‘এক্সিম ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারবেন পদ্মা ব্যাংকের গ্রাহকেরা’: এক্সিম ব্যাংক চেয়ারম্যান

অর্থনীতি

টিবিএস রিপোর্ট
19 March, 2024, 09:10 am
Last modified: 19 March, 2024, 10:27 am
একীভূতকরণ প্রক্রিয়া শেষ হতে অন্তত ১২–১৮ মাস বা তার বেশি সময়ও লাগতে পারে।

আজ মঙ্গলবার (১৯ মার্চ) থেকে পদ্মা ব্যাংক আর না থাকলেও ব্যাংকটির আমানতকারীরা এক্সিম ব্যাংকের মাধ্যমে তাদের টাকা তুলতে পারবেন।

সোমবার (১৮ মার্চ) পদ্মা ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পর এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, পদ্মা ব্যাংকের আমানতকারীদের কোনো সমস্যা হবে না এবং তাদের আমানত নিরাপদ থাকবে।

তিনি আরও বলেন, 'পদ্মা ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার কারণে নতুন কার্যক্রম পরিচালিত হবে এক্সিম ব্যাংকের নামে।'

এক্সিম ব্যাংক এখন পদ্মা ব্যাংকের সমস্ত দায়ভার গ্রহণ করবে এবং ব্যাংকটির সব দেনা পরিশোধ করবে বলেও জানান তিনি। এছাড়া পদ্মা ব্যাংকের সকল জনবল, বিনিয়োগকারী এবং শেয়ারহোল্ডারদের দায়িত্ব নিয়েছে এক্সিম ব্যাংক।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)-এর চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার স্পষ্ট করে বলেন, একীভূত করার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো চাপ ছিল না। 'তবে সরকারের পক্ষ থেকে পরামর্শ ছিল। আমরা এটা করেছি দেশের ও দেশের অর্থনীতির স্বার্থে।'

শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকিং প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এক্সিম ব্যাংক শরিয়াভিত্তিক। যেহেতু পদ্মা ব্যাংক এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হচ্ছে, তাই এটিও শরিয়াভিত্তিক বিধিমালা মেনে চলবে।

এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান স্পষ্ট করে উল্লেখ করেন, তারা পদ্মা ব্যাংককে অধিগ্রহণ নয়, একীভূত করছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের উপস্থিতিতে এ সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। দুই ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।

পদ্মার দায়

২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পদ্মা ব্যাংকের চার হাজার ৫৪ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে। এর শ্রেণিবদ্ধ ঋণের পরিমাণ এক হাজার ৮৮১ কোটি টাকা। এছাড়া সরকারি ব্যাংকগুলোর প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে পদ্মা ব্যাংকে।

এ বিষয়ে নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, এখন পদ্মা একীভূত হওয়ায় পদ্মা ব্যাংকের সব দায়-দায়িত্ব এক্সিম ব্যাংক গ্রহণ করেছে।

২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষে পদ্মা ব্যাংকের মোট আমানত ছিল ছয় হাজার ১৮৬ কোটি টাকা।

এর মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত এক হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) এক হাজার কোটি টাকা এবং জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের ৭৬০ কোটি টাকা। এ ছাড়া বাকি এক হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি আমানত হচ্ছে জীবন বীমা করপোরেশন, সাধারণ বীমা করপোরেশন, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, তিতাস গ্যাস, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি), মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ অবকাঠামো ফিন্যান্স ফান্ড লিমিটেড (বিআইএফএফএল), ইসলামিক ফাউন্ডেশন, নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের।

গত কয়েক বছরে ব্যাংকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ৮৭৪ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে। এর মধ্যে ২০২২ সালে ২২৪ কোটি টাকা ও ২০২৩ সালে ৮০ কোটি টাকা ফেরত দেওয়া হয়।

তবে অনেক প্রতিষ্ঠান এখনও তাদের আমানত ফেরত নিতে অপেক্ষা করছে। অনেক আমানতকারী ব্যাংকটি থেকে সুদও পাচ্ছে না। যেমন জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের ৭৬১ কোটি টাকা পদ্মা ব্যাংকে আটকে আছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বিনিয়োগের অবস্থা

পদ্মা ব্যাংকে সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন বিনিয়োগও এক্সিম ব্যাংক পরিচালনা করবে বলে জানান নজরুল ইসলাম মজুমদার।

'উনারা [সরকারি ব্যাংকগুলো] যদি [বিনিয়োগ] রেখে দেয় রাখবে, না রাখলে চলে যাবে। এক্সিম ব্যাংকের তো ৪৭ হাজার কোটি টাকার আমানত আছেই, তাই এসব বিনিয়োগ পরিচালনা করতে কোনো অসুবিধা নেই,' তিনি আশ্বস্ত করে বলেন।

সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম তাদের বিনিয়োগের পুরো টাকা ফেরত পাওয়ার আশা প্রকাশ করেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করছে বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, 'আজ শুধু সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এ প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হতে সময় লাগবে।'

পদ্মা ব্যাংকের জনবল

পদ্মা ব্যাংকের চাকরিজীবীদের বিষয়ে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, তিন বছর কোনো কর্মী চাকরি হারাবেন না, তবে সেটা নির্ভর করবে তাদের পারফরম্যান্সের ওপর।

'পদ্মা ব্যাংকের মানবসম্পদ যেটা রয়েছে — প্রায় এক হাজার ২০০ কর্মী (যদিও পদ্মা দাবি করেছে ৭৯৫ জন) — তাদের কারও চাকরি যাবে না। সবাই কর্মরত থাকবেন এক্সিম ব্যাংকের হয়ে। আমাদের আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডারদের কোনো ক্ষতি হবে না; সবকিছু আগের মতোই চলবে,' বলেন তিনি।

তবে পদ্মা ব্যাংকের পরিচালকেরা এক্সিম ব্যাংকের পর্ষদে থাকতে পারবেন না জানিয়ে তিনি বলেন, পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) পদত্যাগ করতে হবে।

সাধারণত অধিগ্রহণকৃত ব্যাংকের এমডি অধিগ্রহণের পরে পদত্যাগ করেন।

যা বলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, একীভূতকরণের ফলে খেলাপিরা যাচাই-বাছাই এড়াতে পারবেন না।

'দুটি অডিট ফর্ম নিয়োগ করা হবে। অডিটের মাধ্যমে পরিচালকদের দায়-দেনাও উঠে আসবে। আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আমরা সামনের দিকে এগোব,' বলেন তিনি।

মুখপাত্র ব্যাখ্যা করে বলেন, দুটি ব্যাংক এখন একীভূতকরণ চুক্তিতে পৌঁছেছে। তারা এরপর তাদের আবেদন জমা দেবে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক তাদের প্রস্তাব অনুমোদনের পর একীভূতকরণের কাজ এগিয়ে যাবে। নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমতি পেলে পদ্মা ব্যাংক ভেঙে দেওয়া হবে। ততদিন পর্যন্ত উভয় ব্যাংকের কার্যক্রম স্বাভাবিক থাকবে।

'ব্যাংক পর্যায়ে কাজ শেষ হলে আদালত এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কিছু কাজ আছে। এ প্রক্রিয়াগুলো শেষ হলে বাকি কাজ দ্রুত শেষ করা হবে,' তিনি আরও বলেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ভালো ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকের একীভূত কার্যক্রম সম্পন্ন করতে শিগগিরই একটি নীতিমালা প্রণয়ন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেই নীতিমালার আওতায় একীভূত হওয়ার কার্যক্রম সম্পন্ন হবে।

এ প্রক্রিয়া শুরু হলেও তা শেষ হতে অন্তত ১২–১৮ মাস বা তার বেশি সময়ও লাগতে পারে।

দুই ব্যাংক

এক্সিম ব্যাংকের ১৬৮টি শাখা এবং পদ্মা ব্যাংকের ৬০টি শাখা ও ১৪টি উপ-শাখা রয়েছে। একীভূত হওয়ার পর এক্সিম ব্যাংক প্রায় ২৫০টি শাখার একটি ব্যাংকে রূপান্তরিত হবে। এতে করে শাখাভিত্তিক নেটওয়ার্কের পরিপ্রেক্ষিতে পূবালী এবং ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের পরেই হবে এর অবস্থান।

১৯৯৯ সালে যাত্রা শুরু করা এক্সিম ব্যাংক বর্তমানে একটি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক। ব্যাংকটি ২০০৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়।

অন্যদিকে অতীতে ফারমার্স ব্যাংক নামে পরিচিত পদ্মা ব্যাংক ২০১৩ সালে অনুমোদন পেয়েছিল। চালু হওয়ার কয়েক বছরের মাথায় এটি বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির সম্মুখীন হয়। সে সময় ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর।

এরপর ২০১৭ সালে ব্যাংকের পর্ষদে বড় পরিবর্তন আসে। ফারমার্স ব্যাংকের নাম পরিবর্তন করে পদ্মা ব্যাংক রাখা হয় এবং বেশ কয়েকটি সরকারি ব্যাংক ও সংস্থা এই ব্যাংকের মালিকানায় অংশীদার হয়।

তবে খেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায় না হওয়ায় সরকারি বিনিয়োগ ব্যাংকটির মূলধন ক্ষয় রোধ করতে পারেনি।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.