জমি ইজারার সমস্যা, গ্যাস সংকট সমাধান করুন: বিনিয়োগ নিয়ে চীনা উদ্যোক্তারা

অর্থনীতি

টিবিএস রিপোর্ট
10 September, 2023, 01:35 pm
Last modified: 10 September, 2023, 01:42 pm
এক চীনা উদ্যোক্তা বলেন, বাংলাদেশে এক বছরের ভিসা এবং ওয়ার্ক পারমিট পাওয়া বেশ জটিল এবং সময়সাপেক্ষ বিষয়। ভিসা নীতি এবং অনুমোদন/নবায়ন প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য বিডা কি কোন উদ্যোগ নিতে পারে? 

চীনা উদ্যোক্তারা বাংলাদেশে জমি সংক্রান্ত সমস্যা, ভিসা এবং ওয়ার্ক পারমিট বাড়ানোর জটিলতা এবং শুল্ক সংক্রান্ত সমস্যাগুলিকে আরো বিনিয়োগের পথে প্রধান বাধা হিসাবে মনে করছেন। পাশাপাশি শিল্প খাতে চলমান গ্যাস সংকট বিদেশি এবং স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাস এবং বাংলাদেশ-চীন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিসিসিআই) আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা জানান। শনিবার (৯ সেপ্টেম্বর) রাজধানীতে 'স্টেকহোল্ডার কনসালটেশন উইথ চাইনিজ ইনভেস্টরস: চ্যালেঞ্জ, এক্সপেকটেশনস অ্যান্ড প্রসপেক্টস' নামক এই সেমিনার আয়োজন করা হয়। 

চীনা দূতাবাসের কমার্শিয়াল কাউন্সেলর সং ইয়াং এবং চায়না এন্টারপ্রাইজেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (সিইএবি) সভাপতি কে চাংলিয়াং সেমিনারে বক্তব্য রাখেন।

বিসিসিআই এবং সিইএবি-এর সদস্যরা বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনা করার সময় তাদের সম্মুখীন হওয়া বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন।

একজন চীনা উদ্যোক্তা বাংলাদেশে জমি কেনা বা ইজারা দেওয়ার সময় বিদেশি উদ্যোক্তারা যে সমস্যার মুখোমুখি হন তা তুলে ধরেন। জবাবে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) মহাপরিচালক শাহ মোহাম্মদ মাহবুব বলেন, এর কোনো সমাধান আমার কাছে নেই।

তিনি অবশ্য উদ্যোক্তাদের বেজার ইকোনমিক জোন এবং বেপজার এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন, বিসিকের ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিটি বা হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ থেকে জমি কেনার পরামর্শ দিয়েছেন।

মোহাম্মদ মাহবুব বলেন, 'বাংলাদেশে ভূমি আইন খুবই জটিল। ভূমি মন্ত্রণালয় সেগুলো নিয়ে কাজ করছে।'

১৩ বছর আগে টাঙ্গাইলে আকিজ সিএনজি প্ল্যান্ট স্থাপনের পর তিতাস গ্যাসের কাছে সংযোগের জন্য আবেদন করে আকিজ গ্রুপ। এখনো তারা সংযোগের অপেক্ষায় আছেন বলে জানান গ্রুপের পরিচালক আমিনউদ্দিন মিলন।

তিনি বলেন, 'আকিজ গ্রুপ তিতাসের কর্মকর্তাদের নির্দেশ অনুসারে ব্যাংক গ্যারান্টি দুবার বাড়িয়েছে এবং চারবার সিকিউরিটি ডিপোজিট সংশোধন করেছে। আমরা তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের কাছে সাহায্য চেয়েছি কিন্তু এখনও গ্যাস সংযোগ পাইনি। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা তিতাস গ্যাস ও বিডা কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি এসব কথা জানান। 

