‘লোহিত সাগরে অস্থিরতায় বাংলাদেশের ৪০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হুমকির মুখে’

অর্থনীতি

27 January, 2024, 10:35 am
Last modified: 27 January, 2024, 11:23 am
ঘুরপথ ব্যবহার করায় ইতিমধ্যে শিপিং লাইনগুলো আপৎকালীন সারচার্জ হিসেবে প্রায় ৪০ শতাংশ অতিরিক্ত চার্জ বৃদ্ধি করেছে। এই পথ ব্যবহারকরে বাংলাদেশের ৪ হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্যে এখন যুক্ত হচ্ছে বাড়তি ব্যয়, যা কোনো না কোন ভাবে দেশের ভোক্তা পর্যায়ে বহন করতে হবে।

খায়রুল আলম সুজন। স্কেচ: টিবিএস

লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে ইয়েমেনের বিদ্রোহী হুথি গোষ্ঠীর ক্রমাগত হামলায় এশিয়া থেকে ইউরোপ-আমেরিকাগামী জাহাজগুলো বিকল্প পথ ব্যবহার করছে। ঘুরপথে জাহাজ পরিচালনা করতে গিয়ে লাগছে বাড়তি সময় ও খরচ। ইতিমধ্যে জাহাজগুলো আপৎকালীন সারচার্জ যোগ করেছে। প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে পণ্য পরিবহন খরচ। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী সমুদ্র পথে ভেঙে পড়েছে সাপ্লাই চেইন। বিশ্ব অর্থনীতিতে পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব। 

সুয়েজ খাল পাড়ি দিয়ে পণ্য পরিবহনের চলমান সংকট, বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাবসহ বাংলাদেশ এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিস্থিতি নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) ভাইস প্রেসিডেন্ট খায়রুল আলম সুজন। 

আমদানি-রপ্তানি পণ্য গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন হলো বাফা। বিশেষ করে রপ্তানিকারকদের হাত থেকে ডিপোতে রপ্তানি পণ্য বুঝে নিয়ে বিদেশি ক্রেতাদের নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছে দেয় এই সংগঠনের সদস্যভুক্ত ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। 

মঙ্গলবার টিবিএসের চট্টগ্রাম ব্যুরো কার্যালয়ে খায়রুল আলম সুজন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, চলমান লোহিত সাগরে হুথিদের হামলাসহ আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন সংকট নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন টিবিএসের চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান শামচ্ছুদিন ইলিয়াস এবং স্টাফ করেসপন্ডেন্ট শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরী।

টিবিএস : লোহিত সাগর ব্যবহার করে বাংলাদেশের কী পরিমাণ পণ্য পরিবহন হয়? বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক বাণিজ্যে এর প্রভাব কতটুকু?

খায়রুল আলম সুজন: সুয়েজ খাল ও লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের ৬১ শতাংশ রপ্তানিপণ্যের গন্তব্য ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে। একইসাথে দেশের মোট আমদানিপণ্যের ৮ শতাংশ পরিবহন হয় এই পথে। বিশ্বের ব্যস্ততম সুয়েজ খালনির্ভর এই পথে বাংলাদেশের প্রায় ৪ হাজার কোটি ডলারের (৪০ বিলিয়ন) বাণিজ্য সম্পন্ন হয়। 

তবে লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে হুথিদের ক্রমাগত হামলার কারণে বিশ্বের বৃহৎ শিপিং কোম্পানিগুলো এখন আর এই পথ ব্যবহার করছে না। সুয়েজ খাল ব্যবহার করে ইউরোপ-আমেরিকায় যেসব জাহাজ চলাচল করে, এই হামলার কারণে ওই জাহাজগুলোকে গতিপথ পরিবর্তন করতে হয়েছে। 

ঘুরপথে আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে গন্তব্যে যেতে প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার বাড়তি পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। এতে সময় লাগছে অতিরিক্ত ১১ দিন। আসা-যাওয়ায় প্রতিটি জাহাজ পাড়ি দিচ্ছে অতিরিক্ত প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার। অতিরিক্ত সময় লাগছে ২২ দিন। 

