স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের বিদেশি বিনিয়োগ থেকে এত কম রিটার্ন কেন আসছে

অর্থনীতি

19 September, 2023, 12:10 am
Last modified: 19 September, 2023, 06:03 pm
একজন ব্যাংকার বলেন, বিদেশে ব্যবসা পরিচালনাকারী স্থানীয় কোম্পানি অনেক বাংলাদেশিকে নিয়োগ দেয়, যা রেমিট্যান্স আয়ে অবদান রাখে...

বিদেশে বাংলাদেশি উদ্যোগগুলোকে বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হলেও, উল্লেখ করার মতো আয় হয়নি তাদের, ফলে দেশে লভ্যাংশ আসার পরিমাণও বলতে গেলে ন্যূনতম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে এবং বিদেশে বিনিয়োগকারীদের সাথে কথা বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড জানতে পেরেছে যে, এসব উদ্যোগের বেশিরভাগই লোকসান দিয়েছে। অন্যদিকে, যারা ব্যবসার মাধ্যমে আয় করছে, তাদের সেটা বাংলাদেশে পাঠানোর আগ্রহ নেই, কারণ এ আয় দিয়ে তারা বিদেশে শেয়ার মূলধন বাড়াতে চায়। আয় দেশে না আনা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কোন কোনটি বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণও নিয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠান আবার বিদেশে রপ্তানি এজেন্ট হিসেবে ব্যবসা করার জন্য অফিস খুলেছে। সেই আয় তারা বিদেশে ব্যবসা পরিচালনায় ব্যবহার করছে।  

লোকসানে পড়া কিছু উদ্যোগ বিদেশে তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম গুটিয়ে নিতেও বাধ্য হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০০০ সালের পর থেকে – গত ২২ বছরে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে ৪০০ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় চার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের অনুমতি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

মোট এই বিনিয়োগের মধ্যে, ২২৯ মিলিয়ন ডলার করা হয় শেয়ার বা ইক্যুইটিতে, আয়ের পুনঃবিনিয়োগ হয়েছে ৬০.৮৯ মিলিয়ন ডলার এবং আন্তঃকোম্পানি ঋণ হিসেবে বিনিয়োগ ১১০ মিলিয়ন ডলার।

তবে এসব বিনিয়োগের রিটার্ন উল্লেখযোগ্য নয় বলেই দেখা যাচ্ছে। যেমন ২০২২ সালে বিদেশে করা বিনিয়োগ থেকে – মাত্র ১২.১৩ মিলিয়ন ডলার – বা প্রায় ১৩৪ কোটি টাকা দেশে আসে।

ওই বছর দেশে আসা মোট রিটার্নের মধ্যে বড় অংশ এসেছে নেপাল থেকে। কারণ আইএফআইসি ব্যাংক তাদের হাতে থাকা নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংকের ৪০ দশমিক ৪১ শতাংশ বা সমস্ত হোল্ডিং (শেয়ার) বিক্রি করে দেয়। এছাড়া, চীন ও যুক্তরাজ্য থেকেও রিটার্নের কিছু অংশ আসে বলে জানাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য।    

এপর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ১৮টি স্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি দিয়েছে, কিন্তু তাদের রিটার্ন বেশ সীমিত।

বিদেশে তাদের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান (শাখা) খোলার অনুমতি পাওয়া ছয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংকও স্বল্প-পরিমাণ অর্থ দেশে এনেছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যাচ্ছে।

যেমন, যেমন ২০২১ সালে মাত্র ২৬ কোটি টাকা বা ২.৯৮ মিলিয়ন ডলার পায় বাংলাদেশ। ব্যাংকগুলোর সাবসিডিয়ারি পরিচালনা থেকে এ আয় হয়েছে।

বিনিয়োগকারী ও  গন্তব্য

২০১৫ সাল থেকেই বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের বিদেশে বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে থাকে। ওই বছর সরকার 'বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৪৭ সংশোধনের মাধ্যমে রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানগুলোকে শর্তসাপেক্ষে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি দেয়।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ বিবেচনায়, ২০০০ সাল থেকেই কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে স্বল্প-পরিসরে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি দিয়েছে।

