বাইক থেকে অলঙ্কার: যেকোনো পণ্য অনলাইনে বিক্রির জন্য ডিবিআইডি বাধ্যতামূলক

অর্থনীতি

টিবিএস রিপোর্ট
07 February, 2022, 01:00 pm
Last modified: 07 February, 2022, 01:27 pm
ই-কমার্সের ওপর গ্রাহকদের আস্থা ফিরিয়ে আনতেই এই পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।

অনিয়ম ঠেকাতে ও ই-কমার্স খাতের ওপর ভোক্তাদের আস্থা বাড়াতে সরকার ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের জন্য ডিজিটাল বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন (ডিবিআইডি) ইস্যু করতে শুরু করেছে।
    
গ্রাহকদের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা অগ্রিম নিয়ে আত্মসাৎ ও পাচারের ঘটনায় সম্ভাবনাময় ই-কমার্স খাতের বিকাশ যখন থমকে গেছে, ঠিক তখনই গ্রাহকদের আস্থা ফেরাতে রোববার এই উদ্যোগের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। 

যারা নিবন্ধন নেবে না, তারা ওয়েবসাইট, ফেসবুক কিংবা অন্য কোনো অ্যাপস ব্যবহার করে পণ্য বিক্রি করতে পারবে না বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

ই-কমার্স খাতের বড় ব্যবসায়ীরা এ উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও ঘরে বসে ফেসবুকের মাধ্যমে অল্প পুঁজিতে পণ্য বিক্রি করা অতিক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মধ্যে ভয় কাজ করছে। 

ফেসবুক ভিত্তিক পোশাক ব্র্যান্ড সুলতানা'স ড্রিমের মালিক ইরিত্রা মেহরিন বলেন, "নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে কঠোর আইনী বেড়াজালে আটকে ফেলা হলে কিংবা নিবন্ধিত ফেসবুকভিত্তিক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), ট্যাক্স আরোপ করা হলে তাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে।"

অবশ্য তিনি আরো বলেছেন, সরকারের এই ডিবিআইডি দেওয়ার উদ্যোগ ই-কমার্সের ওপর গ্রাহকদের আস্থা বাড়াতেও সহায়তা করবে।

অন্যদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছেন, ডিবিআইডি'র নিবন্ধনের সময়ই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ভ্যাট নিবন্ধন নম্বর বিজনেস আইডেনটিফিকেশন নম্বর (বিআইএন) ও কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু তারা সে প্রস্তাব রাখেনি। কারণ, এমন শর্তারোপ করা হলে ফেসবুককেন্দ্রিক ছোট উদ্যোক্তারা নিবন্ধন নেবে না। তাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে নিবন্ধন নিয়ে ডিবিআইডি পাওয়ার সঙ্গে কর-ভ্যাটের কোনো সম্পর্ক নেই।

"তবে ই-কমার্স ব্যবসা পরিচালনা করতে বিআইএন ও টিআইএন থাকতে হবে- এমন বিধান এনবিআরের আইনে রয়েছে। এনবিআর যদি ভবিষ্যতে নিবন্ধিত ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ভ্যাট-ট্যাক্স আদায়ের উদ্যোগ নেয়, সেক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু করার থাকবে না",  জানান মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব।

রোববার ডিবিআইডি উদ্বোধনকালে বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, "ই-কমার্স ব্যবসার নামে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রতারণা করলেও হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান ভালো ব্যবসা করছে। তারা যাতে আরও ভালোভাবে ব্যবসা করতে পারে, সেজন্যই ডিবিআইডি চালু করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সব ধরনের ই-কমার্সকে একটি প্লাটফর্মে নিয়ে আসা হচ্ছে।"

ডিবিআইডি চালু হলেও ফেসবুককেন্দ্রিক ই-কমার্স থেকে পণ্য কেনার সময় মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে ক্রেতাদের সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডাব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক মোঃ হাফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "ফেসবুকের ডিজিটাল ব্যবসায়ীরা সাধারণত নিজেদের বিকাশ, নগদসহ বিভিন্ন মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসের পারসোনাল অ্যাকাউন্টে ক্রেতাদের কাছ থেকে মূল্য আদায় করে।"

তিনি বলেন, "তাদেরকে পেমেন্ট গেটওয়ের আওতায় আনা কঠিন। তবে ইন্টার-অপারেটিবিলিটি চালু করার একটি পরিকল্পনা রয়েছে। এতেও সময় লাগবে। তাই অগ্রিম মূল্য পরিশোধে ক্রেতাদের অবশ্যই সচেতন হতে হবে।"  

