রাশিয়ায় পোশাক রপ্তানি: চালান পাঠানো ও মূল্য পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা

অর্থনীতি

02 March, 2022, 07:35 pm
Last modified: 02 March, 2022, 09:07 pm
বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় শতাধিক পোশাক প্রস্তুতকারক রাশিয়াতে সরাসরি বা তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমে পোশাকপণ্য সরবরাহ করছে।

শিপিং লাইনগুলো মস্কোমুখী সকল কন্টেইনার পরিবহনের বুকিং বাতিল করায় এবং পশ্চিমা দেশগুলোর আর্থিক নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার বাজারের কার্যাদেশ নিয়ে এখন উদ্বিগ্ন বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকরা। অথচ প্রাক অথবা উৎপাদন পরবর্তী প্রক্রিয়ায় রয়েছে কার্যাদেশের পোশাক। 

কৃষ্ণ সাগরের জলপথে রাশিয়ান জাহাজ চলাচল বন্ধ করা হয়েছে, ইউরোপিয় ইউনিয়নও তাদের আকাশসীমা দেশটির জন্য বন্ধ করায়- উৎপাদন শেষ হওয়ার পরও পোশাকপণ্যের চালান পৌঁছানো দৃশ্যত সম্ভব নয়। রাশিয়ান ক্রেতাদের আশ্বাস সত্ত্বেও চালানের মূল্য পাওয়ার (পেমেন্ট) বিষয়েও অনিশ্চয়তায় ভুগছেন পোশাক প্রস্তুতকারকরা। 

এছাড়া, আন্তর্জাতিক পেমেন্ট ব্যবস্থা সুইফট থেকে রাশিয়ার সব ব্যাংকের বাদ পড়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এর ফলেও বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের জন্য পণ্যের মূল্য পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। 

এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সমিতি (বিজিএমইএ) রপ্তানিকারক কারখানা মালিকদের রাশিয়ান বাজার থেকে কোনো কার্যাদেশ না নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় শতাধিক পোশাক প্রস্তুতকারক রাশিয়াতে সরাসরি বা তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমে পোশাকপণ্য সরবরাহ করছে।

যেমন রয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় পোশাক রপ্তানিকারক রেনেসাঁস গ্রুপ। তাদের হাতে রাশিয়ার বাজারের ১৫ মিলিয়ন ডলারের কার্যাদেশ রয়েছে। এরমধ্য কিছু পণ্য উৎপাদন পর্যায়ে রয়েছে, আরও রয়েছে ইনভেন্টরি বা মজুদ। 

প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক সাইফুল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "গত কয়েক বছর ধরেই আমরা রাশিয়ার সাথে ব্যবসা করছি। দেশটিতে আমাদের বার্ষিক রপ্তানি প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডলার।"

তিনি জানান, কিছু পোশাক পণ্যের উৎপাদন প্রক্রিয়া নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই শেষ হবে। তাদের কাছে পণ্য (প্রস্তুত উপকরণের) বড় ইনভেন্টরিও আছে, যা তারা আপাতত অব্যবহৃত রাখবেন।  

সাইফুল আলম আরও বলেছেন, আন্তর্জাতিক দুটি কুরিয়ার সার্ভিস প্রোভাইডার- ডিএইচএল আর ফেডএক্স ইতোমধ্যেই আমাদের জানিয়েছে তারা রাশিয়াগামী কোনো পার্সেল গ্রহণ করবে না। জাহাজে পণ্য পরিবাহী একটি সংস্থা- ওরিয়েন্ট ওভারসীজ শিপিং লাইনও এ গন্তব্যের জন্য কোনো পণ্য চালান বহনে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

বিজিএমইএ ভাইস প্রেসিডেন্ট শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, "এরমধ্যেই রাশিয়ান ক্রেতাদের কাছে যেসব পণ্যের চালান পাঠানো হয়েছে তার পেমেণ্ট পাওয়া নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। কারণ রাশিয়ান ব্যাংকগুলো সুইফট থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চলেছে, অথচ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সব রকমের মূল্য গ্রহণ/ পরিশোধের (পেমেন্টে) লেনদেনে সুইফটের অনুমোদন দরকার হয়।"

