ধীরগতির ৮ প্রকল্পে আটকে আছে বিশ্বব্যাংকের ১.৬ বিলিয়ন ডলার

অর্থনীতি

20 February, 2024, 09:35 am
Last modified: 20 February, 2024, 12:00 pm
‘হায়ার এডুকেশন এক্সিলারেশন অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন প্রজেক্ট’ শীর্ষক প্রকল্পের অর্থছাড়ের পরিস্থিতি সবচেয়ে করুণ। এ প্রকল্পের জন্য প্রতিশ্রুত সম্পূর্ণ ১৯১ মিলিয়ন ডলার এখনো অব্যবহৃত রয়ে গেছে।

ইনফোগ্রাফিক: টিবিএস

৮টি প্রকল্পের জন্য ২০১৩ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে অনুমোদিত বিশ্বব্যাংকের প্রায় তিন বিলিয়ন ডলারের তহবিলের অর্ধেকেরও বেশি অনুমোদন, পরামর্শদাতা নিয়োগ, ক্রয় প্রক্রিয়া ও কাজ শুরুর বিলম্বের জন্য এখনো আটকে রয়েছে। ঋণদাতা গোষ্ঠীটির তৈরি করা প্রকল্পের বিবরণ থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

বিলম্বের একাধিক কারণের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে মতবিরোধ, বেসরকারি সংস্থাগুলোর বিরোধিতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর ফলে তহবিলের সময়সীমা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার পাশপাশি কিছু ক্ষেত্রে প্রকল্প আংশিক বাতিলের ঝুঁকিতে পড়েছে।

রোববার বিশ্বব্যাংক, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর উপস্থিতিতে এক সভায় প্রকল্পের বিবরণসমূহ পর্যালোচনা করা হয়।

বিশ্বব্যাংকের অপারেশনাল ম্যানেজার গেইল মার্টিন এবং ইআরডির অতিরিক্ত সচিব মোস্তাফিজুর রহমান ত্রিপক্ষীয় পোর্টফোলিও পর্যালোচনা সভায় নিজ নিজ পক্ষের নেতৃত্ব দেন। সভার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অর্থছাড়ের ক্ষেত্রে সাধারণ অবকাঠামো খাতের প্রকল্পগুলো আর্থ-সামাজিক প্রকল্পের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে।

যেমন ৮টি প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে বড়টি হচ্ছে ৮৪৫ মিলিয়ন ডলারের দরিদ্রদের নিরাপত্তা বেষ্টনী প্রকল্প। এ প্রকল্পে গত নয় বছরে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি অর্থ ছাড় হয়েছে। বর্তমানে কেবল ৫৩ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ের বাকি রয়েছে।

অন্যদিকে ডিজিটাল গভর্নেন্সের জন্য ২৯৫ মিলিয়ন ডলারের প্রকল্পটি শুরু হওয়ার প্রায় চার বছর পরেও ২৬৪ মিলিয়ন ডলার এখনো অব্যবহৃত রয়েছে।

ইআরডি'র একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বৈঠকে সব প্রকল্প নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো বিলম্বের ব্যাখ্যা দিয়েছে এবং বিশ্বব্যাংক তাদের পর্যালোচনা উপস্থাপন করেছে।

ওই কর্মকর্তা বলেন, 'উভয় পক্ষই বাস্তবায়নসংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলো সমাধান করতে সম্মত হয়েছে। আগামী এক থেকে দুই মাসের মধ্যে তারা যৌথভাবে তহবিল বিতরণের নতুন পরিকল্পনা তৈরি করবে।'

অর্থনৈতিক রূপান্তর প্রকল্প

১০ লাখ যুবকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির লক্ষ্যে ২০২১ সালের ২০ মে 'অ্যাক্সিলারেটিং অ্যান্ড স্ট্রেংদেনিং স্কিলস ফর ইকোনমিক ট্রান্সফরমেশন প্রজেক্ট'-এর জন্য বিশ্বব্যাংক ৩০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন করে।

ধীরগতির আট প্রকল্পের মধ্যে একটি এ প্রকল্পের মোট ঋণের ৯০ দশমিক ৬৬ শতাংশ তথা ২৭২ মিলিয়ন ডলার এখনো ছাড় হয়নি।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে কর্মীসংখ্যা এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতার সীমাবদ্ধতাকে তহবিল আটকে যাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া দেশীয় রিজার্ভের ওপর সামষ্টিক অর্থনৈতিক চাপ প্রকল্পটি বিলম্বিত করছে।

ঋণদাতা গোষ্ঠীটি বলেছে, এ প্রকল্পের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নেতৃত্ব, শক্তিশালী তদারকি এবং সমস্ত স্তরে প্রকল্পের কার্যক্রমের সমন্বয় প্রয়োজন।

প্রকল্প পরিচালক আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সফটওয়্যারের সমস্যার কারণে কাজ বিলম্বিত হয়েছে। বিষয়টি সমাধানের জন্য একটি নতুন বিকল্প পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে।

'এছাড়া সরকারের ৩৫ শতাংশ তহবিল দেওয়ার কথা ছিল — প্রশিক্ষকের খরচসহ বাকি ৬৫ শতাংশ দেবে বিশ্বব্যাংক। তবে বিশ্বব্যাংকের নীতিগত সীমাবদ্ধতার কারণে এ ব্যবস্থার পুনর্গঠন প্রয়োজন,' তিনি ব্যাখ্যা করেন।

তিনি আরও বলেন, আগামী তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে এ প্রকল্পে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে তহবিল ছাড়ের আশা করা হচ্ছে।