আমিনউদ্দিন বলেন, আকিজ গ্রুপ মেশিনারি আমদানি ও টাঙ্গাইল সিএনজি প্ল্যান্ট স্থাপনে ১০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করেছে। তবে গ্যাস না পাওয়ায় কারখানাটি চালু করা যায়নি।

জবাবে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) প্রকৌশলী স্বাগত কুমার সাহা বলেন, নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য শিল্প-কারখানায় গ্যাস সংযোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের সরবরাহের ঘাটতি রয়েছে। পেট্রোবাংলা এলএনজি আমদানির চেষ্টা করছে। সংকট কাটিয়ে উঠতে এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করা হয়েছে। আশা করি অল্প সময়ের মধ্যে সংযোগ দেওয়া হবে।

বিডা মহাপরিচালক শাহ মোহাম্মদ মাহবুব রবিবার আকিজ গ্রুপের পরিচালককে বিডা অফিসে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, বিডা অফিসে আসুন আমরা আপনার সমস্যা সমাধানে কাজ করব।

আরেকজন চীনা উদ্যোক্তা বলেন, বাংলাদেশে এক বছরের ভিসা এবং ওয়ার্ক পারমিট পাওয়া বেশ জটিল এবং সময়সাপেক্ষ বিষয়। ভিসা নীতি এবং অনুমোদন/নবায়ন প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য বিডা কি কোন উদ্যোগ নিতে পারে? 

এই প্রশ্নের উত্তরে শাহ মোহাম্মদ মাহবুব প্রশ্নকর্তাকে বিডা নির্দেশিকা পড়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, নিরাপত্তা ছাড়পত্রের জন্য আমরা নথিগুলি ম্যানুয়ালি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাই এবং সেখান থেকে নথিগুলি ম্যানুয়ালি পাঠানো হয় পুলিশের বিশেষ শাখায়। কিন্তু আমরা ডিজিটাল ফাইল ট্রান্সফারাল চালু করার উদ্যোগ নিয়েছি, এতে সময় কম লাগবে।

বিসিসিআই সভাপতি গাজী গোলাম মুর্তোজা বলেন, কাজের অনুমতির মেয়াদ বাড়ানোর জন্য উদ্যোক্তাদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়, যা তাদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করে।

মুর্তোজা বলেন, তাদের মধ্যে অনেক হতাশা রয়েছে। সমস্যার সমাধান করতে পারলে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ বাড়বে।

জবাবে বিডা কর্মকর্তারা বলেন, নিরাপত্তা সংস্থাগুলো ছাড়পত্র দিতে অনেক সময় এক বছর পর্যন্ত সময় নেয়।

একজন উদ্যোক্তা কাস্টমসের এইচএস কোড নিয়ে সমস্যার সমাধান সম্পর্কে জানতে চান। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক মূল্যায়ন ও পুরস্কার সচিব খন্দকার নজরুল হক বলেন, প্রায় ৯০ শতাংশ পণ্য একদিনের মধ্যে শুল্ক ছাড়পত্র পাচ্ছে। আমরা বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করতে পোস্ট ক্লিয়ারেন্স অডিটের উপর জোর দিচ্ছি। 

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিডার নির্বাহী সদস্য অভিজিৎ চৌধুরী বলেন, আমরা জানি বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধন করার পর উদ্যোক্তারা গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়া, জমি কেনা, কর ও  শুল্কসহ নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন। সেসব সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা আফটার কেয়ার সার্ভিস চালু করেছি। আমরা ইতিমধ্যেই আফটার কেয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে বিএসআরএম এবং লাফার্জ সিমেন্ট সহ বিভিন্ন কোম্পানির অনেক সমস্যার সমাধান করেছি।

তিনি বলেন, এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পর বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিপুল পরিমাণ চীনা বিনিয়োগের প্রয়োজন। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে আমাদের বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সম্পূর্ণ নিরাপত্তা নিয়ে বাংলাদেশে আসতে পারে।

