সঙ্কটে সিলেটের শতবর্ষ পুরনো শীতলপাটি শিল্প
৪০ বছর ধরে শীতলপাটি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন কালাচাঁদ বাবু (৭৫)। সিলেটের রাজনগর উপজেলার তুলাপুর গ্রামে বাস এই পাটিকর বা পাটিয়ালের।
কিন্তু দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় বিগত কয়েক দশক ধরে কালাচাঁদ বাবুর শীতলপাটির বাজার ছোট হয়ে এসেছে। তারমধ্যে করোনা ভাইরাসের প্রভাবে ব্যাপক ধস নেমে এসেছে তার ব্যবসায়। মহামারির আগে তার কারিগর ছিল ৩০ জন, বিক্রি না থাকায় কাজ হারিয়ে বর্তমানে ৫ জন কারিগর বাদে সবাই চলে গেছেন অন্য পেশায়।
এ পেশায় জীবিকা নিয়ে সংশয় ও হতাশা প্রকাশ করে কালাচাঁদ বাবু টিবিএসকে বলেন, "৩০-৪০ বছর আগে এই সিলেটের রাজনগর ও বলাগঞ্জ উপজেলার প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ মানুষই শীতলপাটি বুনতেন, কেউ বিক্রির উদ্দেশ্যে কেউবা নিজের পরিবারে ব্যবহারের জন্য হলেও অন্তত শীতলপাটি বানাতেন। পোষাতে না পেরে বর্তমানে ১০ শতাংশ মানুষও এ কাজ আর করেন না। বর্তমানে আমিও চিন্তা করছি এ পেশা ছেড়ে ভালো আয়-রোজগারের অন্য পেশায় চলে যাব।"
তিনি আরও বলেন, "আমি করোনা আসার আগেও মাসে লাখখানেক টাকার শীতলপাটি বিক্রি করতাম, আর এখন মাসে ৩০-৪০ হাজার টাকারও বিক্রি হয় না।"
একটি শীতলপাটি বানাতে ১ সপ্তাহ থেকে ১৫ দিন সময় লাগে। মাঝারি আকারের শীতলপাটি বানাতে দেড় থেকে ২ মাস সময়ও লেগে যায়। সেটা বিক্রি হয় ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে। আকারে বড় শীতলপাটিগুলো বড়জোড় ৫-৬ হাজার টাকায় বিক্রি হয়।
অধীর বাবু (৫০) সুরমা উপজেলার করমপুর গ্রামে শীতলপাটির কারিগর হিসেবে ২০ বছর ধরে কাজ করেছেন। করোনাকালীন সময়ে কাজ না থাকায় এ পেশা পরিবর্তন করে তিনি এখন ক্ষেত-খামারের শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন।
টিবিএসকে বলেন, "এমনিতেই শীতল পাটির কারিগর হিসেবে কাজ করে দৈনিক ২০০-৩০০ টাকার উপরে পেতাম না, সংসারে সারা বছর অভাব লেগেই থাকতো। কিন্তু করোনায় এমন অবস্থায় হয়েছে যে ঘরে চাল পর্যন্ত ছিল না, শীতলপাটির কাজ না থাকায় বাধ্য হয়ে এ পেশা ছেড়ে কৃষি শ্রমিকের কাজ করছি।"
একই গ্রামের আরেক কারিগর সদয় বাবু (৫০) বলেন, "আমি ৩০ বছর ধরে এ পেশায় কিন্ত ইদানিং পণ্যের চাহিদা কমে গেছে এবং মজুরি কম পাই। তাই এ পেশা ছেড়ে দিয়েছি। এখন আমি রিক্সা চালিয়ে দৈনিক ৫০০ টাকার মতো আয় করতে পারি।"
দুর্গেশ বাবু (৬০) সিলেটের সুরমা উপজেলায় ৩০ বছর ধরে শীতলপাটি ব্যবসায় জড়িত। তিনি বলেন, "২০-২৫ বছর আগেও বালাগঞ্জ, রাজনগর উপজেলাসহ পুরো সিলেট বিভাগে আনুমানিক ৪০০০-৫০০০ পরিবার শীতলপাটি উৎপাদনে জড়িত ছিল। এখন বর্তমানে পুরো সিলেট বিভাগে আমার মনে হয় ১০০০ পরিবারও এ কাজে আর নেই। তারা পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় চলে গেছেন।"
তিনি বলেন, সারাদেশে পরিবেশ দূষণকারী প্লাস্টিকের পণ্য শীতলপাটির জায়গা দখল করে নিয়েছে। আগে মানুষ মাটির তৈরি ঘরে সাধারণত শীতলপাটিকে খাটে ও চৌকির বিছানা হিসেবে ব্যবহার করত। শীতলপাটিতে বসে ভাত খেত। বর্তমানে মানুষ খাটের নিচে প্লাস্টিকের পাটি বা হার্ড বোর্ড ব্যবহার করছে। এছাড়াও মাটির ঘরের জায়গায় এখন মানুষ ইট-পাথরের বাড়িতে ডাইনিং টেবিলে বসে খাচ্ছে। ফলে দিনে দিনে এসব শীতল পাটির চাহিদা কমে গেছে।
