ডলার ক্রয়ে পূবালী ব্যাংকের ২১১ কোটি টাকার অনিয়ম পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক

অর্থনীতি

18 April, 2024, 11:50 am
Last modified: 18 April, 2024, 11:54 am

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে দেখা গেছে, এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে নির্ধারিত রেটের চেয়ে বেশি দামে ডলার কিনতে পূবালী ব্যাংক একটি শাখার মাধ্যমে বাড়তি ২১১ কোটি টাকা ব্যয় করেছে।

এ প্রক্রিয়ায় বেসরকারি খাতের ব্যাংকটি সরকারি তহবিলের ৫.২৮ কোটি টাকা অপচয় করেছে—যা বাড়তি অর্থের সঙ্গে ২.৫ শতাংশ প্রণোদনা হিসেবে দেওয়া হয়েছে। 

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'পূবালী ব্যাংকের শুধু একটি শাখায় এমন অনিয়ম পাওয়া গেছে। ব্যাংকের অন্যন্য অথরাইজড ডিলার (এডি) শাখাগুলোতে পরিদর্শন করলে আরও কয়েকগুণ অনিয়ম পাওয়া যাবে মর্মে প্রতীয়মান হয়।'

ব্যাংকটি ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত কীভাবে নির্ধারিত রেটের চাইতে বেশি দামে ডলার কিনে সরকারি অর্থের অপচয় করেছে, তা উঠে এসেছে তদন্তে ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডলারের রেট যখন ১০৯ টাকা থেকে ১১০,৫০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল, পূবালী ব্যাংক তখন ১১৩ টাকা থেকে ১২৩.৬০ টাকা পর্যন্ত রেটে ডলার কিনেছে।

২০২২-এর এপ্রিল থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমতে থাকায় ও আমদানি দায় বেড়ে যাওয়ায় ডলার সংকট দেখা দেয়। তখন ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্স, আমদানি ও রপ্তানির জন্য ডলারের ভিন্ন ভিন্ন রেট দিতে শুরু করে।

এই পরিস্থিতিতে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর অ্যাসোসিয়েশন অভ ব্যাংকারস, বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনকে (বাফেদা) ডলারের রেট নির্ধারণের ক্ষমতা দেয়।

এবিবি ও বাফেদা নির্ধারিত রেটের বাইরে গিয়ে বেশ কিছু ব্যাংক অতিরিক্ত দামে রেমিট্যান্সের ডলার কিনতে থাকে। একইসঙ্গে আমদানিকারকদের কাছ থেকেও ডলারের দাম বেশি নিতে থাকে। ব্যাংকগুলোর এমন কার্যক্রমে দেশের ডলার বাজারের সংকট আরও বেড়ে যায়। একইসঙ্গে ডলারের দাম ৯০ টাকা থেকে বেড়ে সর্বোচ্চ ১২৮ টাকায়ও বেচাকেনা হয়।

সেই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোতে বিশেষ পরিদর্শন করে ছয় ব্যাংকের ট্রেজারিপ্রধানদের অপসারণের নির্দেশ দেয়। পরে অবশ্য তাদের স্বপদে ফিরে আসার সুযোগ দেওয়া হয়।

এরপর একই ঘটনার দায়ে ১০টি ব্যাংকের ট্রেজারিপ্রধানদের ১ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়। যদিও চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তাদের জরিমানা মওকুফ করা হয়।

