চালের মূল্যস্ফীতির হার ১৫ শতাংশের বেশি, ভোক্তাদের নাভিশ্বাস

অর্থনীতি

01 January, 2022, 10:50 am
Last modified: 01 January, 2022, 10:52 am
পাইকারি বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে খুচরা বাজারেও চালের দাম কেজিপ্রতি ৩ থেকে ৪ টাকা করে বেড়েছে।

গত তিন মাসে চালের দাম দুবার বেড়ে যাওয়ায় নাগরিক, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সবচেয়ে বেশি।

মূলত সরকারি পর্যায়ে চাল সংগ্রহের দাম বৃদ্ধি, জ্বালানী তেলের দাম বাড়ানোর প্রভাব পড়েছে দেশের বাজারে। তবে পাইকারি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সংকট দেখিয়ে বাজারকে চাঙ্গা রাখতে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ানো হচ্ছে।

জুন মাস থেকে দেশের বাজারে চালের দাম মাত্রাতিরিক্তভাবে বাড়তে থাকে। জুনমাসে চালের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ছিলো ১৫ দশমিক ১৮ শতাংশ। যা আগস্ট মাসে ১৫ দশমিক ৬২ ছিলো। অথচ একই সময়ে জাতীয় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৫৪।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই-এ পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে চালের গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিলো ১৫ দশমিক ৮২ শতাংশে, যা সাম্প্রতিক সময়ের সর্বোচ্চ। অথচ এপ্রিল ও মে মাসে চালের মূল্যস্ফীতির হার ছিল যথাক্রমে ১২ দশমিক ৪৫ ও ১২ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "খাদ্যমূল্যস্ফীতি বাড়লে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্র ও হতদরিদ্র পরিবারগুলো। এ পরিবারগুলো তাদের উপার্জনের ৫০-৭০ শতাংশ ব্যয় করে খাদ্য বাবদ। এর সিংহভাগ আবার ব্যয় হয় চাল কেনায়।"

"ফলে চালের দাম বাড়লে বাধ্য হয়ে এ শ্রেণির মানুষ ভোগ কমিয়ে দেয়। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, খাদ্যমূল্যস্ফীতির ফলে ৬৬ শতাংশের বেশি পরিবার চালের ভোগ কমিয়ে দেয়। রাষ্ট্রের দরিদ্রশ্রেণিকে সুরক্ষা দিতে সরকারের বিশেষ পদক্ষেপ প্রয়োজন," যোগ করেন অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম।

দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার চট্টগ্রামে খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহ ধরে দেশের বিভিন্ন মোকাম থেকে চাল সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এমনিতে জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধিজনিত কারণে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় চালের বাজার কিছুটা ঊর্দ্ধমুখী ছিল। কিন্তু নতুন মৌসুমের চাল সরবরাহ শুরু হলে বাজারে সংকট দেখানো হচ্ছে মোকামগুলো থেকে।

ফলে এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশে চালের দাম বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ১০০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। এর মধ্যে স্বর্ণা সিদ্ধ চালের বস্তাপ্রতি দাম ২০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৩০০ টাকায়, মিনিকেট সিদ্ধ মানভেদে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায়, পাইজাম সিদ্ধ ১৫০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায়, কাজলতা সিদ্ধ ২০০ টাকা বেড়ে ২ হাজার ৭০০ টাকায়, জিরাশাইল সিদ্ধ ২০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ১০০ টাকা দরে।

অপরদিকে আতপ চালের মধ্যে মিনিকেট বস্তাপ্রতি ১০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৬০০ টাকায়, বেতি সিদ্ধ ১০০ টাকা বেড়ে মানভেদে ২ হাজার ৪০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায়, ইরি আতপ ২০০ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে বস্তাপ্রতি ২ হাজার টাকায়, কাটারি আতপ ৩ হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে পাইকারি বাজারে।

ফলে, বাজারে চাল কিনতে গেলে প্রতি কেজিতে অন্তত ৪ থেকে ৫ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে। গত তিনমাসে মাসে চালের দাম বেড়েছে দুই দফায়। এর আগের ছয়মাসে (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর) জাতীয় মূল্যস্ফীতির চেয়ে চালের মূল্যস্ফীতি ছিল দ্বিগুণেরও বেশি। এতে সবচেয়ে বেশি নাজুক অবস্থায় আছেন স্বল্প আয়ের মানুষ। তাঁদের চাল ভোগের পরিমাণ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের চেয়ে অনেক বেশি।