মজুরি কম হওয়ায় তরুণ প্রজন্ম এ পেশায় আসছেন না বললেই চলে এবং অভিজ্ঞ, বয়স্ক কারিগরেরাও আর আগের মত পরিশ্রম করতে পারছেন না।
বিয়েবাড়িতে আগের দিনের মতো বর-কনেকে নতুন পাটিতে বসানোর রেওয়াজও বর্তমানে অনেক কমে গেছে বলে মনে করেন দুর্গেশ বাবু।
জানা যায়, সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার তেঘরিয়া গ্রামের শীতলপাটি এক সময় জায়গা করে নিয়েছিল মহারানী ভিক্টোরিয়া এবং মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজসভায়।
১৯২০ সালে প্রকাশিত 'শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত 'নামক গ্রন্থেও শীতল পাটির গুণ-মান সম্পর্কে বিস্তর বর্ণনা পাওয়া যায়।
জাতীয় জাদুঘরের তথ্য অনুযায়ী, সিলেট বিভাগের ১০০ গ্রামের প্রায় চার হাজার পরিবার এই শিল্পের হাল ধরে আছেন। বংশপরম্পরায় এই কারুশিল্পকে তারা একশত বছরের বেশি সময় ধরে লালন করে আসছেন।
যে সবুজ রঙের বেত বুনে শীতলপাটি তৈরী করা হয় তার নাম পাটিবেত বা মুর্তা। শীতলপাটির কারিগরদের অধিকাংশই সিলেটের কারণ সেখানকার নিচু জমিতে প্রচুর পরিমাণে মুর্তা জন্মে থাকে।
চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, বরিশাল, টাঙ্গাইল এবং লক্ষ্মীপুর, ফরিদপুর, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী এবং খুলনা অঞ্চলেও শীতলপাটি বোনার চর্চা হয়।
অঞ্চলভেদে শীতলপাটির রয়েছে বাহারি নাম- নকশি, সিকি, আধালি, টাকা, নয়নতারা, আসমানতারা, চিড়া প্রভৃতি।
২০১৭ সালে বাংলাদেশের শীতলপাটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা দেয় জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো। শীতলপাটি বুননের ঐতিহ্যগত হস্তশিল্পকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
ঐতিহ্যবাহী এই পাটি কলকাতা কারুশিল্প প্রদর্শনীতে স্বর্ণপদকও অর্জন করেছে। ১৯৯১ সালে বালাগঞ্জের শীতলপাটির কারিগর মনীন্দ্র নাথ ইতালির রোমে বিশ্ব কারুশিল্প প্রদর্শনীতে শীতলপাটির প্রদর্শনের জন্য পুরস্কৃত হন।
দেশে-বিদেশে সরাসরি এবং অনলাইনে শীতলপাটি বিক্রি করে থাকেন সিলেটের আয়েশা আক্তার (৪০)।
তার নিজের ৩০ জন কারিগর রয়েছেন। আয়েশা টিবিএসকে বলেন, "আমি মনে করি অত্যাধিক প্লাস্টিকের ব্যবহার ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি প্রচারের অভাবে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প আজ লোকসানের মুখে। প্রচারের অভাবে এই শিল্পের উদ্যোক্তরা ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি করতে পারছে না।"
তিনি আরও বলেন, "ঢাকায় আমি এবার ২০২১ এসএমই মেলায় প্রত্যাশার থেকে দ্বিগুণ পরিমাণ শীতলপাটি বিক্রি করেছি, অর্ডার পেয়েছি; আর এটি সম্ভব হয়েছে এসএমই ফাউন্ডেশনের অনলাইন-অফলাইন প্রচারের কারণে। আমি মনে করি এভাবে এসএমই ফাউন্ডেশন, বিসিক ইত্যাদির মাধ্যমে সরকার যদি আরো মনোযোগী হয়, এ খাতে আর্থিক প্রণোদনা দেয় তাহলে এই শিল্প আবার ঘুরে দাঁড়াবে।"
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "আমরা এ পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়াতে প্রশিক্ষণ, উৎপাদন ও বিপণনের উদ্যোগ নেব।"
তিনি বলেন, "আমরা সরকারকে এই শিল্পপণ্যটি ট্যাক্সমুক্ত উপায়ে বিদেশে রপ্তানির সুযোগ তৈরির এবং এর উদ্যোক্তাদের জন্য সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের পরামর্শ দেব।"