স্যামসাংয়ের হাত ধরে যেভাবে হাই-টেকের পথে হাঁটছে ফেয়ার ইলেকট্রনিকস

অর্থনীতি

29 January, 2022, 11:50 pm
Last modified: 30 January, 2022, 12:43 pm
২০১৮ সালের জুনে প্রায় ৫৫ বিঘা জমির ওপর যাত্রা শুরু করে ফেয়ার ইলেকট্রনিকসের নরসিংদীর কারখানা। এই কারখানায় বর্তমানে কাজ করছেন ২ হাজারের বেশি প্রকৌশলী, যাদের অধিকাংশই বাংলাদেশি। 

দেশে ইতিমধ্যে প্রায় আধডজন ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদন করে ফেয়ার ইলেকট্রনিকস। প্রতিষ্ঠানটি এবার একটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশেই যাত্রীবাহী গাড়ি সংযোজন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

ফেয়ার গ্রুপ একে বলছে 'প্রোগ্রেসিভ ম্যানুফ্যাকচারিং'। এ কৌশলে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করবে বলে প্রযুক্তিগত খুঁটিনাটি জানার এবং উন্নয়ন ও গবেষণায় বড় বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়ে না। এতে স্থানীয় ক্রেতারা আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের গাড়ি কেনার সুযোগ পাবেন সুলভ দামে।

এ প্রক্রিয়া অবলম্বন করলে চীনের মতোই বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনকেন্দ্রে পরিণত হতে পারে বলে জানিয়েছে ব্যবসাগোষ্ঠীটি। আর ফেয়ারেরর অতীত ইতিহাসও তাদের এই দাবির সপক্ষেই কথা বলে।

উদাহরণ হিসেবে স্যামসাং গ্যালাক্সি এস২২ আলট্রা ৫জি হ্যান্ডসেটটির কথাই ধরা যাক। কোরিয়ান ইলেকট্রনিকস জায়ান্ট স্যামসাং এই হ্যান্ডসেটটি ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিকভাবে লঞ্চ করবে। কোরিয়ান প্রযুক্তি সহায়তায় স্থানীয় প্রকৌশলীরা ফেয়ারের নরসিংদীর কারখানায় বাংলাদেশের বাজারের জন্য ফোনটি তৈরি করবেন। এদেশে স্যামসাংয়ের অ্যাসেম্বলি পার্টনার পার্টনার হলো ফেয়ার।

কারখানায় ফেয়ার গ্রুপ এখন অন্যান্য স্যামসাং ফোনও—যেমন জেড ফোল্ড ৩ ৫জি, এস২১, এস২১ প্লাস, আলট্রা ও নোট প্লাস—উৎপাদন করছে।

ফেয়ার ইলেকট্রনিকসের প্রধান মার্কেটিং অফিসার মেছবাহ উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'কোরিয়ান অংশীদারিত্ব আমাদেরকে একটি অত্যাধুনিক ইলৈকট্রনিকস ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্ট গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে। আমাদের তরুণরা এখন কোরিয়ান ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে প্রোডাকশন লাইনে কাজ করে দক্ষ হচ্ছে।'

২০১৮ সালের জুনে প্রায় ৫৫ বিঘা জমির ওপর যাত্রা শুরু করে ফেয়ার ইলেকট্রনিকসের নরসিংদীর কারখানা। এই কারখানায় বর্তমানে কাজ করছেন ২ হাজারের বেশি প্রকৌশলী, যাদের অধিকাংশই বাংলাদেশি। 

বাংলাদেশের বাজারে মোবাইলের প্রায় শতভাগই আসে নরসিংদীর এ কারখানা থেকে। এছাড়া ফ্রিজ, টেলিভিশন, এয়ারকন্ডিশনার (এসি), ওয়াশিং মেশিন ও মাইক্রোওয়েভ ওভেনেরও ৯০ শতাংশই জোগান দিচ্ছে এ কারখানা। 

ফেয়ার ইলেকট্রনিকসের প্রধান মার্কেটিং অফিসার জানান, কোরিয়ানদের কাছ থেকে শিখে দেশীয় প্রকৌশলীরা এখন স্যামসাংয়ের পণ্য রি-ইঞ্জিনিয়ারিং করছেন।

