বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন পেল চার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান
বেসরকারি খাতের চারটি প্রতিষ্ঠানকে বিদেশে ১০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মাধ্যমে বৈশ্বিক বাজারে দেশে উৎপাদিত পণ্য বিক্রির পথ সুগম হলো।
অনুমোদন পাওয়া কোম্পানিগুলোর একটি হলো স্কয়ার গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি ফিলিপাইনে ১০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। ফিলিপাইনের আমদানিনির্ভর ফার্মাসিউটিক্যালস বাজারের আকার প্রায় ৬ বিলিয়ন মার্কন ডলার, যা আসিয়ান অঞ্চলে তৃতীয় বৃহৎ ফার্মাসিউটিক্যালস বাজার। বিশাল এই বাজারে পা ফেলার সুযোগ খুলে গেল প্রতিষ্ঠানটির সামনে।
ফিলিপাইনের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে (এফডিএ) নিবন্ধন না করে কোনো কোম্পানি নিজস্ব ব্র্যান্ড নামে সে দেশে সরাসরি ওষুধ বাজারজাত করতে পারে না। এ কারণে স্কয়ারকে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে পণ্য বাজারজাত করতে হচ্ছে।
স্কয়ার গ্রুপের কোম্পানি সেক্রেটারি মোহাম্মদ হাবিবুজ্জামান বলেন, ফিলিপাইনের বিনিয়োগটি একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তারা স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ফিলিপাইন নামে একটু নতুন কোম্পানি খুলবেন। পুরো বিষয়টিই এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
এর আগে ২০১৭ সালে কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে ১৭ মিলিয়ন ডলার টাকা ব্যয়ে নিজস্ব কারখানা স্থাপন করে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। প্রয়োজনীয় সব অবকাঠামোও প্রস্তুত, শিগগিরই উৎপাদন শুরু হবে।
এ কারখানায় ওষুধ উৎপাদন শুরুর মাধ্যমে কেনিয়া ও পূর্ব আফ্রিকার অন্য ৫টি দেশের—তানজানিয়া, রুয়ান্ডা, বুরুন্ডি, উগান্ডা ও দক্ষিণ সুদান—৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওষুধের বাজার ধরে ওই দেশগুলোর ওষুধের চাহিদা মেটাতে চায় তারা।
দেশের আরেক নামকরা ওষুধ কোম্পানি রেনেটা ফার্মাসিউটিক্যালস তাদের আয়ারল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত সহযোগী কোম্পানিতে ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূলধন বিনিয়োগ করছে। এই বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিকে এখন থেকে তৃতীয় পক্ষের সাহায্যে ওষুধ বাজারজাত করতে হবে না, তারা এখন সরাসরি নিজেদের ওষুধ বিক্রি করতে পারবে।
এছাড়াও রেনেটা একই লক্ষ্যে যুক্তরাজ্যে ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা বলেন, 'আমরা ইতিমধ্যেই এ দুই দেশে আমাদের উৎপাদিত ওষুধ সরাসরি বাজারে বিক্রি করার জন্য সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছি। কিন্তু ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য যথেষ্ট ইক্যুইটি থাকায় আমাদের থার্ড পার্টি ধরে ১০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন দিয়ে পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে।'
এই দুটি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ছাড়াও কেস-টু-কেস ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধের বাজার ধরতে ২০১৫ সালে ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে এসিআই ফার্মাসিউটিক্যালস।
এর আগে ২০১৪ সালে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসকে দেশের বাইরে বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটির প্রাথমিকভাবে এস্তোনিয়ায় যৌথ উদ্যোগে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করার কথা ছিল। কিন্তু সরকার কঠোর শর্ত আরোপ করায় সে উদ্যোগ আর এগোয়নি।
অনুমোদন পাওয়া আরেকটি প্রতিষ্ঠান হলো বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের (বিএসআরএম)। বিএসআরএম হংকংয়ে তাদের বিদ্যমান সহযোগী প্রতিষ্ঠানে ৫ লাখ ডলার বিনিয়োগ করবে।
বিএসআরএম গ্রুপের প্রধান ফিন্যান্সিয়াল অফিসার শেখর রঞ্জন কর বলেন, 'আমরা মূলত চীন থেকে কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য সাবসিডিয়ারি স্থাপন করেছি। কিন্তু মূলধন কম হওয়ায় তা করতে পারিনি।'
ইক্যুইটি বিনিয়োগ অনুমোদনের ফলে সেই বাধা এখন দূর হয়েছে। এর ফলে ওইসব অঞ্চলে পণ্য রপ্তানির সুযোগও হয়েছে বলেও জানান তিনি।
