কর ব্যবস্থায় ধারাবাহিকতা না থাকা বিনিয়োগে বাধা: ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ

অর্থনীতি

টিবিএস রিপোর্ট
11 March, 2024, 09:50 am
Last modified: 11 March, 2024, 12:13 pm
কর বিষয়ে নীতিগত ধারাবাহিকতা না থাকার কারণে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে না বলে মনে করেন ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ।

প্রত্যাশিত বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ অর্জনে ব্যর্থতার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ (এনবিআর) বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের নীতিমালায় ধারাবাহিকতা না থাকাকে দায়ী করেছেন ব্যবসায়ী নেতারা।

একইসঙ্গে তারা জটিল কর ব্যবস্থা, অটোমেশনের অভাব, উচ্চ কর ও শুল্ক, কর সমন্বয়ের ক্ষেত্রে সীমিত নমনীয়তা, আমদানি করের ওপর অত্যধিক নির্ভরতা এবং ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের অভাবকে ব্যবসা ও বিনিয়োগের প্রধান বাধা হিসাবে দায়ী করেছেন।

রোববার (১০ মার্চ) রাজধানীর একটি হোটেলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি আয়োজিত প্রাক-বাজেট সভায় নীতিনির্ধারকেরাও এ বিষয়গুলো স্বীকার করেন।

'প্রাক বাজেট আলোচনা ২০২৪-২৫' শীর্ষক ওই সভায় উপস্থিত অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, আগামী বাজেট বেসরকারি খাতের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক হবে।

দেশের উন্নয়নে বেসরকারি খাত মুখ্য ভূমিকা পালন করছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সরকার বেসরকারি খাতকে সুবিধা দিতে দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যাতে তারা জটিলতা ছাড়া তাদের ব্যবসা পরিচালনা করতে পারে।

মাহমুদ আলী আরও বলেন, সরকার আগামী বাজেটে প্রয়োজনীয় নীতি সংস্কারের বিষয়টি ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করবে।

ইউনিলিভার বাংলাদেশ-এর হেড অব ট্যাক্সেশন সাঈদ আহমেদ খান, স্থানীয় বা বিদেশি বিনিয়োগ – যেকোনো বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারী দেখেন স্থিতিশীলতা, ইজ অব ডুয়িং বিজনেস, নীতিমালার ধারাবাহিকতা ও প্রকৃত করহারকে অগ্রাধিকার দেন।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নীতিমালার সঙ্গে রাজস্ব বোর্ডের কর নীতিমালার মিল নেই।

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, বিডা যে পরিমাণ ব্যয় অনুমোদন করে, এনবিআর তা করে না।

তিনি আরও বলেন, 'আইনের একটি ধারায় যে পরিমাণ ব্যয় করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, অন্য ধারায় তা অনুমোদন করা হচ্ছে না।'

অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মূখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদও নীতিগত ধারাবাহিকতা না থাকার কারণে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে না বলে মত প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং ছাড় দেওয়ার মতো প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ধারাবাহিক কর নীতিমালার অভাবে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে না।

তিনি বলেন, বিনিয়োগের আগে বিদেশিরা কর বিষয়ক নীতিমাল জানতে চান। কারণ যেকোনো বিনিয়োগের আগে তারা সাধারণত তিন থেকে পাঁচ বছরের পরিকল্পনা নিয়ে আসেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন, স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা অনেক অনিশ্চয়তার মধ্যেও বিনিয়োগ করেন, কিন্তু বিদেশিরা সেটা করবেন না।

সভায় ব্যবসায়ী নেতা ও অর্থনীতিবিদেরাও কার্যকর করের বিষয়টি উত্থাপন করেন।

দেশে গত তিনবছরে কর্পোরেট করহার কমানো হলেও ন্যূনতম করের প্রয়োজনীয়তা এবং সীমিত ব্যয় কর্তনের কারণে কোম্পানিগুলো সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে পারছে না।

