সরবরাহ বাড়াতে প্রায় ৯ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছিল সংস্থাটি। এসব প্রকল্পের বড় অংশের অর্থায়ন হয়েছে বিভিন্ন সংস্থার ঋণে। বিদেশি তিন সংস্থা থেকে চার প্রকল্প বাস্তবায়নে ৬ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদী এসব ঋণের জন্য প্রায় ৬২৮ কোটি সুদ পরিশোধ করতে হবে সংস্থাটিকে। চলতি বছর থেকে ঋণের অর্থ পরিশোধের জন্য কিস্তি শুরুর কথা রয়েছে। ফলে ঋণের চাপে পড়তে যাচ্ছে সংস্থাটি। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, সরকারের সঙ্গে আরেকটি ঋণচুক্তি করেই এর সমাধান টানা হচ্ছে। তবুও সংস্থাটির রাজস্ব বৃদ্ধি না করলে সামনে কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

চারটি প্রকল্পের মধ্যে দুটির কাজ সমাপ্ত হয়েছে। বাকি দুটি চলমান। এরমধ্যে কর্ণফুলি পানি সরবরাহ প্রকল্প (২য় পর্যায়) হলো চট্টগ্রাম ওয়াসার সবচেয়ে বড় প্রকল্প। প্রায় ৪ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির অধীনে পানি শোধনাগার, ইনটেক স্টেশন, জলাধার, ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন পাইপলাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০১৩ সাল থেকে শুরু হওয়া এই প্রকল্পটির কাজ ২০২৩ সালে সমাপ্ত হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে দাতা সংস্থা জাইকা ২ হাজার ৮৯২ কোটি ৫০ লাখ টাকা, সরকার ১ হাজার ৬৬৫ কোটি ১৬ লাখ ১০ হাজার টাকা এবং চট্টগ্রাম ওয়াসা ২৩ কোটি ৭ লাখ টাকা অর্থায়ন করছে। ঋণদাতা সংস্থা জাইকাকে ০.০১% হারে ৪০ বছরে মোট ৪ কোটি ৬০ লাখ ৪৩ হাজার টাকা সুদ দিতে হবে। ২০৫১ সালের মধ্যে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। চুক্তি অনুযায়ী, ২০২৩ সাল থেকে বাৎসরিক প্রায় ৯৩ কোটি টাকার কিস্তি প্রদান করতে হবে।

চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন ও স্যানিটেশন প্রকল্পটির (সিডব্লিউএসআইএসপি) মোট ১ হাজার ৫৩৯ কোটি ৬৮ লাখ ২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। শুরুর দিকে ব্যয় বেশি ধরা হলেও প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয় কম হয়েছে। প্রকল্পটির অধীনে পানি শোধনাগার ও বুস্টার স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। ২০১১ সালে শুরু হয়ে প্রকল্পটির কাজ শেষ হয়েছে ২০২১ সালের জুনে। প্রকল্পটির বাস্তবায়নের জন্য দুই ধাপে বিশ্বব্যাংক থেকে প্রায় ১ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। ২০৫৪ সালের মধ্যে ১ শতাংশ হারে মোট ৩৪৫ কোটি ২০ লাখ ৬৫ লাখ টাকা সুদসহ এই ঋণের অর্থ ফেরত দিতে হবে। চুক্তি অনুযায়ী, চলতি বছর থেকে সুদসহ প্রায় ৪৩ কোটি টাকার কিস্তি প্রদানের কথা রয়েছে। তবে এটিও পেছানো হচ্ছে।

প্রায় ১ হাজার ৯৯৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ভান্ডাল-জুড়ির পানি সরবরাহ প্রকল্পের অধীনে কর্ণফুলি নদীর তীরে পানি শোধনাগার ও বিতরণ পাইপলাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০১৫ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটির কাজ চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে সমাপ্ত হওয়ার কথা রয়েছে। প্রকল্পটির বাস্তবায়নে ঋণদাতা সংস্থা কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংক ১ হাজার ২২৪ কোটি টাকা, সরকার ৭৫০ কোটি ১৪ লাখ ৩৭ হাজার টাকা এবং চট্টগ্রাম ওয়াসা ২০ লাখ টাকা অর্থায়ন করছে। ২০৫৪ সালের মধ্যে মোট ১ কোটি ৫৯ লাখ ১২ টাকা সুদসদ ঋণ পরিশোধ করতে হবে। চুক্তি অনুযায়ী, ২০৩০ সাল থেকে বছরে প্রায় ৪৯ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে।