ঘুরপথ ব্যবহার করায় ইতিমধ্যে শিপিং লাইনগুলো আপৎকালীন সারচার্জ হিসেবে প্রায় ৪০ শতাংশ অতিরিক্ত চার্জ বৃদ্ধি করেছে। এই পথ ব্যবহারকরে বাংলাদেশের ৪ হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্যে এখন যুক্ত হচ্ছে বাড়তি ব্যয়, যা কোনো না কোন ভাবে দেশের ভোক্তা পর্যায়ে বহন করতে হবে। দীর্ঘদিন এই অবস্থা চলতে থাকলে বৈশ্বিক বাণিজ্যে মন্দাভাব চলতে আসতে পারে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে এমনিতেই বিশ্ব অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত । এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র চেষ্টা করছে। কিন্তু লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে হুথি জঙ্গিদের হামলার কারণে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনে আরেকটি বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। সৃষ্টি হচ্ছে কনটেইনার জট। সৃষ্টি হচ্ছে মাদার ভেসেলের (বড় জাহাজ) কানেকশন সংকটসহ নানা জটিলতা। 

টিবিএস : লোহিত সাগর হয়ে বাংলাদেশের কী ধরনের আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহন হয়?

সুজন: লোহিত সাগর তথা সুয়েজ খাল পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের যেসব রপ্তানি পণ্য পরিবহন হয়, তার বেশিরভাগই তৈরি পোশাক এবং ফার্মাসিউটিক্যালস, হ্যান্ড্রিক্রাফট, পাট, চামড়া, ফ্রোজেন ফুডসহ বিভিন্ন পণ্য। এর পাশাপাশি, তুলা, কেমিক্যালস, ক্যাপিটাল মেশিনারি, ইন্ডাস্ট্রির ম্যাটেরিয়ালস আমদানি হয়।

এসব পণ্য সঠিক সময়ে আমদানি না হলে পণ্য উৎপাদন শেষে শিডিউল অনুযায়ী রপ্তানি করা সম্ভব হবে না। ক্রেতা যদি সঠিক সময়ে পণ্য হাতে না পায়, তাহলে তার দেশের বিভিন্ন চেইন শপে পণ্য পাঠাতে পারবে না। ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়েই আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে। 

টিবিএস: কী প্রভাব পড়বে? 

সুজন: বাংলাদেশ মূলত আমদানিনির্ভর দেশ। খাদ্যপণ্য, পেট্রোলিয়াম, এলএনজি, ভোজ্যতেল, চিনি, গম, চাল, শিল্পের কাঁচামাল, তৈরি পোশাকশিল্পের কাঁচামাল, কেমিক্যাল, ফার্মাসিউটিক্যালস কাঁচামালসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করতে হয়। আমদানিপণ্যের ওপর নির্ভর করেই আমাদের জীবন ধারণ করতে হয়। পাশাপাশি রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানাগুলোর কাঁচামালও আমদানি হয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে। সেসব পণ্য তৈরি করে আবার একটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ক্রেতার কাছে পৌঁছতে হয়। 

এছাড়া বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকশিল্প, ঔষধ, হ্যান্ডিক্রাফট, ফ্রোজেন ফুড, চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে। সমুদ্রপথ ব্যবহার করেই এসব আমদানি-রপ্তানি হয়। আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথে প্রতিটি সেকেন্ড কাউন্ট করা হয় ডলার হিসেবে। এর প্রভাবে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে বাংলাদেশসহ আশপাশের দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। 

নির্ধারিত সময়ে সমুদ্রপথে পণ্য না পেলে তখন এয়ার শিপমেন্টকে বেছে নেবে। এক্ষেত্রে জাহাজের চেয়ে ১৫ থেকে ২০ গুণ বেশি ফ্রেইট খরচ গুনতে হবে। এটি যেকোনো ক্রেতা, বিক্রেতার জন্য ব্যয়বহুল এবং কোনো পক্ষের জন্যই লাভজনক নয়। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কাট-আপ টাইমনির্ভর রপ্তানিমুখী শিল্প বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত, ফার্মাসিউটিক্যাল খাত কঠিন সংকটে পড়বে। 

রপ্তানি পণ্য পরিবহনে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর, যেমন কলম্বো, সিঙ্গাপুর, কেলাং বন্দরে মাদার ভেসেল কানেকশন শিডিউল বিপর্যস্ত হচ্ছে। এর ফলে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে আমদানি রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার জট বেড়ে যাচ্ছে। কনটেইনার জট পরিস্থিতি বেড়ে গেলে ফ্রেইট বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। 

সংকট আরও দীর্ঘ হলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, রপ্তানিমুখী শিল্পসহ উৎপাদন খাতে অস্থিরতা তৈরি হবে। শিল্পকারখানায় নিয়োজিত শ্রমিকদের চাকরি হারানোর আশঙ্কা তৈরি হবে। 