পূবালী ব্যাংকে যেসব অনিয়ম পাওয়া গেছে

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন টিমের বিশেষ পরিদর্শনে দেখা যায়, পূবালী ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে নির্ধারিত রেটের চেয়ে বেশি দামে বৈদেশিক মুদ্রা কিনেছে। সে কারণে ব্যাংকটির একটি এডি শাখার মাধ্যমেই বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয় বাবদ ২১১ কোটি টাকা অতিরিক্ত দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, পূবালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে সেন্ট্রালাইজড ট্রেড প্রসেসিং ইউনিট কর্তৃক বৈদেশিক মুদ্রার রেট নির্ধারণ করা হলেও গ্রাহকের কাছ থেকে আমদানি বিল বাবদ অতিরিক্ত অর্থ আদায় করেছে। এতে দেখা যায়, ব্যাংকটি আমদানিকারকদের অতিরিক্ত ১৪৮ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এসব গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় করা অতিরিক্ত অর্থ মতিঝিল ফরেন এক্সচেঞ্জ শাখার একাধিক হিসাবে স্থানান্তর করে পূবালী ব্যাংক। সেখানে ব্যাংকটি অনুমোদন না নিয়েই বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোর নামে সাতটি হিসাব খোলে। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এসব অনিয়ম পাওয়ার পর পূবালী ব্যাংকের অন্যন্য শাখাগুলোতেও বিস্তর পরিদর্শন চায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন টিম। কিন্তু একজন ডেপুটি গভর্নর নতুন করে পরিদর্শন আটকে দেন। একইসঙ্গে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি।

পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ আলী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা সবকিছু নিয়মের মধ্যে থেকেই করেছি। রেমিট্যান্স কিনতে হলে তো এক্সচেঞ্জ হাউসের অ্যাকাউন্টে লেনদেন হবেই।'

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে অনিয়মের বিষয়টি নিয়ে কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। 'এমনটা যদি থেকে থাকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে মন্তব্য জানুন।'

যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন এক্সচেঞ্জ হাউজের নামে খোলা সাতটি হিসাবের মধ্যে চারটির জন্য তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিলাচকের (চলতি দায়িত্ব) অনুমোদন পেয়েছিল পূবালী ব্যাংক। এছাড়া বাকি তিনটি হিসাব কার অনুমোদনে খোলা হয়ছে, তা স্পষ্ট নয়।

পূবালী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শাহাদত হোসেন অতিরিক্ত দামে ডলার কেনার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। 

তিনি টিবিএসকে বলেন, গত দেড় বছর ধরে ডলারের রেট নির্ধারণ করা ছিল, আসলে বাস্তব মার্কেট রেট ছিল তার চেয়ে বেশি। সে কারণে অনেক ব্যাংককেই বেশি দামে ডলার কিনতে হয়েছে।

শাহাদত হোসেন আরও বলেন, 'আমাদের ব্যাংকের মাধ্যমে আমদানি কার্যক্রম পরিচালনা করেন, এমন ব্যাপক আমদানিকারক রয়েছে। তাদের আমদানি দায় মেটানোর জন্য সেই সময়ে বাফেদার নির্ধারিত দামে ডলার পাওয়া যাচ্ছিল না, তাই আমাদেরও কিছুটা বেশি দাম দিয়ে ডলার কিনতে হয়েছে।'

তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের ডলার কেনাবেচা নিয়ে পরিদর্শন করেছেন। তারা পরবর্তীতে আমাদের যে পরামর্শ দিয়েছে, সেই অনুযায়ীই আমরা এখন ডলার কেনাবেচা করছি।

'আমরা এখন বাজারের রেট অনুযায়ী ডলার কেনার কারণে রেমিট্যান্স অনেক কম আসছে। আগে আমরা যে পরিমাণে রেমিট্যান্স পেতাম, এখন তার তুলনায় অনেক কম রেমিট্যান্স পাচ্ছি। কারণ যাদের রেমিট্যান্স বেশি আসছে, তাদেরকে বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে।'

তিনি অবশ্য বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউসের নামে তাদের অনুমোদন ছাড়াই অ্যাকাউন্ট খোলার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, 'আমরা তাদের অনুমোদন নিয়েই অ্যাকাউন্ট খুলেছি এবং সেইসব অ্যাকাউন্টে লেনদেন হয়েছে।'

যেসব এক্সচেঞ্জ হাউসের নামে হিসাব খোলা হয়েছে

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, পূবালী ব্যাংক বেশি দামে ডলার কেনার জন্য বিভিন্ন এক্সচেঞ্জ হাউসের নামে খোলা সাতটি হিসাব দিয়ে লেনদেন করেছে।

অ্যারাবিয়ান এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে ১৫.২ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স কিনেছে পূবালী ব্যাংক। এ সময় বাজারের রেট ১০৯.৫০ থেকে ১১০ টাকা হলেও ব্যাংকটি ডলার কিনেছে সর্বোচ্চ ১১৭ টাকায়। এতে ব্যাংকটিকে অতিরিক্ত ৭.৫৫ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে।

