পেঁয়াজ, আলু, ডিমে সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম মানছে না বিক্রেতারা, অভিযানেও নেই সুফল 

অর্থনীতি

17 September, 2023, 11:15 am
Last modified: 17 September, 2023, 01:05 pm
দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পরও বাজারে এর প্রভাব না থাকায় স্বাভাবিকভাবেই ক্রেতাদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ পেঁয়াজ ও আলুর দাম প্রকৃত অর্থে না কমে আরও খানিকটা বেড়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পেঁয়াজ, আলু ও ডিমের দাম নির্ধারণ করে দেয়ার পর থেকেই বাজারে ক্রেতা, বিক্রেতাদের মধ্যে চলছে তর্কবিতর্ক। তবে তিন দিনের মাথায়ও বেধে দেয়া দামে ক্রেতারা পণ্য কিনতে পারছেন না, উল্টো পণ্যের দাম বেড়েছে। অভিযানেও এর সুফল মিলছে না।

দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পরও বাজারে এর প্রভাব না থাকায় স্বাভাবিকভাবেই ক্রেতাদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ পেঁয়াজ ও আলুর দাম প্রকৃত অর্থে না কমে আরও খানিকটা বেড়েছে।

ঢাকার বাজার ঘুরে দেখা যায়, এক সপ্তাহ আগে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ঢাকার খুচরা বাজারে ৮৫-৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে, যা এখন ৯০ টাকার কমে মিলছে না। একইভাবে আলুর দাম ছিল ৪৫-৫০ টাকা, যেটা এখন ৫০ টাকার নিচে নেই। প্রতি ডজন ফার্মের ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫০-১৫৫ টাকা, সে হিসেবে একেকটি ডিমের দাম পড়ছে ১২.৫০-১২.৯২ টাকা।

অথচ গত সপ্তাহেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতি কেজি আলুর দাম ৩৫-৩৬ টাকা, দেশি পেঁয়াজের দাম ৬৪-৬৫ টাকা এবং প্রতিটি ডিমের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১২ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের উদ্যোগ ঠিক আছে। কিন্তু বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। যারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে তাদেরকে দৃশ্যমান শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সরবরাহ চেইনে কোন সমস্যা থাকলে সরকারকে সেটা দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। 

রাজধানীর বাসাবোর সবজি বিক্রেতা তরিকুলের কাছে এক ক্রেতা আলুর দাম জানতে চাইলে বিক্রেতা ৫০ টাকা দাম চান। তখন ক্রেতা বিক্রেতাকে বলেন, "টিভিতে দেখলাম সরকার ৩৫-৩৬ টাকা দামে প্রতি কেজি আলু বিক্রির নির্দেশ দিয়েছে। সরকারের দাম মানছেন না কেন?"

বিক্রেতা উত্তরে বলেন, "সকাল বেলায় ৪২ টাকা কেজি দরে আলু পাইকারি বাজার থেকে কিনেছি। এখন যদি আপনার মনে হয় ৩৫-৩৬ টাকায় নিবেন, তাহলে নিয়ে যান।"

একইভাবে তর্ক করতে দেখা গেল বাড্ডার মিজান স্টোরে পেঁয়াজ কিনতে যাওয়া এক ক্রেতা ফজলুর রহমানকে। তিনি দোকানিকে বলেন, "সরকারের ঘোষণায় দেখলাম পেঁয়াজ ৬৪-৬৫ টাকায় বিক্রি হবে। আপনি চাচ্ছেন ৯০ টাকা। এত বেশি কেন চাচ্ছেন? দোকানি জানালেন, 'পাইকারিতে দাম কমানোর আগে খুচরায় দাম কমার সুযোগ নেই।"

বিক্রেতা মিজানুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "দুদিন ধরে আলু-পেঁয়াজ বিক্রির চেয়ে কাস্টমারের উত্তর দিতে হচ্ছে বেশি। এখন মনে হচ্ছে আপাতত এই পণ্যগুলো বিক্রি বন্ধ করে দিতে হবে।"

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান টিবিএসকে বলেন, "কোন পণ্যের দাম যখন অযৌক্তিকভাবে বেশি বাড়বে তখন সরকার দাম নির্ধারণ করে দিতে পারে। কিন্তু দামটা কে বাড়াচ্ছে, কেন বাড়ছে এই বিষয়টা বের করতে হবে।"

তিনি বলেন, যারা দামটা মানবে না, অযৌক্তিকভাবে বেশি দামে বিক্রি করবে তাদেরকে যদি যথেষ্ট শাস্তি না দেওয়া যায় তাহলে দাম নির্ধারণ করে কোন লাভ হবে না। অর্থাৎ দাম নির্ধারণ করলে সেটা ব্যাপক মনিটরিংয়ের মাধ্যমে কার্যকর করতে হবে।

দাম নির্ধারণ নিয়ে ব্যবসায়ীরা যা বলছেন

নিউমার্কেট কাঁচাবাজারে শনিবার অভিযানে যায় ভোক্তা অধিদপ্তরের একটি মনিটরিং টিম। এই টিমকে দেখে তাড়াহুড়ো করে কিছু ব্যবসায়ী দাম নির্ধারণ করা পণ্যগুলো খানিকটা কম দামে বিক্রি শুরু করে। অনেক বিক্রেতা অভিযানের খবরে মূল্য তালিকা প্রদর্শন শুরু করেন। যারা দাম কমায়নি তাদের মধ্যে একটি মেসার্স শাহ আলম ট্রেডার্স। দাম না কমানোর অপরাধে প্রতিষ্ঠানটিকে ২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

