দুবাইয়ের রিয়েল এস্টেট খাতে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করেছে বাংলাদেশিরা

অর্থনীতি

09 February, 2022, 12:45 am
Last modified: 09 February, 2022, 10:20 pm
বিনিয়োগের পরিমাণ ১২৩ মিলিয়ন দিরহাম বা প্রায় ২৮৮ কোটি টাকা। কিন্তু পারস্য উপসাগরীয় ধনাঢ্যদের শহরে এই অর্থ আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে যায়নি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এর সিংহভাগই পাচার করা- কালোটাকা।

 

কোভিড মহামারির ১৮ মাসে দুবাইতে রিয়েল-এস্টেট এবং আবাসনে বিনিয়োগের শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশি নাগরিকরা। যদিও দুবাই বিলাসবহুল শপিংমল, অতি-আধুনিক স্থাপত্য এবং প্রাণবন্ত নৈশকালীন আমোদ-প্রমোদের শহর হিসেবেই পরিচিত। এদেশের নাগরিকদের বিনিয়োগের তথ্য দুবাইয়ের সরকারি নথি এবং সেই সূত্রে প্রকাশিত স্থানীয় সংবাদপত্রের র‍্যাঙ্কিং- এর বরাতেই জানা গেছে।

বিনিয়োগের পরিমাণ ১২৩ মিলিয়ন দিরহাম বা প্রায় ২৮৮ কোটি টাকা। কিন্তু পারস্য উপসাগরীয় ধনাঢ্যদের শহরে এই অর্থ আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে যায়নি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এর সিংহভাগই পাচার করা- কালোটাকা।

তাদের মতে, কালোটাকার উপর প্রকাশিত এ র‍্যাঙ্কিং বিশেষ কিছু বিষয়ের প্রতীক: যেমন মহামারির অভিঘাতের মধ্যেও বাংলাদেশের অনেক ব্যক্তির হাতে ছিল বিপুল টাকা- যা তারা বাংলাদেশে রাখা নিরাপদ মনে করেননি। তাই দুবাইয়ে সেকেন্ড হোম থাকলে বিতর্কিত অতীত ফেলে সেখানে নিরাপদ নতুন বিলাসী জীবন শুরু করা যাবে। দুবাইয়ের বিদেশি বিনিয়োগ গোপনীয় রাখার নীতি এবং সহজ আবাসনের সুবিধাও তাদের চিন্তাভাবনার সাথে মিলে যায়। ফলে দুবাই তাদের সম্ভাব্য গন্তব্যের সাথে মিলে গেছে । 

দুবাইয়ের বাংলাদেশি কমিউনিটি সূত্র জানিয়েছে এসব ক্রেতারা হলেন- বাংলাদেশি ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও আমলা।

প্রায় একই ধরনের কারণে এবং কালোটাকা সুরক্ষার আইনি ঢাল- কানাডার টরন্টোতে কুখ্যাত "বেগম পাড়া"র জন্ম দিয়েছে- যা কিনা অনেক বাংলাদেশি নাগরিক এবং তাদের পরিবারের পাচারকৃত অর্থের নিরাপদ আবাস। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন গত বছর এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, তিনি বেগমপাড়ায় সম্পত্তি থাকার ২৮টি ঘটনার তালিকা পেয়েছেন। এরপর হাইকোর্ট কর্তৃপক্ষের কাছে এসব ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তালিকা দিতে বলে।

কানাডা সরকারের তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে ৩ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি সেদেশে বসবাসের অনুমতি পেয়েছে। যেখানে ২০০৬-২০২০ সালে কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি পেয়েছে ৪৫ হাজার বাংলাদেশি।  

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, হাইকোর্ট, দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এবং অন্যান্য সরকারি সংস্থার বেশ কিছু উদ্যোগ কানাডায় কালোটাকা ও অস্বচ্ছ বিনিয়োগকে কঠিন করেছে। অন্যদিকে, যারা নিজেদের আর্থিক বিবরণ গোপন রাখতে চান দুবাইয়ের সহজ আবাসন নীতি এমন ধনীদের আকর্ষণ করেছে। 

দুবাই ভূমি বিভাগের তথ্য উল্লেখ করে, দুবাইয়ের দুটি সংবাদপত্র - ইংরেজি ভাষার টেলার রিপোর্ট এবং আরবি ভাষার ইমারাত আল ইউম - সম্প্রতি একই শিরোনাম দিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সোজাসাপ্টা শিরোনামটির বাংলা করলে দাঁড়ায়- 'বাংলাদেশের ধনী ব্যক্তিরা দুবাইয়ে ১২৩ মিলিয়ন দিরহাম মূল্যের রিয়েল এস্টেট কিনেছে'।

ধনী দেশ বলে পরিচিত নেদারল্যান্ডের নাগরিকরাও এক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের কাছে হার মেনে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন। তারা কিনেছেন ১১৭.৬৭ মিলিয়ন দিরহামের সম্পত্তি। ১১১.২৫ মিলিয়ন দিরহামের বিনিয়োগ করে তৃতীয় স্থানে রয়েছেন সুইজারল্যান্ডের নাগরিকরা। 

এছাড়া, চীনের নাগরিকরা ১০৭.৯ এবং জার্মানির নাগরিকরা ১০৫ মিলিয়ন দিরহামের সম্পত্তি কিনে যথাক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে রয়েছেন। 

তবে গণমাধ্যম প্রতিবেদনে যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করেছে- তাদের নাম জানানো হয়নি। দুবাই ভূমি বিভাগের তথ্যও বাংলাদেশী ক্রেতাদের পরিচয় জানায়নি।

তারা মেরিন ভিউ ভালোবাসেন: 