২০২২ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের জন্য প্রস্তুতকৃত বাংলাদেশ ব্যাংকের 'ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড এক্সটার্নাল ডেবট' শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে ২০টি দেশে বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ রয়েছে।

বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগের শীর্ষ পাঁচটি গন্তব্য হলো– হংকং, ভারত, নেপাল, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাজ্য।  

দেশের প্রথম কোম্পানি হিসেবে বৈদেশিক বিনিয়োগের অনুমতি পেয়েছিল এমজেএল। মিয়ানমারে এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা বন্ধ হলেও সিঙ্গাপুরে তাদের বিনিয়োগ আছে।

২০২০ সালে এমজেএল বাংলাদেশের মাধ্যমে ১৯.৪৬ মিলিয়ন ডলার আসে। কোম্পানিটি মিয়ানমারে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে এ অর্থ ফেরত আনে।

২০১৬ সালে আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়ায় পোশাক কারখানা স্থাপনের অনুমতি পেয়েছিল দেশের শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক ডিবিএল গ্রুপ। কিন্তু, দেশটিতে গৃহযুদ্ধের কারণে এ উদ্যোগ সাফল্যের মুখ দেখেনি।  

কলকাতা ও পাটনায় তিনটি রিভার টার্মিনাল ব্যবস্থাপনার জন্য ভারতে একটি কোম্পানি গঠনে– ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নেয় সামিট এলায়েন্স পোর্ট লিমিটেড (এসএপিএল)। এই ব্যবসা থেকে কোম্পানিটি বর্তমানে আয় করলেও, তার রিটার্ন এখনও বাংলাদেশে আনা শুরু করেনি।

এসএপিএল- এর কোম্পানি সচিব ওসমান সাজিদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, শেয়ার মূলধন হিসেবে এক লাখ রুপি নিয়ে ভারতে একটি কোম্পানি গঠনে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নেন। টার্মিনাল ব্যবস্থাপনার চুক্তি/ ঠিকাদারি পেতে তারা প্রথমে একটি আন্তর্জাতিক দরপত্রে অংশ নেয়, আর ঠিকাদারি পাওয়ার পরে ভারতে কোম্পানি গঠন করে।

ওসমান সাজিদ বলেন, 'বর্তমানে এ কোম্পানি আয় করলেও, পুনঃবিনিয়োগের মাধ্যমে শেয়ার মূলধন বাড়ানোর পরিকল্পনা থাকায় তা বাংলাদেশে আনা হচ্ছে না।'

২০২১ সালে ভারতে বিনিয়োগের অনুমতি পায় প্রাণ গ্রুপ, তবে এখনও ব্যবসা কার্যক্রম শুরু করেনি বলে কোম্পানির অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিরা জানান।

২০১৭ সালে কেনিয়ায় ব্যবসা স্থাপনের অনুমতি পায় স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, কোম্পানিটি আগামী বছর থেকে লভ্যাংশ আনতে শুরু করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

কিছু প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের লভ্যাংশ আনতে চায় না কেন

বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট একটি বিভাগের সাথে জড়িত থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন শীর্ষ নির্বাহী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সাথে আলাপকালে বলেন, বেশিরভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিদেশে অফিস স্থাপনের অনুমতি নিয়েছে। 'বিদেশে শেয়ারে বিনিয়োগ খুবই অল্প। যেকারণে, বিদেশে মোট বিনিয়োগের অঙ্কও কম।'

তিনি বলেন, বিদেশে বিনিয়োগকারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়ই বৈদেশিক উৎসের ঋণের মাধ্যমে তাদের তহবিল সংগ্রহ করে। এই ঋণ পেতে অনেক সময় তারা বিদেশি কোম্পানির সাথে অংশীদারত্বে যায় অথবা তাদের মূল কোম্পানি থেকে বা ব্যাংকের গ্যারান্টি নেয়।