হাফিজুর রহমান আরও জানান, নিবন্ধিত ব্যবসায়ীরা তাদের সাইটে বা ফেসবুক পেইজে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া ডিবিআইডি নম্বর আপলোড করে রাখবে। এতে ক্রেতারা বুঝতে পারবেন যে, কোম্পানিটি বা এই ফেসবুক পেইজ সরকারের মনিটরিং এর আওতায় রয়েছে। মূলত ই-কমার্স ব্যবসার প্রতি ক্রেতাদের আস্থা বাড়ানোর জন্যই এ নিবন্ধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বেসিসের সাবেক প্রেসিডেন্ট একেএম ফাহিম মসরুর টিবিএসেকে বলেন, "নিবন্ধন প্রক্রিয়া ফেসবুকের ব্যবসায়ীদের জন্য যেন কঠিন হয়ে না যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। আর ফেসবুক কেন্দ্রিক নিবন্ধিত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ভ্যাট-ট্যাক্সের আওতায় আনা হলে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে।"  

তিনি বলেন, "ফেসবুকভিত্তিক ই-কমার্স কোম্পানিগুলো যাতে ডিবিআইডি নিতে আগ্রহী হয়, সেজন্য তাদেরকে উৎসাহ দিতে হবে। যাদের ট্রেড লাইসেন্স বা অন্য কোন কাগজপত্র নেই, তারা যেন ডিবিআইডি দিয়ে ব্যাংক ঋণ পেতে পারেন, সে ব্যবস্থাও করতে হবে।"

প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ছোট ও নারী উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা করবে এই প্লাটফর্ম। এ ধরনের উদ্যোক্তারা যাতে টিআইএন, ট্রেড লাইসেন্স, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, ব্যাংক ঋণ পেতে সমস্যায় না পড়েন, সেজন্য একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করা হবে।

ডিবিআইডি অনলাইন প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী ও বিশ্বাসযোগ্য ভিত্তি দেবে বলে মনে করছেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকও।

ডিবিআইডি ছাড়া কেউ ই-কমার্স ব্যবসা করলে তাদের সাইট বা ফেসবুক পেইজ বন্ধ করার কথা বলেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে এটি করা খুবই কঠিন হবে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সে সক্ষমতা নেই। আর ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ই-কমার্সের নামে থাকা ১০ হাজার অভিযোগই দীর্ঘদিন ধরে নিষ্পত্তি করতে পারেনি। আবার, কার ডিবিআইডি রয়েছে, কার নেই- সেটি তদারকি করার দায়িত্ব পুলিশকে দেওয়াও সমীচীন হবে না।

ডিবিআইডি না নেওয়া ফেসবুক ভিত্তিক ই-কমার্স ব্যবসা কীভাবে বন্ধ করা হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, "আমরা একটি পরিপত্র জারি করবো, যেখানে ডিবিআইডি সনদ ফেসবুক বা ওয়েবসাইটের প্রতিটি পেইজে ব্যবহার করা বাধ্যতামুলক করা হবে। যাদের ডিবিআইডি থাকবে না, তাদেরকে অবৈধ ঘোষণা করে সেখান থেকে পণ্য না কিনতে ক্রেতাদের পরামর্শ দেওয়া হবে।"

যেভাবে নিবন্ধন করা যাবে

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন রেজিস্টার অফ জয়েন্ট স্টক কোম্পানির (আরজেএসসি) মাই গভ অ্যাপস-এর মাধ্যমে ই-কমার্স ব্যবসা পরিচালনার জন্য ডিজিটাল বিজনেস আইডি পাওয়া যাবে। সেখানে ফেসবুকভিত্তিক ই-কমার্স পরিচালনাকারীদের ইউআরএল, ফেসবুক আইডি, এনআইডির তথ্য, মোবাইল নম্বর, ইমেইল আইডিসহ বিভিন্ন তথ্য দিতে হবে।

এসব তথ্য অনলাইনে ভেরিফিকেশন করার পর আবেদনকারীর ইমেইলে সনদ পাঠানো হবে। আবেদনকারীর মোবাইলেও এসএমএস এবং কোড নম্বর যাবে, যা দিয়ে সনদ ডাউনলোড করতে হবে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ডিবিআইডি সনদ নেওয়ার জন্য অনলাইনে আবেদন করতে হবে। শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ও প্রতিষ্ঠানের নামসহ ঠিকানা ব্যবহার করে নিবন্ধন নেওয়া যাবে। এজন্য কোনো ফি পরিশোধ করতে হবে না। ঠিক তথ্য দিয়ে আবেদন করার পর আবেদনকারীর মেইলে ডিবিআইডি সনদ পাঠিয়ে দেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মোবাইল ফোনসহ অন্যান্য ডিভাইস থেকেও নিবন্ধন করা যাবে। আগামী এক বছরের মধ্যে সব ধরনের ডিজিটাল ব্যবসাকে নিবন্ধনের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের।

উদ্বোধনের দিন রোববার ১১টি প্রতিষ্ঠানকে আইডি দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হল- চালডাল লি., ডায়বেটিস স্টোর, রকমারি ডটকম, আজকের ডিল, সাজগোজ লি., যাচাই ডট কম, তৃনাস ক্লোসেট, নওরীনস মীরর, আখিস কালেকশন (ফেসবুক শপ), নিথান (ফেসবুক শপ), মম ফানুস (ফেসবুক শপ)।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.