প্রতিষ্ঠানটির মালিক শাহ আলম বলেন, "কেনা দামের নিচে বিক্রি করলে তো আমাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে।"

কিন্তু মনিটরিং টিম চলে যাবার পরপরই বাজারটিতে আবার আগের দামে পণ্য বিক্রি হতে থাকে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাম নির্ধারণের আগে সরকারের স্পষ্টভাবে দেখা উচিত কোন পণ্যের ঘাটতি আছে কি-না, কোন পর্যায়ে আসলে সমস্যা হচ্ছে। খুচরা পর্যায়ে গণহারে অভিযান চালিয়ে উল্টো ফল আসতে পারে।

শ্যামবাজারের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী মো. মাজেদ টিবিএসকে বলেন, "সরবরাহ বেশি থাকলে এমনিতেই দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে। দাম ঠিক করার আগে সরকারের দেখা উচিত, সরবরাহ পরিস্থিতি কী, ঘাটতি আছে কি-না। সমস্যা থাকলে সাপ্লাই চেইনে কাজ করতে হবে। টিসিবির মাধ্যমে পেঁয়াজ এনে সরকার কম দামে বিক্রি করলে সেটা বাজারে প্রভাব ফেলবে। এভাবে দাম ঠিক করে বাজারে কতটা প্রভাব পড়বে তা নিয়ে শঙ্কা থেকে যায়।"

তিনি বলেন, "এখন যদি সরকারের চাপে বেশি খরচের পেঁয়াজ কেউ কম দামে বিক্রি করে, সে তো সুযোগ খুঁজবে কখন আবার অতিরিক্ত লাভ করা যায়।" 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, পেঁয়াজের সরবরাহে কোন ঘাটতি নেই। প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজের পাইকারি পর্যায়ে যৌক্তিক মূল্য ৫২.৪৫ টাকা। কিন্তু কারওয়ানবাজারে শনিবার প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৭৮ টাকায় বিক্রি করতে দেখা যায়। ব্যবসায়ীদের দাবি, দু'দিনের ব্যবধানে কেজিতে ২ টাকা পর্যন্ত দাম কমেছে।

পাইকারী বিক্রেতা আশরাফুল আলম টিবিএসকে বলেন, "দাম বেশি হওয়ায় এবং সরকারের দাম নির্ধারণের কারণে অনেকে পেঁয়াজ আনা বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ এখন যে দাম তাতে করে সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করা যাচ্ছে না। কখন আবার অভিযান এসে জরিমানা করে সেই আতঙ্কে সবাই সময় পার করছে।"

তিনি বলেন, "আরও হয়তো ২-৩ টাকা দাম কমবে, কিন্তু সরকার যে দাম ঠিক করেছে সেখানে কিভাবে আসবে সেটা আমরা এখনো বুঝতে পারছি না।"

এদিকে সরকার আলু উৎপাদনের যে তথ্য দিয়ে যাচ্ছে তাতে আস্থা নেই কোল্ড স্টোরেজ মালিকদের। তাদের দাবি এবারে আলুর উৎপাদন ৮৫ লাখ টনের বেশি হয়নি। কিন্তু সরকার এটা মানতে নারাজ। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বলছে, ১.৪-১.১২ কোটি টন আলু উৎপাদন হয়েছে। যেখানে চাহিদা ৯০ লাখ টন।

ব্যবসায়ীদের দাবি, কোল্ড স্টোরেজে এবারে আলুর সরবরাহ গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। স্টোরেজ সক্ষমতার চেয়ে ২০ শতাংশ জায়গা ফাঁকা ছিল। যে কারণে নির্ধারিত সময়ের ৪৫ দিন আগেই স্টোরেজ থেকে আলু বাজারে ছাড়তে হয়েছে। আলুর কম উৎপাদনের কথা সরকার স্বীকার না করলেও বিষয়টি কিছু ব্যবসায়ী জানে এবং তারা অতি মুনাফার জন্যই বাজারে অস্থিরতা তৈরি করেছে।

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি ও কোল্ড স্টোরেজ এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মোস্তফা আজাদ চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সেটা যৌক্তিক, আলুর দাম এর বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সরবরাহের দিকেও নজর দিতে হবে। সরবরাহ কম থাকলে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ব্যর্থ হতে পারে।"

তিনি বলেন, "সরকারের উচিত আগে উৎপাদনের সঠিক তথ্য বের করে, সাপ্লাই চেইনে কোন সমস্যা থাকলে সেটা নিয়ে কাজ করা।"

কারওয়ানবাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনেক আড়তদার বিতর্কের মুখে পড়ার ভয়ে নতুন করে আলু আনা কমিয়ে দিয়েছেন। 

শনিবার মুন্সিগঞ্জে কোল্ড স্টোরেজ পরিদর্শনে গিয়ে এএইচএম সফিকুজ্জামান জানান, কোল্ড স্টোরেজের মজুতদারেরা কোনো রসিদে আলুর দাম ও পরিমাণ লিখে বিক্রি করছেন না, যা হচ্ছে সেটা ফোনে ফোনে। এই অবস্থায় পাকা রসিদের মাধ্যমে ২৫-২৬ টাকার মধ্যে আলু বিক্রি করতে হবে। তা না হলে প্রশাসন এই দামে আলু বিক্রি করে যার আলু তাকে টাকা দিয়ে দিবে। এটা জেলা প্রশাসকরা দেখবেন।

তিনি আশা প্রকাশ করেন, কয়েকদিনের মধ্যেই বাজার পরিস্থিতি ঠিক হবে।  
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.