পুনর্বিমা ব্যবসার ৫০ শতাংশ চায় জীবন বীমা কর্পোরেশন 

অর্থনীতি

14 December, 2021, 01:20 am
Last modified: 14 December, 2021, 01:34 pm
এতে কর্পোরেশনের বার্ষিক আয় ৫০০-৭০০ কোটি টাকায় উন্নীত হতে পারে 

রাষ্ট্রায়ত্ত জীবন বীমা কর্পোরেশন (জেবিসি) চায়, বেসরকারি ইন্সুরেন্স কোম্পানিগুলো তাদের জীবন বিমা পলিসির অন্তত ৫০ শতাংশ তাদের কাছে পুনর্বিমা করুক। 

ইনভেস্টোপিডিয়া অনুসারে, পুনর্বিমার আওতায় বিমাকারী সংস্থা তার ঝুঁকি পোর্টফোলিওর একটি অংশ চুক্তি বা সমঝোতার আলোকে অন্য কোনো পক্ষকে হস্তান্তর করে। ফলে বিমা দাবির বিপুল অর্থ পরিশোধের আবশ্যকতা অনেকটাই কমে। 

দেশের স্থানীয় জীবন বিমাকারী বেসরকারি কোম্পানিগুলোও তৃতীয় পক্ষের কাছে রি-ইন্সুরেন্স করাচ্ছে। এক্ষেত্রে তারা বিদেশি কোম্পানিমুখী হওয়ায় বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। 

এ পরিস্থিতিতে জীবন বীমা কর্পোরেশনেই একটি নির্দিষ্ট অংশ পুনর্বিমা করানোর বাধ্যবাধকতা আরোপ চেয়ে সরকারি নির্দেশনা বা প্রজ্ঞাপন জারি করতে অর্থমন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে  প্রতিষ্ঠানটি। 

বিমা ব্যবসায় জড়িত প্রতিষ্ঠান সমূহের নিয়ন্ত্রক সংস্থা- ইন্সুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটি (আইডিআরএ) -এর মতে, দেশে বর্তমানে ৩৫টি বেসরকারি কোম্পানি জীবন বিমা ব্যবসা করছে।

আইডিআরএ'র ২০১৯ সালের প্রথম প্রান্তিকের হিসাব মতে, দেশে জীবন বিমাকারী ব্যক্তির সংখ্যা ১.০৩ কোটি।

জীবন বীমা কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. জহুরুল হক টিবিএসকে বলেছেন, এ বিমার ১০ শতাংশ রিইন্সুরেন্স যোগ্য হলে বিমা কর্পোরেশন আইন অনুযায়ী, পুনর্বিমার আওতায় পড়বে ১০ লাখ জীবন বিমা। এর ৫০ শতাংশ পুনর্বিমা কর্পোরেশনটিতে করার বাধ্যবাধকতা থাকলে, প্রতিষ্ঠানটির আয় বাড়বে ৫০০-৭০০ কোটি টাকা।

"তবে বাধ্যবাধকতা না থাকায় জীবন বিমাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কর্পোরেশনে পুনর্বিমা করছে না। এতে ক্ষতির মুখে পড়ছে জেবিসি। অন্যদিকে বিদেশে টাকা চলে যাচ্ছে, যা দেশের জন্য শুভ নয়"- বলছিলেন তিনি। 

জীবন বীমার এমডি জানান, করোনাভাইরাস মহামারিতে মৃত্যুদাবি বাড়ায় ঘাটতির মধ্যে পড়েছে কর্পোরেশন। অনেকক্ষেত্রেই বিমা দাবির অর্থ পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে। 

তাই বেসরকারি খাতে পুনর্বিমা  বাধ্যতামূলক করা হলে নিজস্ব আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটি ভালো মুনাফা করবে বলেও আশা করছে।  

বীমা কর্পোরেশন আইনে পুনর্বিমা সংক্রান্ত শর্তাবলী: 

বীমা কর্পোরেশন আইন- ২০১৯-এ বলা হয়েছে বাংলাদেশে নিবন্ধিত ও বিমা ব্যবসারত প্রত্যেক বিমাকারী সাধারণভাবে প্রচলিত ও গ্রহণযোগ্য শর্তে নিজস্ব ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত অংশের পুনর্বিমা করবে।

নন-লাইফ (জীবন বিমা ছাড়া অন্যান্য) বিমার ক্ষেত্রে পুনর্বিমাযোগ্য অংশের ৫০ শতাংশ সাধারণ বীমা কর্পোরেশনে করতে হবে। বাকি অংশ এই কর্পোরেশন বা দেশ ও দেশের বাইরে অবস্থিত কোনো কোম্পানিতে করা যাবে।

তবে জীবন বিমার ক্ষেত্রে পুন:বিমাযোগ্য অংশের বিমা করার বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। দেশে বা দেশের বাইরে অবস্থিত যেকোনো বিমার কোম্পানির কাছে এটি করার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ, জীবন বীমা কর্পোরেশনে করার বাধ্যবাধকতা নেই। 

আইনে আরও বলা হয়েছে, সরকার চাইলে জীবন বীমা কর্পোরেশনে পুনর্বিমা করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে পারবে।

