সুয়েজ রুট পরিবর্তন করায় বেড়েছে পণ্যের পরিবহন খরচ, উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা

অর্থনীতি

07 January, 2024, 04:05 pm
Last modified: 22 January, 2024, 05:47 pm
গত বছরের ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত লোহিত সাগরের দক্ষিণাঞ্চল ও এডেন উপসাগরের মধ্যে চলাচলকারী ২৫টি বাণিজ্যিক জাহাজ হামলার শিকার হয়েছে।

লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজগুলোতে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের ধারাবাহিক হামলা বৈশ্বিক বাণিজ্যিক কার্যক্রমে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। হামলার জেরে বাংলাদেশ ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে চলাচলকারী বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য আফ্রিকা ঘুরে যেতে হচ্ছে। ফলে গন্তব্যে পৌঁছাতে জাহাজগুলোর একদিকে যেমন ১৪ থেকে ১৫ দিন বেশি সময় লাগছে, অন্যদিকে বেড়ে যাচ্ছে পণ্যের দামও।

গত বছরের ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত লোহিত সাগরের দক্ষিণাঞ্চল ও এডেন উপসাগরের মধ্যে চলাচলকারী ২৫টি বাণিজ্যিক জাহাজ হামলার শিকার হয়েছে।

এসব হামলার জেরে বিশ্বের বৃহৎ শিপিং কোম্পানিগুলো এই পথে তাদের জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দিচ্ছে। সর্বশেষ গত শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) অন্যান্য কোম্পানিগুলোর মতো বৃহৎ শিপিং কোম্পানি মার্স্ক লোহিত সাগর ও সুয়েজ খাল দিয়ে তাদের পরিষেবা বন্ধ করে দেয়।

এটি ব্যবসায়ী, শিপিং কোম্পানি ও পণ্য সরবরাহকারীদের মনে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাহাজগুলো অন্য পথ দিয়ে ঘুরে যাওয়ার কারণে বীমা ও জ্বালানিসহ পণ্য পরিবহনে খরচ বেড়েছে। এ খরচ আরো বাড়বে বলেও আশঙ্কা রয়েছে। একইসাথে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছেন, এসব কারণে কাঁচামাল আমদানি এবং তৈরি পোশাক রপ্তানি খাতে বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিকল্প রুটে জাহাজ চলাচলের কারণে বীমা ও জ্বালানি খরচ বেড়েছে। এর প্রভাবে শিপিং কোম্পানিগুলো কন্টেইনার ও জাহাজে পণ্য পরিবহনের চার্জ বাড়িয়ে দিয়েছে। চট্টগ্রাম এবং ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি ২০ ফুট দৈর্ঘ্যের কন্টেইনার পরিবহনের চার্জ ইতোমধ্যে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়েছে। কিছু ক্ষেত্রে বীমা এবং উচ্চ জ্বালানি খরচসহ পণ্যের পরিবহন খরচ দ্বিগুণ বেড়েছে।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক পরিচালক ও ক্রাউন ন্যাভিগেশনের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহেদ সারোয়ার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'মহামারি করোনার আগে ইউরোপে একটি কন্টেইনার পাঠানোর ভাড়া গুণতে হতো আড়াই হাজার ডলার। মহামারির সময় এটি বেড়ে হয় সাড়ে ১২ হাজার ডলার। পরে পণ্যের চাহিদা কমানোয় ২০২৩ সালের শেষের দিকে এটি কমে দাঁড়ায় ২ হাজার ডলার।'

তিনি যোগ করেন, 'লোহিত সাগরে হামলার প্রভাবে এখন বাংলাদেশ থেকে ইউরোপগামী একটি কন্টেইনারের ভাড়া গুণতে হচ্ছে ৪ হাজার ডলার।

তিনি আরো বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলের বন্দরে ২০ ফুটের একটি কন্টেইনার বহনে জাহাজ ভাড়া ছিল দেড় হাজার ডলার। এখন সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ডলার।'