দুবাইয়ে বাংলাদেশি কমিউনিটির নেতা ইঞ্জিনিয়ার আবুল আসাদ টিবিএসকে বলেন, বেশিরভাগ জৌলুষপূর্ণ অ্যাপার্টমেন্ট কেনা হয়েছে দুবাইয়ের কেন্দ্রে বা ডাউনটাউন দুবাইয়ে। এখানে বিভিন্ন দামের অ্যাপার্টমেন্ট কেনার সুবিধা থাকাই যার অন্যতম কারণ। তাছাড়া এই ডাউনটাউন দুবাইয়ে রয়েছে বুর্জ খলিফা, দ্য দুবাই মল এবং ড্যান্সিং ফাউন্টেইনস- সহ বিশ্বখ্যাত অনেক আকর্ষণীয় স্থাপনা এবং সমুদ্রের মনোরোম দৃশ্য।

তাদের পছন্দের তালিকায় দ্বিতীয়-দুবাই স্পোর্টস সিটি। যেখানে জীবনযাপন যথেষ্ট পরিমাণে বিলাসী ও ব্যয়বহুল। আবুল আসাদ জানান,  গত দশ বছরে এখানে বেশকিছু বাংলাদেশি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছে।

এছাড়া বাংলাদেশিরা স্থায়ীভাবে বসবাস ও অবকাশযাপনের জন্য দুবাই মেরিনা, জুমেইরাহ বিচ রেসিডেন্স এবং জুমেইরাহ লেক টাওয়ারে ফ্ল্যাট কিনেছেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

এ বিষয়ে ইমিগ্রেশন ও কোম্পানির আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি বলেন, "এছাড়াও দুবাইয়ে কেউ আবাসনের জন্য এক কোটি টাকার বিনিয়োগ করলেই ১০ বছর বসবাসের জন্য গোল্ডেন ভিসা পেয়ে যায় সহজে। ফলে কিছু বাংলাদেশি এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে।"

ক্রেতা যারা: 

আবুধাবিতে বাংলাদেশি ব্যবসায়ী কমিউনিটির একজন ব্যবসায়ী নেতা জানান, আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবিতে প্রায় ২০টি বাংলাদেশি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথভাবে ব্যবসা করছে। এছাড়াও আরও প্রায় ৩০টি বাংলাদেশি এজেন্ট রয়েছে, যারা সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশিদের জমি ও অ্যাপার্টমেন্ট কেনায় সহায়তা করে ।

এবিষয়ে মন্তব্য জানতে আবুধাবি ভিত্তিক একটি আবাসন কোম্পানি রিচ হোম রিয়েল এস্টেট-এর জ্যেষ্ঠ প্রপার্টি কনসালটেন্ট তানভীর নাসিরের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। কিন্তু, তিনি এতে অসম্মতি জানান। 

তবে ওই প্রতিষ্ঠানের আরেকজন কর্মকর্তা জানান, সেখানে অবিস্থত বাংলাদেশি তিনটি এজেন্সির মাধ্যমে ২০২১ সালে ৭৭টি এপার্টমেন্ট ক্রয় করেছে বাংলাদেশি ক্রেতারা। এছাড়াও, ওই তিনটি প্রতিষ্ঠান ১১টি আবাসিক ভবন কেনায় মধ্যস্ততা করেছে। তবে কত টাকা বিনিয়োগ হয়েছে, সে বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি ওই কর্মকর্তা।

ক্রেতাদের বেশরিভাগ ছিলেন ব্যবসায়ী, রাজনীতিবীদ ও আমলা। গত কয়েক বছরের তুলনায় ২০২০ ও ২০২১ সালে বেশি বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন তারা। দুবাই প্রবাসীরাও কিনেছেন, তবে সেই সংখ্যা খুবই কম বলে উল্লেখ করেন তিনি। 

অন্ধকারে বাংলাদেশ ব্যাংক: 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সদ্য সাবেক প্রধান  আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান টিবিএসকে বলেন,  গত কয়েক বছরে দেশের কিছু ব্যক্তি ও বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ দুবাইয়ে বড় বিনিয়োগ করেছে। সেগুলো ছিল ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য অফিস স্থাপনের মতো উদ্যোগ, টাকা গেছে বৈধ চ্যানেলে। 

"কিন্তু সেখানে আবাসন খাতে বিনিয়োগ করতে বাংলাদেশ বাংকে উল্লেখযোগ্য কোনো আবেদনের বিষয়ে আমার জানা নেই"- বলে মন্তব্য করেন তিনি। 

অবশ্য বিএফআইইউ-এর বর্তমান প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাস বলেছেন, দুদক বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো সাহায্য চাইলে তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। 

বিস্ময়কর:

বাংলাদেশ থেকে এত পরিমাণ বিনিয়োগ দুবাইয়ে—বিষয়টি জেনে বিস্ময় প্রকাশ করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, "ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্যে বিদেশে বিনিয়োগ করার জন্য সরকার সম্প্রতি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। কিন্তু ২০২০-২১ মেয়াদে যেসময় এই বিনিয়োগ করা হয়েছে, তা কোনো আইন মেনে করা হয়নি। আমি মোটামুটি নিশ্চিত, পাচার হওয়া টাকাই বিনিয়োগ করেছে বাংলাদেশিরা।"

তিনি আরও বলেন, টাকা পাচার করে দুবাইয়ে যারা সম্পত্তি কিনেছে বাংলাদেশ সরকারের উচিত তাদের খুঁজে বের করা। দুবাইয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনকে এবিষয়ে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে বলে পরামর্শ দেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক। 

এছাড়াও, তাদের শনাক্তে বিএফআইইউ'কে নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। 

  

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.