তিনি বলেন, 'আমাদের প্রকৌশলীদের উৎপাদন জ্ঞান এবং দক্ষতার কারণে বাংলাদেশের কারখানা স্যামসাংয়ের ২৬টি বৈশ্বিক কারখানার মধ্যে ৭ম স্থান অর্জন করেছে।'

কাজ হচ্ছে আরএনডি ট্রান্সফারের মাধ্যমে

ফেয়ার ইলেকট্রনিকসের এ কারখানার নিজস্ব আরএনডি (গবেষণা ও উন্নয়ন) না থাকলেও স্যামসাংয়ের মূল আরএনডি ট্রান্সফারের মাধ্যমে স্থানীয় প্রকৌশলীদের দিয়েই প্রায় সব কাজ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মেছবাহ উদ্দিন। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, কারখানাটি চার লেয়ারের দক্ষ জনবল নিয়ে গঠিত। প্রথম লেয়ারটি সরাসরি স্যামসাংয়ের প্রকৌশলী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তারা এসেছেন কোরিয়া ও ভারত থেকে। 

প্রথমদিকে এই কোরিয়ান ও ভারতীয়রাই ছিলেন কারখানার মূল ভরসা। তবে স্থানীয় দক্ষ প্রকৌশলী তৈরি হওয়ায় এখন মাত্র ৬ জন বিদেশি রাখা হয়েছে।

দ্বিতীয় লেয়ারের প্রকৌশলীরা প্রত্যেকেই বাংলাদেশি। দেশেরই বিভিন্ন প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করেছেন তারা। তবে নিয়োগের পর তাদেরকে কোরিয়া থেকে ৪০-৪৫ দিনের প্রশিক্ষণ করিয়ে আনা হয়েছে। এছাড়া ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়াসহ স্যামসাংয়ের অন্যান্য কারখানা থেকেও হাতে-কলমে কাজ দেখিয়ে আনা হয়েছে তাদের।

তৃতীয় ও চতুর্থ লেয়ারের লোকবলও দেশেই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গড়ে ওঠা। নিয়োগের পর অন্তত এক মাস তাদের প্রশিক্ষণ পিরিয়ড থাকে। এই সময় তারা শুধু কারখানায় দেখেন এবং খসড়া প্রোডাক্ট তৈরি করেন।

স্যামসাংয়ের অত্যাধুনিক মেশিনারি স্থাপনে নরসিংদীর কারখানায় এখন পর্যন্ত ২০০ মিলিয়ন ডলার বা ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছে ফেয়ার গ্রুপ। কাঁচামাল ও ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল এবং মার্কেটিং মিলিয়ে এ বিনিয়াগ ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন মেছবাহ উদ্দিন।

তিনি বলেন, 'কারখানার পাশাপাশি সারা দেশে কনজিউমার ইলেকট্রন্কিসের জন্য নিজস্ব ৫০টির বেশি শো-রুম, মোবাইলের জন্য ৪০টির বেশি শো-রুম রয়েছে। এছাড়া মোবাইলে ২২৫টির মতো ফ্র্যাঞ্চাইজি ও কনজিউমার ইলেকট্রনিকসে ১৪০টির মতো ফ্র্যাঞ্চাইজিতেও রয়েছে ক্যাপিটাল সাপোর্ট।'

মেছবাহ উদ্দিন আরও বলেন, 'মোবাইল ছাড়াও বাংলাদেশের প্রায় রেফ্রিজারেটরও আমরা উৎপাদন করি। এই কারখানায় বানানো ৮টি মডেল দেশে বিক্রিত স্যামসাংয়ের ফ্রিজের ৯৩ শতাংশ কভার করে। আমরা এখন কমপ্রেসার ছাড়া আর কিছু আমদানি করি না।

'গত বছর থেকে আমরা এয়ার কন্ডিশনার বানানো শুরু করেছি। শুধু কমপ্রেসার ছাড়া বাকি সব পার্টসই নিজেরা বানাই। এগুলোতে ৪০ শতাংশের বেশি ভ্যালু অ্যাডিশন হয়।'