মো. জহুরুল হক বলেন, "বিষয়টি ঐচ্ছিক রাখার কারণেই বেসরকারি কোম্পানি জীবন বীমা কর্পোরেশনে পুনর্বিমা করছে না। সরকার প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এটি বাধ্যতামূলক করলে কর্পোরেশনের সক্ষমতা বাড়বে। বিমার মাধ্যমে জনগণকে সুরক্ষার পাশাপাশি সঞ্চয়েও উৎসাহিত করতে পারবে।"

ঘাটতিতে জীবন বীমা কর্পোরেশন: 

স্বাধীনতার পর জীবন বিমার সুফল দেশের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের বিমা শিল্প জাতীয়করণ করা হয়।

জাতীয়করণ করার পর জীবন বিমা ব্যবসায় নিয়োজিত ৩৭টি কোম্পানির সম্পদ ও দায়-দেনা নিয়ে প্রথমে সুরমা ও রূপসা নামে দুটি কর্পোরেশন গঠিত হয়।

পরবর্তীতে উল্লিখিত কর্পোরেশন দুটির সমন্বয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে জীবন বীমা কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করেন।

মূলত সাধারণ জীবন বিমা ও গ্রুপ ইন্সুরেন্স ব্যবসায় জড়িত জীবন বীমা কর্পোরেশন। জীবন বিমা, শিশু সুরক্ষা পলিসি, বন্ধকী সুরক্ষা পলিসি, মেয়াদি গ্রুপ পলিসি ও অন্যান্যসহ মোট ৩৪টি পলিসি অফার করে প্রতিষ্ঠানটি।  

২০১৯ সালের শেষে জীবন বীমা করপোরেশনের লাইফ ফাণ্ডের পরিমাণ ২,০৪৯.৩৭ কোটি টাকা।

প্রতিষ্ঠালগ্নে জীবন বীমা কর্পোরেশন ১৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা ঘাটতি, ২১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা লাইফ ফান্ড এবং ৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা প্রিমিয়াম এবং ১৭টি বাণিজ্যিক ভবন নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে।

সারা দেশে এর মোট ৮টি আঞ্চলিক, ১২টি কর্পোরেট, ৮১টি সেলস ও ৪৫২টি শাখা অফিস রয়েছে।

প্রতিষ্ঠার কয়েক দশক পর প্রতিষ্ঠানটি আর্থিক সংকটে পড়েছে। তবে সংকটের বিস্তারিত বলতে পারেননি প্রতিষ্ঠানটির এমডি জহুরুল হক।

অর্থমন্ত্রণালয়ে দেওয়া চিঠিতে কর্পোরেশন বলেছে, জীবন বীমা  ১৯৮৪ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ১৩টি বেসরকারি বিমা কোম্পানির পুনর্বিমা সুবিধা প্রদান করেছে।

তবে বিমা করপোরেশন আইন, ১৯৯০ (সংশোধিত)- এর পর বিমা কোম্পানিগুলো বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিমা করতে শুরু করে। যা এখনো চলমান রয়েছে। এই বাস্তবতায় জীবন বীমা কর্পোরেশনের স্বার্থে পুনর্বিমা করার ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা আবশ্যক।"

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, লাইফ ইন্সুরেন্স অ্যাকচুয়ারি, হাসান স্কট অডিরনো, এফএসএ- জীবন বিমা  কর্পোরেশনের  প্রতিবেদন পূনমূল্যায়ন করে জানিয়েছে ঘাটতিতে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। রাষ্ট্রায়াত্ত প্রতিষ্ঠানটির আয় বৃদ্ধিতে পুনর্বিমায় বাধ্যবাধকতা আরোপের কোনো বিকল্প নেই বলে জানানো হয় চিঠিতে।

বাধ্যবাধকতা থাকায় সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের প্রিমিয়াম আয় বেড়েছে:

বিমা কর্পোরেশন আইন অনুযায়ী, নন-লাইফ বিমা ব্যবসার ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ সাধারণ বিমা কর্পোরেশনে পুনর্বিমায় করার বাধ্যবাধকতা প্রতিষ্ঠানটির প্রিমিয়াম আয়ে উল্লম্ফন হয়েছে।

২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটির সরাসরি প্রিমিয়াম আয়ের চেয়ে পুনর্বিমা আয় প্রায় দেড়গুণ। এতে সব ধরনের ব্যয় পরিশোধের পর সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে ৫৫ কোটি টাকা।

প্রতিষ্ঠানটির আয়-ব্যয়ের হিসাব অনুযায়ী, সরাসরি প্রিমিয়াম আয় হয়েছে ৩৭০.০৭ কোটি টাকা। আর পুনর্বিমা আয় হয়েছে ৯৩০.০৯ কোটি টাকা।

২০১৮ সালেও প্রতিষ্ঠানটির সরাসরি প্রিমিয়াম আয়ের চেয়ে পুনর্বিমা আয় ছিল অনেক বেশি।

ওই বছর সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের পুনর্বিমা আয় হয় ৭৯২.৩০ কোটি টাকা, আর সরাসরি প্রিমিয়াম আয় ছিল ৩৫১ কোটি টাকা।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.