মহামারিকালে দেশের সমুদ্রগামী বহরে ৩২টি জাহাজ যুক্ত করেছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা 

অর্থনীতি

21 December, 2021, 01:35 am
Last modified: 21 December, 2021, 03:46 pm
জাহাজে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে প্রতিবছর ৯০০ কোটি ডলার মালবাহী ভাড়া বা ফ্রেইট চার্জ দেয় বাংলাদেশ। সংখ্যায় কম থাকায় আগে এ পরিবহন বাণিজ্যের মাত্র ৮-১০ শতাংশ ধরতে পারত স্থানীয় সমুদ্রগামী জাহাজ।

আইনি সুরক্ষা, কর সুবিধা এবং বর্ধিত ফ্রেইট চার্জের সুবাদে সমুদ্রগামী জাহাজ খাতে বিনিয়োগে উৎসাহী হয়েছেন নতুন উদ্যোক্তারা। দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে যে বিপুল পরিমাণ ভাড়া পণ্য পরিবাহী বিদেশি শিপিং সংস্থার কাছে যায়, সেই বাজারই ধরতে চান তারা।

খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভ্যাট ছাড়, দেশের সমুদ্র বন্দরে জাহাজের বার্থিং পেতে অগ্রাধিকার, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে পণ্যের ৫০ শতাংশ দেশীয় জাহাজে পরিবহনের বাধ্যবাধকতা এবং ক্রমে স্ফীত আমদানি-রপ্তানির ফলে এখাতে প্রবৃদ্ধির সৃষ্টি হয়েছে।

মহামারির কারণে জাহাজের দাম কমে যাওয়া হয়েছে আরেক আশীর্বাদ। মহামারিকালে বিশ্ববাণিজ্যে মন্দাভাবের সময় জাহাজের দাম ১০-১২ মিলিয়ন থেকে ৫-৬ মিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ফলে বাংলাদেশি জাহাজ ব্যবসাগুলো দুদিক থেকেই সুবিধা পায় বলে জানান তারা।

মহামারির মধ্যেও গত দুই বছরে দেশীয় পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজের বহরে যুক্ত হয়েছে ৩২টি জাহাজ। ২০১৯ সালের ৪৮টি থেকে চলতি ডিসেম্বর নাগাদ মোট জাহাজের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০টিতে।

এদিকে জাহাজে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে প্রতিবছর ৯০০ কোটি ডলার মালবাহী ভাড়া বা ফ্রেইট চার্জ দেয় বাংলাদেশ। আগে এ মালবাহী বাণিজ্যের মাত্র ৮-১০ শতাংশ ধরতে পারত স্থানীয় সমুদ্রগামী জাহাজ। দেশের পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা বাড়ায় এখন এখাতের ২০ শতাংশ ধরে; বার্ষিক ২০০ কোটি ডলার আয়ের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ী ও নৌ-বাণিজ্য দপ্তরের কর্মকর্তারা।

এখাতে বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলেও জানান তারা।  

বৈশ্বিক সরবরাহ চক্রে মহামারির অভিঘাতে দেখা দেয় বিচ্ছিন্নতা, যার ফলে জাহাজে মালবহন ভাড়া অনেক বেড়েছে। বাড়তি আয়ের সুযোগ দেখেই আসে লক্ষ্যণীয় বিনিয়োগ। ৫০ কোটি মার্কিন ডলার নতুন বিনিয়োগসহ এখাতে মোট বিনিয়োগ প্রায় ২০০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে।  

যেমন চট্টগ্রামভিত্তিক কবির গ্রুপের মালিকানায় রয়েছে ২৩টির জাহাজ। গত তিন বছরে কোম্পানিটি পাঁচটি নতুন জাহাজ তাদের বহরে যোগ করেছে। ফলে ২০০৩ সাল থেকে এপর্যন্ত তাদের বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৩৪ কোটি ডলার।  

কবির গ্রুপের সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার খান রাহাত টিবিএস'কে বলেন, "ফ্রেইট চার্জ হিসাবে বিদেশি শিপিং কোম্পানিগুলো এ দেশ থেকে যে আয় করছে, তার পুরোটা ধরতে পারলে বাংলাদেশ এখাতে স্ব-নির্ভরতা অর্জন করবে। এই অর্থ দেশে রাখতেই আমরা বিনিয়োগ করছি।" 

এ খাতের সমর্থনে সরকারের কাছে আরো ব্যবসা সহায়ক নীতির দাবি জানান এ ব্যবসায়ী।

বিদেশে যাওয়া অর্থের একটি অংশ তারা দেশেই রাখতে পারছেন বলে জানিয়ে সরকারের কাছে ফ্রেইট চার্জের ওপর আরোপিত ৩ শতাংশ কর প্রত্যাহারের সুপারিশ করেন রাহাত। তারা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছেন বিধায় নগদ প্রণোদনা দেওয়ার কথা বলেন তিনি।

