আইনের খসড়া অনুমোদন, এনবিএফআইয়ে এক পরিবার ১৫%-এর বেশি শেয়ার রাখতে পারবে না

অর্থনীতি

23 October, 2023, 11:25 pm
Last modified: 23 October, 2023, 11:25 pm

ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন, ২০২৩-এর চূড়ান্ত খসড়ার অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে (এনবিএফআই) সুশাসন বাড়ানোর লক্ষ্যে নতুন এ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইন অনুসারে, এনবিএফআইয়ে এক পরিবার থেকে দুজনের বেশি পরিচালক হতে পারবেন না এবং একক ব্যক্তি বা এক পরিবার থেকে ১৫ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণ করা যাবে না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সোমবার (২৩ অক্টোবর) মন্ত্রিসভা বৈঠকে এই খসড়া আইনের অনুমোদন দেওয়া হয়।

চলতি সংসদ অধিবেশনেই প্রস্তাবিত আইনটি পাশ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বিদ্যমান আইনে একজন ব্যক্তি বা এক পরিবার এনবিএফআইয়ের কত শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে পারবে কিংবা এক পরিবার থেকে কতজন পরিচালক থাকতে পারবেন, তা বেঁধে দেওয়া নেই। প্রস্তাবিত আইনে পরিবারের সংজ্ঞাও ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। এ আইন অনুসারে, শেয়ারধারীর স্ত্রী বা স্বামী, সন্তান, বাবা-মা, ভাইবোন এবং তার ওপর নির্ভরশীল সবাইকে পরিবার বোঝাবে।

বিশ্লেষক ও আর্থিক খাতসংশ্লিষ্টরা নতুন আইনকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, আইনটি সুশাসন ব্যবস্থার উন্নতি এবং বিভিন্ন ত্রুটির সমাধান করবে। আইনটির যথাযথ বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন তারা।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চরম অনিয়ম মোকাবিলায় একটি নতুন, কঠোর আইন প্রয়োজন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের স্ট্রেস টেস্ট রিপোর্ট অনুসারে, দেশের ৩৫টি এনবিএফআইয়ের অর্ধেকের বেশি অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে দেউলিয়া হয়ে গেছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৪টি এনবিএফআই 'রেড জোন' বা দুর্বল অবস্থানে ছিল। ৭টি এনবিএফআই 'ইয়েলো জোন' ও ১৪টি ছিল 'গ্রিন জোনে'।

ভালো, মাঝারি ও দুর্বল আর্থিক অবস্থায় থাকা এনবিএফআইগুলোকে যথাক্রমে 'গ্রিন', 'ইয়েলো' এবং 'রেড জোনে' ভাগ করা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুনের শেষে এনবিএফআই খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা, যা এই খাতে বিতরণ করা মোট ঋণের ২৭.৬৫ শতাংশ।

সভা শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, এনবিএফআইগুলো এখন আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, ১৯৯৩ দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কিন্তু ওই আইনের কিছু দুর্বলতার কারণে আইনটি বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। সে কারণে আইনটিকে হালনাগাদ করে নতুন আইন হচ্ছে।

তিনি বলেন, 'বিদ্যমান আইনে একজন ব্যক্তি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কত শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে পারবেন, সেটি বেঁধে দেওয়া ছিল না। নতুন আইনে বলা হচ্ছে, এক ব্যক্তি বা একই পরিবার ১৫ শতাংশের বেশি শেয়ারের মালিক হতে পারবে না।'

যেসব এনবিএফআই শেয়ারধারীর কাছে কোম্পানির ১৫ শতাংশের বেশি শেয়ার রয়েছে, নতুন আইন কার্যকরের পর থেকে পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে তাদের শেয়ার সমন্বয় করতে হবে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। 

'১৫ শতাংশের অতিরিক্ত শেয়ার পরিবারের সদস্য নয় অথবা যাদের কাছে ১৫ শতাংশের কম শেয়ার রয়েছে, এমন ব্যক্তির কাছে বিক্রি করা যাবে। দুই বছরের মধ্যে বাড়তি শেয়ার হস্তান্তর না করলে সরকার তা বাজেয়াপ্ত করবে,' বলেন তিনি।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, বিদ্যমান আইনে একটি এনবিএফআইয়ের বোর্ডে পরিচালকের সংখ্যা কত হবে, তা নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা নেই। প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, দুজন স্বতন্ত্র পরিচালকসহ বোর্ডে মোট ১৫ জন পরিচালক থাকতে পারবেন।

'তবে একটি পরিবার থেকে শেয়ারের পরিমাণ ৫ শতাংশের কম হলে একজন পরিচালক থাকবেন। ৫ শতাংশের বেশি হলে সর্বোচ্চ দুইজন থাকতে পারবেন। এক পরিবার থেকে দুইজনের বেশি পরিচালক থাকতে পারবেন না,' মাহবুব হোসেন বলেন। 