২০১৬ সালে বিএসআরএমকে কেনিয়ার ইস্পাত খাতে বিনিয়োগের অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিছু শর্তপূরণ সাপেক্ষে কোম্পানিটিকে ওই দেশে কারখানা নির্মাণের জন্য এক্সপোর্ট রিটেনশন কোটার (ইআরকিউ) ব্যালেন্স থেকে ৪ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
এছাড়াও এমঅ্যান্ডজে গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান কলম্বিয়া গার্মেন্টস লিমিটেডকে ক্রয় ও ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
যেসব কোম্পানি অনুমোদন পায়নি, সেগুলো হলো মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সোনারগাঁও সিডস ক্রাশিং মিলস লিমিটেড এবং বাংলাদেশ ভেনচার ক্যাপিটাল লিমিটেড।
ব্যবসা সম্প্রসারণ, সাপ্লাই চেইনে ঝুঁকি কমানো, সুলভ মূল্যে কাঁচামাল সংগ্রহ এবং ক্রেতাদের আরও কম মূল্যে পণ্য সরবরাহ করতে সিঙ্গাপুরে একটি সহযোগী কোম্পানি স্থাপনের জন্য ২৫ হাজার ডলার বিনিয়োগ করতে চেয়েছিল সোনারগাঁও সিডস ক্রাশিং মিলস।
বিদেশে বিনিয়োগের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দেওয়া আবেদনপত্রে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, তাদের নিজস্ব কোনো এক্সপোর্ট রিটেনশন কোটা অ্যাকাউন্ট (ইআরকিউ) নেই। সেজন্য তারা একই গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠান তাসনিম কেমিক্যাল কোম্পানির নামে এ বিনিয়োগ নিতে চায়।
প্রস্তাবকারক প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে। কোম্পানিটির মাত্র এক বছরের রপ্তানি অভিজ্ঞতা রয়েছে।
অন্যদিকে ব্রায়োএগ্রো নামে একটি স্প্যানিশ কৃষি-প্রযুক্তি ভিত্তিক স্টার্ট-আপের ০.৮৫ শতাংশ শেয়ার বা মালিকানা কিনতে ১০ হাজার মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করার অনুমতি চেয়েছে ভেনচার ক্যাপিটাল লিমিটেড।
২৭ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বাংলাদেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের এক্সপোর্ট রিটেনশন কোটায় (ইআরকিউ) পর্যাপ্ত স্থিতি থাকা সাপেক্ষে বিদেশে ইক্যুইটি বিনিয়োগ করার অনুমতি দেয়। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো রপ্তানি আয়ের যে অংশ বৈদেশিক মুদ্রা হিসেবে সঞ্চয় করে, তা-ই ইআরকিউ।
বর্তমানে বিদেশে বিনিয়োগ আছে, এমন বাংলাদেশি কোম্পানির সংখ্যা ১৮টি। এ তালিকায় নতুন যোগ হওয়া কোম্পানি একটি—কলম্বিয়া গার্মেন্টস লিমিটেড।
বিদেশে ব্যবসার অবস্থা
বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানিকারক স্প্যারো গ্রুপ ২০০৭ সালে একটি শীর্ষস্থানীয় ভারতীয় পোশাক প্রস্তুতকারকের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কোম্পানি গঠন করে জর্ডানে বিনিয়োগ করে।
সেই কারখানায় এখন প্রায় ১৬০০ বাংলাদেশি ও ৫০০ স্থানীয় লোক কাজ করছে। কারখানাটির বার্ষিক টার্নওভার ৭০ মিলিয়ন ডলার।
দেশের বেসরকারি খাতের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী আকিজ গ্রুপ ২০ মিলিয়ন ডলারে রবিন রিসোর্সেস নামক একটি মালয়েশিয়ান কোম্পানি অধিগ্রহণ করে। সেই বিনিয়োগ থেকে কোম্পানিটি ভালো রিটার্ন এনে দিয়েছে।
আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসকে বশিরুদ্দিন বলেন, পুরোনো কোম্পানি অধিগ্রহণ করায় ব্যবসা পরিচালনায় তাদেরকে নতুন কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়নি। ইক্যুইটি বিনিয়োগে রিটার্ন সন্তোষজনক। বর্তমানে কোম্পানিটিতে পাঁচ শতাধিক লোক কর্মরত রয়েছে।
তবে বিদেশে ব্যবসা করতে গিয়ে খারাপ করেছে ডিবিএল গ্রুপ। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগ এবং কম মূল্যের জমি ও সস্তা শ্রমের সুবিধা নিতে ২০১৮ সালে ইথিওপিয়ার তিগ্রে অঞ্চলে একটি পোশাক কারখানা স্থাপন করেছিল ডিবিএল গ্রুপ।
কিন্তু ২০২০ সালে এই অঞ্চলে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় ওই কারখানা বন্ধ করে দিয়ে ইথিওপিয়া থেকে শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয় ডিবিএল। এখনও গৃহযুদ্ধ চলছে বলে কারখানাটি পুনরায় খোলার বিষয়টি এখনও অনিশ্চিত।
২০১৩ সালে এমজেএল বাংলাদেশ লিমিটেড প্রথম বাংলাদেশি কোম্পানি হিসেবে মিয়ানমারভিত্তিক একটি পেট্রোলিয়াম কোম্পানির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে একটি কোম্পানি গঠন করে এবং প্রতিবেশী দেশটিতে ৫ দশমিক ১ লাখ ডলার বিনিয়োগ করে। শুরুতে কোম্পানিটি ভালো লাভই করেছিল।
কিন্তু মিয়ানমারের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন এবং জবাবদিহির অভাবের কারণে কয়েক বছর পরই লোকসান দিতে শুরু করে এমজেএল। অবশেষে ব্যাপক লোকসানের পর ২০২০ সালে ব্যবসা গুটিয়ে দেশে ফিরে আসে কোম্পানিটি।