বিসিসিআই মহাসচিব আল মামুন মৃধা বলেন, ২০১৯ সাল পর্যন্ত চীন বাংলাদেশে একক বৃহত্তম বিনিয়োগকারী ছিল। কোভিড এবং চীনের শূন্য কোভিড নীতির কারণে, কয়েক বছর ধরে চীনা বিনিয়োগ কম ছিল। তবে এখন প্রচুর বিনিয়োগ আসছে। চীনা বিনিয়োগ বাড়ালে বাংলাদেশের জন্য বিদ্যমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট মোকাবেলা করা সহজ হবে।

বাংলাদেশের মানবসম্পদ উন্নয়ন ও প্রযুক্তি হস্তান্তরে চীনা কোম্পানিগুলোর ভূমিকার প্রশংসা করে মামুন মৃধা বলেন, ২০০৩ সালে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ছিল ১.৪ বিলিয়ন ডলার, যা এখন প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। বেসরকারী খাতে বিনিয়োগও গত ১০ বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছ।  ২০১৩ সালের ২৬ মিলিয়ন থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ৪৬৫ মিলিয়ন ডলার হয়েছে। 

তিনি বলেন, ২০১৬ সালে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অংশ হিসাবে বাংলাদেশকে ৪০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। ইতিমধ্যেই, প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার বিতরণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে এবং কিছু প্রকল্প উদ্বোধন হতে চলেছে। বিসিসিআই বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের বিশাল প্রবৃদ্ধির জন্য শক্তিশালী অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছে।

সেমিনারে বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শাহ মোহাম্মদ মাহবুব।  এতে তিনি বলেন, কোনো একটি দেশে বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার রাজনৈতিক ও স্থিতিশীলতা, ট্যাক্স অব্যাহতি সুবিধা ও অন্যান্য ইস্যু, যার সবকিছু বাংলাদেশে রয়েছে। ২০৪০ সালে উন্নত দেশ হতে বাংলাদেশের অবকাঠামোখাতে ৬০৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন। 

তিনি বলেন, বাংলাদেশে মোট বিদেশি বিনিয়োগের ৭০.৪২% রিইনভেস্টমেন্ট। অর্থাৎ, এখানে যেসব বিদেশি উদ্যোক্তারা ব্যবসা করছেন, তারা মুনাফা করায় আবার পুনঃবিনিয়োগ করছেন।

জেট্রো'র স্টাডির কথা তুলে ধরে প্রবন্ধে বলা হয়, গত বছরের তুলনায় এবছর প্রফিটিবিলিটি ফোরকাস্ট, বিজনেস কনফিডেন্স ফোরকাস্ট বেড়েছে এবং লস মেকিং ফোরকাস্ট কমেছে।    

দ্য ফিউচার অব চাইনিজ ইনভেস্টরস নামক রিপোর্টে দ্য ইকোনমিস্ট বলেছে, যেসব দেশে রিস্ক কম এবং সুবিধা বেশি, এসব দেশের তালিকায় এক নম্বরে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৩ সালে চীনের বিনিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৫২তম, যা এবছর ১২তম।

'এতেই প্রমাণিত হয়, চীনের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী। এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনে এক ডলার বিনিয়োগ করলে ১৬ ডলার রিটার্ন পাওয়া যায়'

সেমিনারে বাংলাদেশে এগ্রো প্রসেসিং এন্ড মেশিনারি, তৈরি পোশাক শিল্পের হাই-এন্ড প্রোডাক্ট, রিসাইক্লিং এন্ড সার্কুলার ফ্যাশনস, মেন মেইড ফেব্রিক, আইটি, হেলথ এন্ড মেডিকেল ডিভাইস, অটোমোবাইল এন্ড পার্টস, ব্লু ইকোনমি, হসপিটিলিটি এন্ড ট্যুরিজম এবং চামড়া শিল্পে বিনিয়োগ করতে চাইনিজ উদ্যোক্তাদের আহ্বান জানিয়েছে বিডা। 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.