গেল বছর শুধু তার কোম্পানিই ১০ কোটি ডলার ফ্রেইট চার্জ বাবদ দেশে এনেছে।

নৌপরিবহন অধিদপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন মো. গিয়াসউদ্দিন আহমেদ টিবিএসকে বলেন, সরকারের ফ্ল্যাগ প্রোটেকশন আইনের কল্যাণে গত দুই বছরে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক জাহাজ দেশীয় বহরে যুক্ত হয়েছে। এতে বেসরকারি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে উৎসাহিত হয়েছেন।

তিনি বলেন,  "বর্তমানে বাংলাদেশে আমদানি-রপ্তানির প্রায় ২০ ভাগ পণ্য দেশীয় মালিকানাধীন জাহাজে পরিবহনের সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। তবে এ খাতে এখনো প্রচুর বিনিয়োগের সুযোগও রয়েছে।"

এ খাতে আসা বড় কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে- মেঘনা গ্রুপ (১৫টি জাহাজ), আকিজ গ্রুপের রয়েছে ১০টি, কর্ণফুলী গ্রুপের ৬টি, বসুন্ধরা গ্রুপের ৪টি এবং ওরিয়ন গ্রুপের একটি জাহাজ। এছাড়া বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের অধীনে আরো ৮টি জাহাজ থাকার কথা নৌ-বাণিজ্য দপ্তর সূত্রে জানা যায়। 

মহামারির সময়ে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক জাহাজ চালু করেছে মেঘনা গ্রুপ। এসময়ে বাংলাদেশ থেকে ৩২টি সমুদ্রগামী জাহাজ যাত্রা শুরু করে, যার মধ্যে ১০টি ছিল এ শিল্পগোষ্ঠীর। 

মেঘনা গ্রুপের ১৫টি জাহাজ মাসে ৭ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন পণ্য পরিবহন করে। সে হিসাবে বছরে বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে ৯০ লাখ মেট্রিক টন পণ্য পরিবহন করে মেঘনা গ্রুপের জাহাজ।

মেঘনা গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান মার্কেন্টাইল শিপিংয়ের টেকনিক্যাল ম্যানেজার মোহাম্মদ আবু তাহের জানান, ১৫টি জাহাজে বর্তমানে মেঘনা গ্রুপের বিনিয়োগ সাড়ে ৩৭ কোটি ডলার। ২০২২ সালের ডিসেম্বর নাগাদ এ বহরে আরো ৪টি জাহাজ যুক্ত হবে।

মেঘনা গ্রুপের সূত্রগুলো জানিয়েছে, তাদের জাহাজগুলো ধারণ ক্ষমতার ৬০ শতাংশ কোম্পানির নিজস্ব পণ্য বহন করে। বাকি ৪০ শতাংশ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানির জন্য বরাদ্দ থাকে। 

২০১৩ সালে বাংলাদেশি মালিকানায় ছিল ৮৫টি সমুদ্রগামী কার্গো জাহাজ। তবে মালবাহন ভাড়া কমতে থাকায় ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ৩৫টিতে নেমে আসে। এর পেছনে পরিচালনা ব্যয় বৃদ্ধি এবং জাহাজ তৈরি ও আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতির সুযোগ প্রত্যাহার বড় ভূমিকা রাখে।  

তাছাড়া, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ, ভাবমূর্তি সংকট, নিবন্ধনে দীর্ঘসূত্রিতা, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বন্দরের দ্বিগুণ করারোপ এবং জাতীয় পতাকাবাহী জাহাজ সুরক্ষার অভাবের মতো অনুঘটক দেশে বাণিজ্যিক জাহাজের সংখ্যা হ্রাসের পেছনে ভূমিকা রাখে।  

এই প্রেক্ষিতে সরকার বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ (সুরক্ষা) আইন ২০১৯ প্রণয়ন করেছে। এতে ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা, দেশের সমুদ্র বন্দরে জাহাজের বার্থিং পেতে অগ্রাধিকার, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে পণ্যের ৫০ শতাংশ দেশীয় জাহাজে পরিবহনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে, যা আগে ৪০ শতাংশ ছিল। জাহাজ নিবন্ধনের ক্ষেত্রেও জটিলতা দূর হয়েছে। ফলে এ খাতে পুনঃবিনিয়োগে আগ্রহী হয়েছেন দেশের শিল্পোদ্যোক্তারা।

বাংলাদেশের সমুদ্রগামী জাহাজ মালিক সমিতি (বিওজিএসওএ) সূত্র জানিয়েছে, এ খাতে ৬ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টির এবং অতিরিক্ত ৪০০ কোটি ডলার আয়ের সুযোগ রয়েছে।

কবির গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এসআর শিপিং লি:- এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সিইও মেহেরুল করিম জানান, পতাকাবাহী জাহাজ (সুরক্ষা) আইনের ফলে এ খাতে বিনিয়োগে বড় ধরনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া পুরোনো জাহাজের দামও কিছুটা কমেছে। ফলে এ খাতের উদ্যোক্তারা নতুন করে বিনিয়োগ করছে। তবে এখানে আরো বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে।