সর্বশেষ এক সপ্তাহের ব্যবধানে চালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি দুই থেকে চার টাকা।

চাক্তাই শিল্প বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "অনেকেই ভারত থেকে চাল আমদানির ঘোষণা দিয়েছিলো। কিন্তু ঘোষণার ২৫ শতাংশ চালও ভারত থেকে আমদানি করা হয়নি। মূলত স্থানীয় বাজারের সঙ্গে দামের মিল না থাকায় তারা আমদানি স্থগিত রেখেছেন। তাই চালের দামটা একটু বেড়েছে।"

তবে তিনি দাবি করেছেন দেশি চালের দাম এখন কমছে। দেশি নুরজাহান বিক্রি হচ্ছে ১৮শ থেকে ২ হাজার টাকায়। ইরি আতপ (মোট) ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ চাল প্রতি বস্তা যথাক্রমে ২ হাজার৪০০ ও ২ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

পাইকারি বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে খুচরা বাজারেও চালের দাম কেজিপ্রতি ৩ থেকে ৪ টাকা করে বেড়েছে।

শুক্রবার সকালে নগরের কাজীর দেউড়ি বাজারের চাল কিনতে আসা রেজাউল করিম বলেন, "বাজারে কয়েক মাস ধরে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। খুচরায় প্রতি কেজি মোটা চাল ৪৫ টাকা পাওয়া যেতো, এখন সেটা ৫০-৫৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এখন আমাদের দৈনিক আয়ের অর্ধেক চাল কিনতেই খরচ হয়।"

খুচরা বাজারে এর মধ্যে স্বর্ণা সিদ্ধ চাল বস্তাপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৫০০ টাকায়, মিনিকেট সিদ্ধ মানভেদে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৬০০ টাকায়, পাইজাম সিদ্ধ ২ হাজার ৮০০, জিরাশাইল সিদ্ধ ৩ হাজার ১৫০ টাকা দরে।

বাজারের খান ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মালিক আবদুস সাত্তার বলেন, "ভারতীয় চালের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণেও দেশীয় চালের বাজারও ঊর্দ্ধমুখী। অনেকে আবার চাল সংগ্রহের দাম বৃদ্ধি, জ্বালানী তেলের দাম বাড়ানোর প্রভাব পড়েছে বলেও মনে করছে।"

এদিকে চলতি খাদ্য সংগ্রহ মৌসুমে সরকার ৩ লাখ টন ধান ও ৫ লাখ টন সিদ্ধ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। ধান-চাল সংগ্রহের এই কর্মসূচি চলবে ২০২২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এরমধ্যে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ৬৫ শতাংশ, ৩১ জানুয়ারি-২০২২ এর মধ্যে ৮৫ শতাংশ এবং ২০২২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ধান-চাল সংগ্রহের শতভাগ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে চায় খাদ্য বিভাগ।

গত ৮ নভেম্বর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খাতুন স্বাক্ষরিত এক পরিপত্রে অভ্যন্তরীণ খাদ্য সংগ্রহ নীতিমালা-২০১৭ অনুসারে খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে বিশেষ নির্দেশনা জারি করা হয়। নির্দেশনার আলোকে ইতোমধ্যে মিলারদের সাথে চুক্তির মাধ্যমে আমন ধানের সরকারি ক্রয়মূল্য প্রতিকেজি ২৭ টাকা, চালের মূল্য ৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম রাইস মিল এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি শান্ত দাশগুপ্ত বলেন, "সরকার ধান-চাল সংগ্রহে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। কৃষকদের ক্ষেত্রে দাম ১ টাকা বাড়ালেও মিল মালিকদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহে কেজিপ্রতি ৩ টাকা দাম বাড়িয়েছে।"

মিল মালিকদের কাছ থেকে সরকারি ক্রয়ের দাম বাড়ানোর ফলে খোলা বাজারে কৃষকদের চাল না আসায় উৎপাদন মৌসুমেও পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে চালের দাম নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে বলে মনে করছেন তিনি।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.