ইনফোগ্রাফিক: টিবিএস

ডিজিটাল উদ্যোক্তা প্রকল্প

'প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড ডিজিটাল এন্টারপ্রেনারশিপ প্রজেক্ট' শীর্ষক আরেকটি প্রকল্প বিশ্বব্যাংক থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণের প্রতিশ্রুতিসহ ২০২০ সালের ১৯ জুন অনুমোদন পায়।

তবে ধীরগতির বাস্তবায়নের কারণে প্রকল্পের ৮৫ দশমিক ৮ শতাংশ তথা ৪২৯ মিলিয়ন ডলার অর্থ এখনো ছাড় হয়নি।

এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের প্রত্যক্ষ বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণ ও পৃষ্ঠপোষকতা এবং নির্বাচিত সরকারি ও বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল ও সফটওয়্যার প্রযুক্তি পার্কগুলোতে সামাজিক ও পরিবেশগত মানদণ্ডকে শক্তিশালী করা।

বিশ্বব্যাংকের মতে, প্রকল্পটি অনুমোদনের পর ১৩ মাস সময় লেগেছে বাস্তবায়ন শুরু করতে। পরে পরামর্শক নিয়োগ, নকশা প্রণয়ন, দরপত্রের নথি তৈরিতেও বিলম্ব হয়।

প্রকল্প পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ফারুক বলেন, বাস্তবায়ন শুরু করার আগে কাগজপত্র তৈরি করতে অনেক সময় লেগেছে এবং ক্রয় প্রক্রিয়ার জন্য কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রেও চ্যালেঞ্জ ছিল।

'বিশ্বব্যাংক পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সহনশীলতা ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন নথি পরীক্ষা করে। এর ফলে দেড় বছর বিলম্ব হয়েছে। এছাড়া ডেলিগেশন কাজের ক্ষেত্রে সমস্যা ছিল, ফলে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে আপত্তি আসে। এতে আরও এক বছর বিলম্ব হয়েছে,' তিনি বলেন।

'প্রকল্পটি ত্বরান্বিত করতে একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য এপ্রিলে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আরেকটি বৈঠক হবে,' জানান তিনি।

উচ্চশিক্ষার গতি বাড়ানোর প্রকল্প

'হায়ার এডুকেশন এক্সিলারেশন অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন প্রজেক্ট' শীর্ষক প্রকল্পের অর্থছাড়ের পরিস্থিতি সবচেয়ে করুণ। এ প্রকল্পের জন্য প্রতিশ্রুত সম্পূর্ণ ১৯১ মিলিয়ন ডলার এখনো অব্যবহৃত রয়ে গেছে।

বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংক ২০২১ সালের ২৪ জুন এ প্রকল্পটি অনুমোদন করে। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো একই মানের প্রোগ্রাম, ক্রেডিট ট্রান্সফার স্কিম এবং ইউনিভার্সিটি টুইনিংয়ের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষায় সহযোগিতা।

তহবিলের জন্য ঋণদাতা সংস্থার অনুমোদনের পর প্রকল্পটি অনুমোদন করতে বাংলাদেশের দুই বছর সময় লেগেছিল। এছাড়া পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালক ও অন্যান্য প্রকল্প কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রেও দেরি হয়েছিল।

আধুনিক খাদ্য সংরক্ষাণাগার প্রকল্প

আরেকটি ধীর গতির প্রকল্প 'মডার্ন ফুড স্টোরেজ ফ্যাসিলিটিস প্রজেক্ট'-এর জন্য ৪১২ মিলিয়ন ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো দুর্যোগ-পরবর্তী চাহিদা মেটাতে এবং শস্যসঞ্চয় ব্যবস্থাপনার দক্ষতা উন্নয়নে পারিবারিক পর্যায়ে শস্যদানার মজুত বৃদ্ধি করা।

২০১৩ সালে অনুমোদিত এ প্রকল্পে এখনো ১৩৮.৭৬ মিলিয়ন ডলার ছাড় বাকি আছে।

বিশ্বব্যাংক বলেছে, বড় আকারের অবকাঠামো উন্নয়ন চুক্তির জন্য দীর্ঘায়িত ক্রয় প্রক্রিয়ার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়েছে। এছাড়া দুর্বল কর্মক্ষমতা এবং ঠিকাদারদের আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে সাইলো নির্মাণে বিলম্ব হয়েছে।

প্রকল্প পরিচালক মো. রেজাউল করিম শেখ বলেন, তারা ডিসেম্বরের মধ্যে পুরো কাজ শেষ করার পরিকল্পনা করছেন।

'সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তদারকি করা হবে। পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকও এর কারিগরি দলের সঙ্গে বাস্তবায়ন তদারকি করবে,' তিনি আরও বলেন।

গ্রামীণ সেতু প্রকল্প

২০১৮ সালে বিশ্বব্যাংক 'অপারেশন ফর সাপোর্টিং রুরাল ব্রিজেস' প্রকল্পের জন্য ৩৪০ মিলিয়ন ডলার অনুমোদন করে। এ প্রকল্পের লক্ষ্য সংযোগ ও জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতার জন্য গ্রামীণ সেতুগুলোর উন্নয়ন ও সংরক্ষণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করা।

তবে এ প্রকল্পেও ২০২ মিলিয়ন ডলার (৫৯%) তহবিল এখনো পড়ে রয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড মহামারির প্রথম দুই বছরে প্রকল্পের প্রস্তুতিতে দেরি হয়েছিল। এছাড়া নিয়োগকৃত ব্রিজ ডিজাইন কনসালট্যান্টের কর্মক্ষমতার ঘাটতি ছিল।

নির্মাণসামগ্রীর ঘাটতির কারণে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় প্রকল্পটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে সেতু প্রতিস্থাপনের জন্য জমি অধিগ্রহণের সমস্যা ছিল।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.