এছাড়া, বিদেশে সম্পদ গঠনে বেশিরভাগ কোম্পানি আরেকটি উপায়ও গ্রহণ করে, আর তা হলো রপ্তানি আয় ধরে রাখা।

তিনি জানান, রপ্তানি এজেন্ট হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশে অফিস খোলে। এরপর স্থানীয় প্রতিষ্ঠান ওই কোম্পানির মাধ্যমে রপ্তানি করে কমিশন আয় করে, যা দিয়ে আবার বিদেশে ব্যবসা পরিচালনা করা হয়।

'যেমন স্থানীয় কোম্পানি হয়তো ভারতে তাদের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের কাছে ৮ টাকা দরে কোনো পণ্য বিক্রি করলো, ওই অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সেই পণ্য আবার সর্বশেষ ক্রেতার কাছে হয়তো ১২ টাকায় বিক্রি করবে। এভাবে বাংলাদেশি কোম্পানির সহযোগী বিদেশি প্রতিষ্ঠানটি ৪ টাকা আয় করবে।'

এতে দেশ প্রকৃত রপ্তানি আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

পরোক্ষ লভ্যাংশ

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা অবশ্য আরো বলেন যে, এর একটি ইতিবাচক দিকও আছে, আর তা হলো– এসব কোম্পানি বিদেশে ব্যবসা পরিচালনার মাধ্যমে উন্নত প্রযুক্তি সম্পর্কে ধ্যানধারণা লাভ করছে। যেমন সামিট গ্রুপ তাদের সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল (এসপিআইএল) এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাতে বিপুল বিনিয়োগ করেছে।

তিনি আরো জানান, হংকং বাংলাদেশি বিনিয়োগের একটি প্রধান গন্তব্য কারণ বায়ারদের ধরতে সেখানে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো সেখানে এজেন্ট অফিস খুলেছে। 'ফলে সরাসরি কোনও রিটার্ন না আসলেও, পরোক্ষ লাভ আছে বিপুল।'  

এছাড়া, বিদেশে ব্যবসা পরিচালনাকারী স্থানীয় কোম্পানিগুলো বাংলাদেশিদের নিয়োগ দেয়, যা রেমিট্যান্স আয়ে অবদান রাখে।

বিদেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সাবসিডিয়ারি কার্যক্রমের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, কিছু ব্যাংক লোকসানে থাকলেও– তারা ব্যাংকখাতের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আনতে অবদান রাখছে। 'এসব ব্যাংককে যদি বিদেশে ব্যবসা পরিচালনার অনুমতি না দেওয়া হতো, তাহলে রেমিট্যান্স হুন্ডির মাধ্যমে আসতো। এভাবে বিদেশে বিনিয়োগ দেশে পরোক্ষ রিটার্ন আনছে।'

এই ব্যাংকার আর উল্লেখ করেন যে, বিদেশে যখন কোনো কোম্পানি  নিবন্ধন নেয়, তখন বাংলাদেশে আয় প্রত্যাবাসন বাধ্যতামূলক নাও হতে পারে। এই বিষয়টি ওই দেশের কর্তৃপক্ষের ওপর নির্ভর করে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)- এর সুপারনিউমারারি প্রফেসর মো. আলী হোসেন প্রধানিয়া বলেন, পরোক্ষ লভ্যাংশের দিকটি বিবেচনা করে বিদেশে বিনিয়োগ করতে দেওয়া উচিত।

আলী হোসেন অগ্রণী ব্যাংকের উপ-মহাব্যবস্থাপক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। সে অভিজ্ঞতা স্মরণ করে তিনি বলেন, সিঙ্গাপুরে মানি এক্সচেঞ্জ স্থাপনে ২০০১ সালে ব্যাংকটিকে দুই লাখ ডলার বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। পরে অগ্রণী ব্যাংকের মাধ্যমে বছরে ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। 'এভাবেই ব্যাংকটি বাংলাদেশকে পরোক্ষ রিটার্ন দিচ্ছে'- যোগ করেন তিনি।  

 

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.