একইসাথে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা রাশিয়ান কোম্পানিগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। 

শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, বিজিএমইএ নিজ সদস্যদের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার এবং নতুন কোনো কার্যাদেশ না নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেছেন, তারাও তাদের সদস্যদের রাশিয়ান ক্রেতাদের থেকে সরাসরি অর্ডার না নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

রাশিয়ার পোশাক আমদানির প্রায় ৮০ শতাংশ তৃতীয় দেশের মাধ্যমে হয়। এদেশের যেসব ব্যবসায়ী এভাবে রপ্তানি করছেন তারা অর্ডার নেওয়া চালিয়ে যেতে পারেন, বলেও যোগ করেন তিনি।

তিনি উল্লেখ করেন, তার ঘনিষ্ঠ একজন রপ্তানিকারক তুরস্ক হয়ে রাশিয়ায় প্রায় ২০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছেন। চালান পৌঁছানোর পর তিনি ইতোমধ্যে পণ্যের মূল্যও পেয়ে গেছেন। ওই রপ্তানিকারকের কাছে এখনও উৎপাদন প্রক্রিয়ায় রয়েছে আরও ২০ লাখ ডলারের পণ্য। 

বিকেএমইএর সহ-সভাপতি ফজলি শামীম এহসান মনে করেন, রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে সুইফট থেকে সরিয়ে দিলে তারা বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজে নিতে পারে। 
আরেক পোশাক রপ্তানিকারক চট্টগ্রাম-ভিত্তিক ফোরএইচ গ্রুপের পরিচালক কামরুল হুদা জানান, তারা শিশুদের জন্য ১০ লাখ ডলার মূল্যের টি-শার্ট (রাশিয়ায়) রপ্তানি করেছেন। এছাড়া ৫০ লাখ ডলার মূল্যের অন্যান্য পোশাকপণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় রয়েছে।  

তার কোম্পানি বর্তমানে ইতালির মাধ্যমে রাশিয়ার সাথে ব্যবসা করছে; জাহাজে রাশিয়ায় পণ্য পাঠিয়ে তার মূল্য পায় ইতালি থেকে। 

"আমরা আমাদের বায়ারদের সাথে যোগাযোগ করেছি। এই যুদ্ধের (ইউক্রেন) কারণে আমরা কোনো সমস্যায় পড়ব না বলে তারা আশ্বস্ত করেছে"- যোগ করেন কামরুল হুদা। 

শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, "আমাদের পোশাক রপ্তানিকারকদের জন্য রাশিয়া একটি উদীয়মান বাজার। এ বাজারে সম্প্রসারণের লক্ষ্য চলতি বছর আমরা একটি রোড শো আয়োজনের পরিকল্পনা করেছিলাম, সেটাও এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়ল।"

শাশা ডেনিম মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শামস মাহমুদ বলেছেন, স্বল্পমেয়াদে বাংলাদেশ থেকে (রাশিয়ায়) আরএমজি রপ্তানি প্রভাবিত হতে পারে। তবে সামগ্রিকভাবে এটি সমস্যা হবে না—কারণ বায়াররা ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতার কাছাকাছি একটি নির্দিষ্ট পয়েন্টে পণ্য বিক্রি করতে চাইবে। সেজন্য তারা তাদের উৎপাদন খরচও কমাবে। 

প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে বিশ্বমানের পোশাক পণ্যের সোর্সিংয়ের জন্য বাংলাদেশ বিদেশি ক্রেতাদের কাছে একটি আদর্শ গন্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। 

শামস মাহমুদ বলেন, "মহামারি চলাকালে আমরা দেখেছি বাংলাদেশে অর্ডারের প্রবাহ আসলে বেড়েছে। সুতরাং, দীর্ঘমেয়াদে নিম্নমুখী হওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার কোন কারণ নেই।"

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ ২০২০-২০২১ অর্থবছরে রাশিয়ায় ৬৬৫.৩২ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি করেছে, যার মধ্যে ৬০৭ মিলিয়ন ডলার এসেছে পোশাক ও টেক্সটাইল রপ্তানি থেকে।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.