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, বিদ্যমান আইনে এনবিএফআইয়ের পরিচালকের কোনো মেয়াদ বেঁধে দেওয়া ছিল না। তবে প্রস্তাবিত আইনে পরিচালকের মেয়াদ তিন বছর করা হচ্ছে। একজন পরপর তিন মেয়াদে পরিচালক থাকতে পারবেন। 

নতুন আইনে ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপির সংজ্ঞা সন্নিবেশিত করা হয়েছে জানিয়ে মাহবুব হোসেন বলেন, একজন ব্যক্তিকে তিনটি কারণে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে গণ্য করা যাবে। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যদি ঋণ সময়মতো পরিশোধ না করেন; যে কারণ দেখিয়ে ঋণ দিয়েছেন, সেই কারণে ব্যবহার না করে যদি অন্য কারণে ব্যবহার করেন; এবং যেসব কাগজপত্র জমা দিয়ে ঋণ নিয়েছিলেন, পরে সেগুলো যদি ভুয়া বলে চিহ্নিত হয়।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, 'যখন একজন ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হবেন, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের একটা তালিকা রাখবে। তালিকা হওয়ার পর যখন তারা নোটিশ পাবেন, সেই নোটিশ পাওয়ার দুই মাসের মধ্যে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ঋণ গ্রহীতার কাছে তার প্রাপ্য অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট ফাইন্যান্স কোম্পানি পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনক্রমে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করবে। এবং এরকম মামলা সংশ্লিষ্ট ঋণ বা অগ্রিম বা পাওনা আদায়ের ক্ষেত্রে অর্থঋণ আদালতের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করবে না।'

তিনি আরও বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংক ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের ওপর বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা, ট্রেড লাইসেন্সে নিষেধাজ্ঞা, এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরের (আরজেএসসি) নিকট কোম্পানি নিবন্ধনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবে। মানে যখন কেউ ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবেন, তাদের ওপর কোনো ব্যবসা করার ক্ষেত্রে অথবা বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকবে।'

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ব্যাংকগুলো সাবসিডিয়ারি কোম্পানি গঠন করতে পারে। তবে নতুন আইনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সাবসিডিয়ারি কোম্পানি গঠন করতে পারবে না।

মাহবুব হোসেন জানান, সুদ মওকুফের বিষয়ে বিদ্যমান আইনে কোনো নির্দেশনা ছিল না। নতুন আইনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া সুদ মওকুফ করা যাবে না। সম্পূর্ণ সুদ কখনো মওকুফ করা যাবে না। এছাড়া এনবিএফআইকে কস্ট অফ ফান্ড অবশ্যই আদায় করতে হবে। 

নতুন আইনে কিছু কিছু ক্ষেত্রে জরিমানা ও শাস্তি বাড়ানো হয়েছে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। যেমন, লাইসেন্সের শর্ত না মানার শাস্তি ১০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, বিধিবিধান লঙ্ঘন করে ঋণ দিলে বিদ্যমান আইনে এনবিএফআইকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হয়। প্রস্তাবিত আইনে এটি সংশোধন করে বলা হয়েছে, ১০ লাখ টাকা বা ছাড়কৃত ঋণের বিদ্যমান স্থিতির মধ্যে যেটি বেশি, সেটি প্রত্যেক পরিচালক ও কর্মকর্তাকে জরিমানা হিসেবে দিতে হবে।

মাহবুব হোসেন জানান, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কিনতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে। কী পরিমাণ শেয়ার বিদেশি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি পাবে, তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারণ করবে। 

এছাড়া একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় থাকতে পারবে না বলেও জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

প্রস্তাবিত আইনকে স্বাগত জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা

বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কায়সার হামিদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বিদ্যমান আইনে অনেক বিষয় উল্লেখ বা স্পষ্ট করা হয়নি, যার ফলে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও ফায়দা লোটা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে এই ত্রুটিগুলো দূর করা হয়েছে। এ আইন এনবিএফআই খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়াবে।'

জরিমানা ও শাস্তি যুক্ত করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রস্তাবিত আইনে জরিমানা বাড়ানো হলে সবাই তা মেনে চলতে উৎসাহিত হবে; ভালোভাবে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের ওপর এটি বোঝা হবে না।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নতুন আইন কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা।

তিনি বলেন, 'সব আইনের লক্ষ্যই অন্যায়কারীদের শাস্তির আওতায় আনা এবং সংশ্লিষ্ট খাতের উন্নয়ন করা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আইনটি নিরপেক্ষভাবে প্রয়োগ করা হবে নাকি রাজনৈতিক বিবেচনায়।

'পিকে হালদার শুধু একটা উদাহরণ, কিন্তু এমন আরও অনেক আছে। আর্থিক খাত তদারকির দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের, কিন্তু তারা এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে।'

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.