মার্চেনট্রেডকে ৫৫.২ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্সে সর্বোচ্চ ১২৩ টাকা পর্যন্ত রেট দিয়েছে ব্যাংকটি। যার কারণে অতিরিক্ত পরিশোধ করতে হয়েছে ৪০ কোটি টাকা।

গালফ ওভারসিজ এক্সচেঞ্জকে ৪৮.৭ মিলিয়ন ডলারের বিপরীতে ব্যাংকটি সর্বোচ্চ রেট দিয়েছে ১২২ টাকা, যার বিপরীতে অতিরিক্ত পরিশোধ করেছে ২৬ কোটি টাকা।

পূবালী ব্যাংক ইউনিভার্সাল এক্সচেঞ্জ সেন্টার থেকে ৭.৭ মিলিয়ন ডলার কিনেছে সর্বোচ্চ ১২২.৫০ টাকা দরে। এতে অতিরিক্ত পরিশোধ করতে হয়েছে ৬.১৯ কোটি টাকা।

এছাড়া এনবিএল মানি ট্রান্সফারের মাধ্যমে ৪.৫ মিলিয়ন ডলার কিনেছে ব্যাংকটি। এতে সর্বোচ্চ রেট ছিল ১১৭.৫০ টাকা, যার কারণে ২.৪২ কোটি টাকা অতরিক্ত পরিশোধ করতে হয়েছে।

ব্যাংকটি কন্টিনেন্টাল এক্সচেঞ্জ সলিউশনস-এর (আরআইএ) মাধ্যমে ১.০৬ মিলিয়ন ডলার কিনেছে। এতে সর্বোচ্চ রেট ছিল ১২৩.৬০ টাকা, যার বিপরীতে অতিরিক্ত খরচ হয়েছে ১১০ কোটি টাকা।

এছাড়া মাল্টিনেট ট্রাস্ট এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে ৫.৮৬ কোটি দিরহাম রেমিট্যান্স কিনেছে পূবালী ব্যাংক। এতে নির্ধারিত রেট ছিল ২০.০৮ টাকা; কিন্তু ব্যাংকটি রেমিট্যান্স কিনেছে সর্বোচ্চ ৩৩.২১ টাকা দামে। এতে বাড়তি খরচ হয়েছে ১৭.৮৫ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক টিবিএসকে বলেন, 'আমরা বেশ কিছু ব্যাংককে ডলার কেনাবেচায় অনিয়মের কারণে জরিমানা করেছি। যদিও সম্প্রতি তাদের জরিমানা আবার মওকুফ হয়েছে। পূবালী ব্যাংকের ক্ষেত্রে তাদের অনিয়মে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে পদক্ষেপ নেয়ার অধিকার ছিল, সেটাই করেছে।'

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শনে আরও যা রয়েছে

পূবালী ব্যাংক বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে আমদানিকারকদের কাছ থেকে যে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করেছে, তা মতিঝিল ফরেন এক্সচেঞ্জ শাখায় সাত এক্সচেঞ্জ হাউসের নামে খোলা সাতটি হিসাবের বাইরেও ব্যাংকের অন্যান্য শাখার ভিন্ন ভিন্ন হিসাবে, এমনকি বিভিন্ন গ্রাহকের হিসাবেও স্থানন্তর করা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, পূবালী ব্যাংকের বরিশাল হসপিটাল রোড শাখার একটি ঋণপত্রের (এলসি) বিপরীতে অতিরিক্ত ৫৬ হাজার ৮৫০  টাকা আদায় করা হয়েছে। এছাড়া এমন অসংখ্য লেনদেন হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন টিমের একজন সদস্য টিবিএসকে জানিয়েছেন।

পরিদর্শন টিমের ওই সদস্য বলেন, পূবালী ব্যাংকের সঙ্গে শারমিন গ্রুপের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ব্যাপক পরিমাণে লেনদেনের হিসাব রয়েছে। এসব অনিয়মের বিষয়ে বিস্তর পরিদর্শনের আলোচনা হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর এ বিষয়ে আর পরিদর্শনের অনুমোদন দেননি।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.