এক দশক পর ২০২০ সালে ১১৬ কোটি টাকায় দুটি কন্টেইনার জাহাজ কিনে এ খাতে ব্যবসা শুরু করেছে কর্ণফুলী লিমিটেড। গ্রুপটির বহরে এখন জাহাজের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬টি।

বসুন্ধরা গ্রুপ নতুন করে বিনিয়োগ করেছে এলপিজি জাহাজ খাতে। এলপিজি পরিবহনের জন্য বসুন্ধরা গ্রুপের বহরে বর্তমানে আছে ৩টি জাহাজ। এই গ্রুপটির মলিকানায় রয়েছে সাধারণ পণ্যবাহী আরো একটি জাহাজ।

বৈশ্বিক শিপিং ব্যবসায় সুদিন দেখেই কী এখাতে আগ্রহ বাড়ছে? 

বিশ্বের প্রধান প্রধান বন্দরে যখন পণ্য ও জাহাজ জটে কন্টেইনারের স্তূপ জমেছে, ঠিক তখনই রেকর্ড মুনাফার মুখ দেখছে বৈশ্বিক শিপিং কোম্পানিগুলো। কোনো কোনোটি ১১৭ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মুনাফা করছে, কেউবা লাভের বিচারে অ্যাপল ইঙ্ককেও ছাড়িয়ে গেছে। 

বিশ্বের বৃহত্তম কন্টেইনার শিপিং লাইন- এপি মোলার মায়েরস্ক এ/এস চলতি বছর তিনগুণ মুনাফার আশা করছে, যা তাদের ২০১৯ সালে হওয়া আয়ের চেয়েও ১৫গুণ বেশি হবে। জার্মানির আরেক জায়ান্ট হ্যাপাগ-লয়েড এজি ছয় মাসে যত মুনাফা করেছে তা ছিল কোম্পানির বিগত ১০ বছরের মোট লাভের চেয়েও বেশি। 

বৈশ্বিক সরবরাহ চক্রে বিচ্ছিন্নতার কারণেই বেড়েছে জাহাজে পণ্য বহন বা ফ্রেইট খরচ। এটি ব্যবসায়ী, উৎপাদক আর ভোক্তাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠলেও সমুদ্রগামী পণ্যবাহী জাহাজ সংস্থাগুলোর পোয়াবারো। তারা করে চলেছে রেকর্ড মুনাফা। 

নির্ধারিত যাত্রায় দেরি, উচ্চ পরিবহন ভাড়া এবং জাহাজ জটে আটকে থাকার দরুন বাড়তি সারচার্জ তাদের আয় বাড়িয়েই চলেছে। 

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া থেকে চীন পর্যন্ত ৪০ ফুটি কন্টেইনার বহনের জাহাজভাড়া ১৫ থেকে ১৭ হাজার ডলার। যা বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। আসন্ন বড়দিনের ছুটির সময় থেকে এই দর আগামী বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত থাকার অনুমান করা হচ্ছে। 

বৈশ্বিক জাহাজ শিল্পের এই রমরমা অবস্থার সুবিধা নিতেই কী দেশীয় কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করছে? 

ব্যবসায়ীক নির্বাহীরা বলছেন, এই লক্ষ্য বিনিয়োগ কৌশলের অংশ। তবে দুই বছর আগে সুবিধাজনক আইন প্রণয়নের পর থেকেই তারা এ খাতের দিকে মনোনিবেশ করেন। 

এব্যাপারে বাংলাদেশের সমুদ্রগামী জাহাজ মালিক সমিতির সভাপতি আজম জে চৌধুরী টিবিএস'কে বলেন, গত দুই বছরে জাতীয় পতাকাবাহী যেসব জাহাজে বিনিয়োগ হয়েছে তারা নিজস্ব পণ্যই বহন করছে। তাই এখাতে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের আরো বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। 

তবে এজন্য সরকারকে পতাকাবাহী জাহাজ (সুরক্ষা) আইনের সকল দিক সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে বলেও জানান তিনি।  

কর্ণফুলী গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এইচআর লাইনস লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক আনিস উদ দৌলাহ টিবিএস'কে জানান, দীর্ঘদিন ধরেই কোম্পানিটি শিপিং ব্যবসায় জড়িত। ধারাবাহিকভাবে বহরে আরো ৬টি ফিডার জাহাজ যুক্ত করেছে কোম্পানিটি।

বর্তমানে, এই জাহাজগুলি প্রতি মাসে ২৫ হাজার টিইইউ বা ২০ ফুট সমতুল্য ইউনিট আমদানি ও রপ্তানি কন্টেইনার পরিবহনে সক্ষম। 

কবির গ্রুপের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর বলেন, শিপিং খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পেছনে মালবহনের উচ্চ দরও একটি বড় কারণ।

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.