লোহিত সাগরে জঙ্গি হামলার এই প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যেও। শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে কাঁচামাল আমদানি, তৈরি পোশাক রপ্তানি খাতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখছেন দেশের ব্যবসায়ীরা।

লোহিত সাগরে ক্রমাগত হামালায় জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখা শিপিং কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে এমএসসি, মার্স্ক, সিএমএ–সিজিএম, কসকো ও হ্যাপাগ লয়েড ইত্যাাদি। এই কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের আমদানি–রপ্তানি পণ্যের প্রায় অর্ধেক কন্টেইনার পরিবহন করে।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শফিকুল আলম জুয়েল জানান, লোহিত সাগরে এসব হামলার প্রভাব ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে।

তিনি বলেন, 'পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়েই চলছে। এর প্রভাবে আমাদের দেশের আমদানিকারকরা শিডিউল অনুযায়ী পণ্য ডেলিভারি নিতে পারবে না। একইভাবে রপ্তানি পণ্যও সঠিক সময়ে পৌঁছাবে না। দ্রব্যমূল্যের ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।'

লোহিত সাগর এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যকার ১২০ মাইল দীর্ঘ এ খালটি আফ্রিকাকে মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়া থেকে পৃথক করেছে। এটি এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে ছোট পথ।

এই পথ দিয়ে তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, শস্য ও ভোগ্যপণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে। বৈশ্বিক বাণিজ্যের প্রায় ১২ শতাংশ ও কনটেইনার ট্রাফিকের ৩০ শতাংশ পরিবাহিত হয় এই পথে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি পণ্যের ৬৩ শতাংশের গন্তব্য ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের আমদানি পণ্যের ৮ শতাংশ আসে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে।

তৈরি পোশাক রপ্তানিতে প্রভাব

বাংলাদেশি পোশাক পণ্য রপ্তানির জন্য সুয়েজ খাল ইউরোপের প্রবেশদ্বার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্যমতে, কলম্বো থেকে ইউরোপে পৌঁছাতে ১৮ থেকে ২০ দিন, সিঙ্গাপুর থেকে পৌঁছাতে ২০ থেকে ২৩ দিন এবং মালয়েশিয়ার পোর্ট ক্লাং থেকে পৌঁছাতে প্রায় ২৭ দিন সময় লাগে। প্রতি মাসে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৪৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার কন্টেইনার (টোয়েন্টি ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট) কলম্বো, সিঙ্গাপুর ও পোর্ট ক্লাং হয়ে সুয়েজ খাল দিয়ে ইউরোপে পৌঁছায়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকের প্রায় ৬০ শতাংশ কার্গোই সুয়েজ খাল হয়ে ইউরোপে পৌঁছায়।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, 'লোহিত সাগরে হামলার কারণে সাপ্লাই চেইনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ নিয়ে তারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।'

তিনি আরও বলেন, 'রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইতোমধ্যেই বৈশ্বিক বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সমুদ্রপথে এই সংকট পোশাক খাতে নতুন সংকট তৈরি করবে।'

রুট পরিবর্তন করল মার্স্ক

লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে ধারাবাহিক হামলার ঘটনায় মার্স্ক গত ১৫ ডিসেম্বর বিকল্প রুট ব্যবহার করে কার্যক্রম চালানো শুরু করে। বিকল্প রুটে জাহাজ চালাতে তিন ধরনের সারচার্জ (অতিরিক্ত কর বা মাসুল) নির্ধারণ করে কোম্পানিটি।

পরে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বহুজাতিক নৌ টহল দল কাজ শুরু করলে ডিসেম্বরের শেষ দিকে লোহিত সাগরে পুনরায় জাহাজ চালানো শুরু করে মার্স্ক। কিন্তু লোহিত সাগরে জাহাজে হামলা না থামায় সর্বশেষ গত ৫ জানুয়ারি এই রুটে জাহাজ পরিচালনা বন্ধ করে দেয় মার্স্ক।

কোম্পানিটি জানায়, তাদের জাহাজগুলো এখন থেকে উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে চলাচল করবে।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.