ক্রেতার কাছে পণ্য পাঠিয়ে দ্রুততম সময়ে পণ্য পৌঁছেছে কি না, আমরা নিশ্চিন্ত হতে চাই । একইভাবে ক্রেতাও চায় দ্রুততম সময়ে সেসব পণ্য বিভিন্ন চেইন শপে পৌঁছানো যায় কি না। দীর্ঘদিন ধরে রপ্তানি বাণিজ্যে বিক্রেতা এবং ক্রেতার মধ্যে পারস্পরিক যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলো সেটির ছন্দপতন ঘটতে শুরু করেছে অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে। 

টিবিএস: স্থানীয় বাজারে দেশি পণ্যের দামে কেমন প্রভাব পড়বে? 

সুজন: ইউরোপ-আমেরিকা থেকে যেসব পণ্য শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে আসে, সেগুলো দিয়ে পণ্য উৎপাদন শেষে আবার রপ্তানি হয়। যেমন আমেরিকা থেকে তুলা আমদানি করে সেগুলো দিয়ে পোশাকপণ্য উৎপাদন করা হয়। রাসায়নিক দিয়ে ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য তৈরি হচ্ছে। এসব পণ্য আমদানিতে যদি খরচ বেড়ে যায়, তাহলে স্থানীয় বাজারে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য বেড়ে যাবে। 

জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব, সীমিত অর্থনীতির দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। উন্নয়নের এই ধারাকে সচল রাখতে হলে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হবে। সেটি না হলে দেশের উন্নয়নের গতি স্তিমিত হয়ে আসবে। 

লোহিত সাগরে হামলা শুরুর আগেই ইংরেজি নববর্ষ এবং ক্রিসমাস ডে উপলক্ষে অর্ডারগুলো ক্রেতার কাছে সঠিক সময়ে পাঠানো সম্ভব হয়েছে। এসব পণ্য আটকা পড়লে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসত।

টিবিএস : সংকটের সমাধান কী? 

সুজন: সমুদ্রপথের এই সংকটে যেসব দেশের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে, সেসব দেশ সাথে একত্রিত হয়ে ইউনিটি গড়ে তোলা যেতে পারে। দেশগুলোর সাথে আলোচনা করে সমুদ্র পথ, সাপ্লাই চেইন যাতে নিরাপদ রাখা যায়, সেই উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলে সব দেশকে ক্ষতির মুখে পড়তে হবে না। দেশের অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা তুলনামূলক কম হবে।

ইতিমধ্যে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইরান সফর করেছেন। চলমান সংকট থেকে কীভাবে বের হয়ে আসা যায়, এসব বিষয়ে প্রস্তাবনাও দিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। 'উইন উইন' পরিস্থিতিতে এ ধরনের উদ্যোগ যদি সব দেশ সম্মিলিতভাবে করতে পারে, তাহলে বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব। সব দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে বিবদমান দেশগুলোর সাথে আন্তঃদেশীয় সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটানোর কোনো বিকল্প নেই। 

এসব সংকট সমাধানে প্রয়োজনে আন্তঃদেশীয় সংলাপ করা যেতে পারে। বিভিন্ন দেশ একত্রিত হয়ে যদি সংকট সমাধানে ঐকমত্য গঠন করতে পারে, তাহলে হয়তো সমুদ্রপথের এসব অস্থিরতা দুর করা সম্ভব হবে। 

টিবিএস : ইরান-পাকিস্তান উত্তেজনা কি সংকট উসকে দিচ্ছে ?

সুজন: ইরান এবং পাকিস্তানের মধ্যে যে অস্থিরতা চলছে সেটি সমুদ্র পথের সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। দুই দেশের মধ্যে সংঘাত যদি ছড়িয়ে যায়, তাহলে এসব দেশের পাশ দিয়েও জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। জাহাজ মালিকেরা এই পথে জাহাজ পাঠাতে চাইবে না। ইরানের আশপাশে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ রয়েছে। দুই দেশের অস্থিরতার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের সাথে বাংলাদেশে ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সরবরাহ চেইন বাধাগ্রস্ত হবে। 

সাপ্লাই চেইনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম সমুদ্রপথ তথা জাহাজ। পৃথিবীব্যাপী অল্প খরচে, অল্প সময়ে সহজে পণ্য পরিবহনের সহজ উপায় এটি। জাহাজে চলাচলের পথ যদি নিরাপদ করা যায়, তাহলে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সব দেশ নিরাপদ থাকবে। 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.