স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের ফলে দাম আসছে হাতের নাগালে

ফেয়ার ইলেকট্রনিকসের কর্মকর্তারা বলেন, বাংলাদেশে স্যামসাংয়ের পণ্য অ্যাসেম্বলিং করায় স্থানীয় বাজারে এসব পণ্যের দাম কম রাখতে পারছেন।

যেমন ইউরোপ-আমেরিকাসহ বৈশ্বিক মার্কেটে স্যামসাংয়ের সর্বশেষ প্রযুক্তির মুঠোফোন জেড ফোল্ড-৩ ৫জি-র দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় ১.৭ লাখ টাকা, ভারতে এর দাম ১.৭৪ লাখ টাকায়। কিন্তু ক্যাশব্যাক অফার, লটারি ও গিফটসহ বাংলাদেশের বাজারে ফেয়ার ইলেকট্রনিকস এই ফোন বিক্রি করছে ১.৫ লাখ টাকায়। 

মেছবাহ উদ্দিন বলেন, 'দেশে সংযোজন না হলে আমদানি দামের সঙ্গে ৫৭ শতাংশ ট্যাক্স যোগ হতো। ফলে এই ফোন ২ লাখের নিচে পাওয়া যেত না।'

রি-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সুফল বর্ণনা করে তিনি বলেন, 'আরবি২১ আমাদের সর্বোচ্চ বিক্রিত রেফ্রিজারেটর। আমরা প্রথম যখন এর সিভিইউ আনি, তখন দাম পড়েছে ৪৯ হাজার ৯৯০ টাকা। এরপর আমরা যখন ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে গিয়েছি, তখন দাম চলে এসেছে ৩৪ হাজার টাকায়। এখন আমরা এটাকে আবার রি-ইঞ্জিনিয়ারিং করার প্রক্রিয়ায় রয়েছি। তা সম্পূর্ণ হলে দাম ৩০ হাজার টাকার এর নিচে চলে আসবে।'

তিনি আরও বলেন, 'একটি ৬৫ ইঞ্চি ইউএসডি টিভির দাম এখন ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। আমরা ম্যানুফ্যাকচারিং করার আগে এটি ২ লাখ টাকার ওপরে ছিল। একই অবস্থা ওয়াশিং মেশিন, এসির ক্ষেত্রেও।'

গাড়ি সংযোজন শুরু করছে ফেয়ার

ফেয়ার গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ফেয়ার টেকনোলজিসের হাত ধরে দেশে আসছে আরেক কোরিয়ান জায়ান্ট, যাত্রীবাহী গাড়ি উৎপাদনকারী হুন্দাই মোটর কোম্পানি।

ফেয়ার টেকনোলজিসের নিজস্ব অর্থায়নে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে প্রায় ৬ একর জমির ওপর গড়ে উঠছে হুন্দাই গাড়ি যৌথ উদ্যোগের সংযোজনকারী কারখানা। প্রাথমিকভাবে হুন্দাইয়ের সাম্প্রতিক মডেলের সর্বাধিক জনপ্রিয় গাড়ি সেডান, এসইউভি (স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকেল) এবং এমপিভি (মাল্টি-পারপাজ ভেজিকেল) উৎপাদনের পরিকল্পনা করেছে ফেয়ার টেকনোলজিস।

ফেয়ার টেকনোলজিসের চেয়ারম্যান রুহুল আলম আল মাহবুব বলেন, 'হুন্দাইয়ের এ কারখানা আমাদের দেশের জন্য এক নতুন মাইলফলক। এখানে বিপুলসংখ্যক দক্ষ জনবল তৈরি হওয়ার পাশাপাশি ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠবে। হুন্দাইয়ের গাড়ি উৎপাদনের কারণে ড্যাশবোর্ড, সিট কভার, রাবারসহ অন্তত ১০০টি আনুষঙ্গিক ম্যাটেরিয়াল দেশে উৎপাদনের সুযোগ তৈরি হয়েছে।'

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.