কর্ণফুলি পানি সরবরাহ প্রকল্পের (প্রথম পর্যায়) কাজ ২০১৬ সালের জুনে শেষ হয়েছে। প্রকল্পটির মোট ব্যয় ১ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকার মধ্যে জাইকা ৭৭৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা অর্থায়ন করেছে। প্রকল্পটির অধীনে পানি শোধনাগার, ট্রান্সমিশন, ট্রান্সমিশন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। ১ শতাংশ হারে মোট ২২৭ কোটি ৭৪ লাখ টাকা সুদ দিতে হবে ঋণ দাতা সংস্থাটিকে। চুক্তি অনুযায়ী, ২০২৩ সাল থেকে প্রায় ৯৬ কোটি টাকা কিস্তি দিতে হবে।

চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, দাতাসংস্থা থেকে ঋণ নিয়েই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হয়েছে। পানি সরবরাহের সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। আমাদের নিজেদের আয়ের উপর নির্ভর করতে হয়। সরকার থেকে কোন ভর্তুকি পাই না। তাই আয় বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে।

বর্তমানে চট্টগ্রাম ওয়াসার আয়-ব্যয় প্রায় সমান। বছরে সংস্থাটির আয় ১৭০ থেকে ১৮০ কোটি টাকা। আর ব্যয় ১৬০ থেকে ১৭০ কোটি টাকা। ২০২০ সালে ১৭৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা আয় হয়েছে সংস্থাটি। আর ব্যয় ছিল ১৬৫ কোটি টাকা। ২০২১ সালে ২১৪ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হলেও ১৮০ কোটির ঘর পার হতে পারেনি সংস্থাটি। পানি সরবরাহ, নলকূপের লাইনেন্স, এফডিআরের সুদ ছাড়া তেমন কোন আয়ের উৎস নেই চট্টগ্রাম ওয়াসার। এর বাইরে পানির মূ্ল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে আয় বাড়াতে পারে সংস্থাটি। এ নিয়েও অসন্তোষ রয়েছে। সর্বশেষ গত বছরের নভেম্বরে মূল্য বৃদ্ধি করে আবসিক সংযোগে প্রতি ইউনিট (এক হাজার লিটার) পানির মূল্য ১৩ টাকা ২ পয়সা এবং বাণিজ্যিকে ৩১ টাকা ৮২ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, বছরে ৫ শতাংশ হারের বেশি পানির মূল্য বাড়াতে পারবে না সংস্থাটি। ফলে আয়-ব্যয় সমান নিয়ে ঋণের চাপে পড়ছে সংস্থাটি। অপরদিকে উৎপাদিত ২৮-৩০ শতাংশ পানি সিস্টেম লস হিসেবে অ-রাজস্বভুক্ত পানি দেখানো হয়। হিসেবে প্রায় ৫০ কোটি টাকা অপচয় হয় এ খাতে।

সংস্থাটির প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, চট্টগ্রাম ওয়াসা সেবাপ্রদানকারী সংস্থা। পানির চাহিদা মেটাতে প্রকল্পগুলো হাতে নেওয়া হয়েছে। সবগুলো প্রকল্পের কাজ শেষ হলে পানির সরবরাহ বাড়াবে। তখন আয়ও বাড়বে। এছাড়া অ-রাজস্বভুক্ত পানির হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে আমরা আধুনিক পাইপলাইন নেটওয়ার্ক স্থাপন করছি। স্মার্ট মিটার বসানো হচ্ছে। এছাড়া আমাদের কার্যালয়ে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এসব খাত থেকে আয় বাড়ানোর প্রচেষ্টা চলছে।

তিনি আরো বলেন, দাতা সংস্থার ঋণগুলো আমাদের হয়ে সরকার পরিশোধ করবে। আমরা আবার ১ শতাংশ হারে সুদে সরকারকে পরিশোধ করবো ধীরে ধীরে। এজন্য সরকারের সঙ্গে সাবসিডিয়ারি লোন এগিমেন্ট (এসএলএ) চুক্তি করা হয়েছে। সক্ষমতা অনুসারে সরকারকে ঋণ পরিশোধ করা হবে। চলতি বছর থেকে ৮-১০ কোটি টাকা করে পরিশোধ করা হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই টাকার পরিমাণ বাড়ানো হবে। 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.