বর্তমানে অ-তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর সাড়ে ২৭ শতাংশ হলেও প্রকৃত করহার প্রায়ই ৪০ শতাংশের ওপরে চলে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেছেন স্থানীয় ও বিদেশি উভয় বিনিয়োগকারীরা।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশের গড় আমদানি শুল্ক অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশের তুলনায় বেশি। কিছু কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রেও আমদানি কর বেশি বলে ব্যবসায়ীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

প্রাক-বাজেট সভাটি ৪টি গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশনে বিভক্ত ছিল: কর ও ভ্যাট, আর্থিক খাত, অবকাঠামো খাত এবং শিল্প ও বাণিজ্য খাত। সভা সঞ্চালনা ও সভাপতিত্ব করেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আশরাফ আহমেদ।

'সহজ কর প্রক্রিয়া সহজ নয়'

এনবিআরের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রাহমাতুল মুনিম বলেন, কর প্রদানের প্রক্রিয়া সহজ করা সহজ মনে হলেও এটি বাস্তবায়ন করা চ্যালেঞ্জিং, কারণ রাজস্ব আহরণের বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে।

তা সত্ত্বেও, তিনি বলেন, গত তিনবছরে কর্পোরেট কর কমিয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে এবং ব্যক্তিগত কর ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে।

মুনিম 'মেড ইন বাংলাদেশ' ধারণা প্রচার করার এবং স্থানীয়ভাবে ব্যবহৃত পণ্য উৎপাদনকে উৎসাহিত করে আমদানি নির্ভরতা কমানোর উদ্দেশ্যে স্থানীয় শিল্পের প্রতি এনবিআর-এর সহায়তার কথা তুলে ধরেন।

'মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভোক্তাদের ব্যবহৃত পণ্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদনে উৎসাহিত করার জন্য খুঁজে খুঁজে সাপোর্ট [সহায়তা] দিচ্ছি, যাতে আমদানি নির্ভরশীলতা কমানো যায়। এর ফলে কিছু ইলেক্ট্রনিকস পণ্য এখন ৯৫ শতাংশ স্থানীয় কোম্পানিগুলো সরবরাহ করছে,' বলেন তিনি।

অনেকেই কর না দিতে পছন্দ করেন বলে মুনিম নতুন করদাতা খুঁজে বের করার চ্যালেঞ্জের কথা স্বীকার করেন। তবে তিনি ট্যাক্স-টু-জিডিপির অনুপাত দ্রুত উন্নত করতে চান বলে জানান।

ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে উদ্বেগ

সভায় ব্যবসায়ী নেতা এবং অর্থনীতিবিদেরা দুর্বল ও সবল ব্যাংকগুলোকে চাপ দিয়ে একীভূতকরণের বিরুদ্ধে সতর্ক করেন।

আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি আফতাব-উল ইসলাম বলেন, 'ব্যাংকের মার্জার [একীভূতকরণ] নিয়ে মানুষের মধ্যে ভীতি আছে, কনফিউশন [বিভ্রান্তি] আছে। কারণ দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে মার্জার হলে কী ধরনের সমস্যা হবে সে প্রশ্ন আছে।'

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. আমিনুল ইসলামও বলেন, একীভূতকরণ নিয়ে আতঙ্ক রয়েছে। 'তাড়াহুড়ো না করে একটি ব্যাংক কমিশন গঠন করে তাদের মতামতের ভিত্তিতে মার্জার করা উচিত,' বলেন তিনি।

ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করুন

ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি এবং ব্যবসায় বিনিয়োগ না করে বিদেশে পাচার করা ব্যক্তিদের নাম প্রকাশের আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, তাদের নাম প্রকাশ করা হলে তারা সামাজিকভাবে চাপের মধ্যে পড়বেন এবং ওই টাকা পরিশোধে বাধ্য হবেন।

অর্থমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে আজাদ বলেন, 'ব্যাংক থেকে বলা হচ্ছে ডলার ১০৯ টাকা। কিন্তু আমরা কিনছি ১২৪ টাকায়। এনবিআর আমাদের আমদানি করা পণ্যের ওপর কর আদায় করছে ১২৪ টাকা হিসাব করে।'

এ অবস্থার জন্য ব্যবসায়ীদের দোষ দেওয়ার সমালোচনা করেন তিনি।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.