মিনহার: সি ফুড রপ্তানিতে অগ্রদূত প্রতিষ্ঠানের উত্থান-পতন

অর্থনীতি

19 November, 2023, 12:30 pm
Last modified: 19 November, 2023, 02:20 pm
চট্টগ্রাম-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মিনহার সি ফুডস লিমিটেড ১৯৭৮ সাল থেকে বিশ্ববাজারে চিংড়ি রপ্তানি করে আসছে। মিনহারের হিমায়িত চিংড়ি বিশ্বের ২০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হয়েছে। কিন্তু চিংড়ির উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে দেশের রপ্তানি আয়ে অবদান রাখা প্রতিষ্ঠানটি এখন ঋণ খেলাপি।
ইনফোগ্রাফ: টিবিএস

মৎস্য ও সি ফুড রপ্তানিতে দেশের অন্যতম অগ্রদূত প্রতিষ্ঠান মনে করা হয় মিনহার সি ফুডস লিমিটেডসকে। তবে সম্প্রতি চিংড়ির উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে দেশের রপ্তানি আয়ে অবদান রাখা প্রতিষ্ঠানটি এখন ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে।

চট্টগ্রাম-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মিনহার সি ফুডস লিমিটেড ১৯৭৮ সাল থেকে বিশ্ববাজারে চিংড়ি রপ্তানি করে আসছে। পরবর্তীতে, কক্সবাজারেও মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গড়ে তোলে প্রতিষ্ঠানটি। মিনহারের হিমায়িত চিংড়ি বিশ্বের ২০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হয়েছে। কিন্তু চিংড়ির উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে দেশের রপ্তানি আয়ে অবদান রাখা প্রতিষ্ঠানটি এখন ঋণ খেলাপি। এমনকি, গত চার বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির মৎস্য আহরণ, প্রক্রিয়াজাত ও রপ্তানি কার্যক্রম।

সম্প্রতি মিনহার সি ফুডস'র তিন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রায় ১৭৮ কোটি টাকার খেলাপি মামলা দায়ের করেছে ওয়ান ব্যাংক। এরমধ্যে মিনহার সি ফুডস লিমিটেডের কাছে ৭৯ কোটি ১৭ লাখ টাকা, মিনহার ফিশারিজ লিমিটেডের কাছে ৪৫ কোটি ৯৬ লাখ টাকা এবং মিনহার মেরিন ফুডস লিমিটেডের কাছে ২২ কোটি ২৫ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে।

গত ১৯ জুলাই চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতে দায়ের করা এসব মামলায় প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) হাবিব উল্লাহ খান, তার স্ত্রী (চেয়ারম্যান) ইয়াসমিন খান, ছেলে (পরিচালক) হাবিব আহসান খান, মেয়ে (পরিচালক) তাহসিন খান ও পরিচালক দেবব্রত বড়ুয়াকে বিবাদি করা হয়েছে।

অর্থঋণ মামলা ছাড়াও মিনহার গ্রুপের তিন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তিনটি এনআই অ্যাক্ট (চেক ডিজনার) মামলা চলমান রয়েছে। গত বছরের (২০২২ সাল) ১৯ জুলাই চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেজ আদালতে এই তিন মামলা দায়ের করে ওয়ান ব্যাংক। তিন মামলায় অভিযোগ গঠনের শুনানির দিন ধার্য ছিল গত ১৮ অক্টোবর। কিন্তু বিচারক সেদিন অনুপস্থিত থাকায় এই দিন আগামী বছরের (২০২৪ সাল) জানুয়ারিতে পিছিয়ে দেওয়া হয়।

পাওনাদার ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১১ সাল থেকে ওয়ান ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা থেকে ঋণ সুবিধা নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে মিনহার সি ফুডস লিমিটেড। ব্যবসা শুরুর পর থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ভালোই চলছিল প্রতিষ্ঠানটির লেনদেন। কিন্তু ২০১৯ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি ঋণ পরিশোধে গড়িমসি শুরু করে। দুটি কারখানাসহ প্রতিষ্ঠানটির মৎস্য আহরণ, প্রক্রিয়াজাত এবং রপ্তানি ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। এতে গ্রুপটির কাছ থেকে ব্যাংকের পাওনা আদায়ে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। দীর্ঘদিনেও ঋণের টাকা আদায় করতে না পারায় প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নিয়েছে ব্যাংকটি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্যাংকটির সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, মিনহার সি ফুডস মৎস্য রপ্তানি খাতের নামকরা একটি প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘদিন ধরে সুনামের সাথে ব্যবসার সুবাধে এই ঋণ সুবিধা পেয়েছে। 

"তবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে দামের উত্থান-পতন এবং প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন কারণে প্রতিষ্ঠানটি ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। ঋণ আদায়ে আমরা ইতোমধ্যে সব ধরনের আইনি পদক্ষেপ নিয়েছি। এছাড়া, প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধাররাদের সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে," বলেন তিনি।

মিনহারের সফলতা-ব্যর্থতার গল্প:

পাওনাদার ব্যাংক, মিনহার সি ফুডস ও মৎস্য রপ্তানি খাতের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ১৯৭৮ সালে তৎকালীন শিল্প ব্যাংকের বিনিয়োগে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে মৎস্য (চিংড়ি) রপ্তানি কারখানা গড়ে তুলেন হাবিব উল্লাহ খান। সাগরে চিংড়ির সহজলভ্যতার ফলে প্রথম চার দশক ভালোই ব্যবসা করে প্রতিষ্ঠানটি। উপকূলীয় অঞ্চল খুলনা ও কক্সবাজার থেকে তখন কারখানার শতভাগ কাঁচামাল (চিংড়ি) আসতো। এমনকি, পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকেও চিংড়ি সংগ্রহ করে বিদেশে রপ্তানি হতো। আমেরিকা, বেলজিয়াম, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, জাপান, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সে চিংড়ি রপ্তানি করতো মিনহার।

মিনহার এতই ভালো ব্যবসা করে যে, ২০১৩-১৪ এবং ২০১৪-১৫ সালে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক মৎস্য রপ্তানি ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। তখন গ্রুপটির দুটি কারখানা, তিনটি ফিশিং ট্রলার মিলে প্রায় ৫০০ লোকের কর্মসংস্থান ছিল। রপ্তানি আয়ে অবদান রাখার জন্য ১৯৮১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে রপ্তানি ট্রফি অর্জন করে মিনহার সি ফুডস। এই সময় টানা কয়েক বছর সিআইপি মনোনীত হন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার হাবিব উল্লাহ খান।

কিন্তু ২০১৫ সালের পর থেকে মৎস্য রপ্তানিতে ভাটা শুরু হয়। কারণ দেশে তখন প্রায় ১৫০টির মতো মৎস্য রপ্তানি কারখানা গড়ে উঠলেও সাগর থেকে চিংড়ির সরবরাহ কমে আসে। এক সময় মিয়ানমার থেকেও চিংড়ি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।

রপ্তানি বৃদ্ধিতে প্রতিষ্ঠানটি মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণে আধুনিক মেশিনারিজ স্থাপন করলেও কাঁচামাল সংকটে সেই অনুপাতে রপ্তানি বৃদ্ধি করতে না পারায় লোকসান শুরু হয়। ২০১৬ সাল থেকে ক্রমাগত লোকসান গুনতে গুনতে এক সময় (২০১৯ সালে) প্রতিষ্ঠানটি মৎস্য রপ্তানি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়।

এরমধ্যে ভিয়েতনাম, চীন, ভারত, থাইল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশে ভেন্নামি চিংড়ি উৎপাদনে বিপ্লব শুরু হয়। ভেন্নামি চিংড়ির উৎপাদন খরচ সাগর থেকে আহরণ করা চিংড়ির তুলনায় অনেক কম। যে কারণে ওইসব দেশ বিশ্ববাজারে অনেক কম দামে ভেন্নামি চিংড়ি রপ্তানি শুরু করে। এতে বিশ্ববাজারে চিংড়ির দাম অনেক কমে আসে। কিন্তু এর বিপরীতে সাগরে মৎস্য কমে যাওয়ায় চিংড়ি আহরণে দেশের রপ্তানিকারকদের খরচ বেড়ে যায়। এছাড়া কিছু কিছু রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান গুণগত মান বজায় না রাখায় বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের সুনাম নষ্ট হয়।

এতে চিংড়ি আহরণ, পরিবহন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে খরচ বাড়লেও আয়ের সাথে ব্যয়ের সমন্বয় না হওয়ায় ক্রমাগত লোকসানে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি।

এ বিষয়ে মিনহার সি ফুডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিব উল্লাহ খান বলেন, "আমরা ব্যাংকের বিনিয়োগ সহায়তায় কারখানা গড়ে তুলেছি। মৎস্য আহরণ, প্রক্রিয়াজাত এবং রপ্তানির মধ্যে মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করেছি। রপ্তাানি আয়ে অবদান রেখেছি। শেষ দিকে টানা কয়েক বছর ব্যবসা খারাপ হওয়ায় ব্যাংকের দেনা শোধ করতে পারিনি। কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার আগে ২০১৮ সালে আমরা মোট পাওনার ৭০ শতাংশ টাকা দিয়ে ঋণটি পরিশোধের প্রস্তাব করেছিলাম। কিন্তু ব্যাংক বিষয়টি সমাধানে এগিয়ে আসেনি।" 

"ব্যাংকগুলোকে আমরা শত শত কোটি টাকার সুদ দিয়েছি। যেহেতু আমাদের ব্যবসা বন্ধ– এই মুহূর্তে ব্যাংকের দাবি অনুযায়ী টাকা শোধ করতে আমরা অপরাগ। কিন্তু আমাদের সদিচ্ছা আছে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করার। এক্ষেত্রে ব্যাংককেও এগিয়ে আসতে হবে," যোগ করেন তিনি।

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.