করদাতাদের ব্যাংক হিসাবের তথ্যে সরাসরি প্রবেশাধিকার চায় এনবিআর

অর্থনীতি

27 August, 2023, 12:00 am
Last modified: 27 August, 2023, 12:19 pm
রাজস্ব বোর্ড মনে করছে, এর মাধ্যমে কর ফাঁকি রোধ করা সম্ভব হবে...

কর ফাঁকি রোধ করার লক্ষ্যে একটি সংহতিমূলক উদ্যোগের আওতায়– বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে করদাতাদের ব্যাংক হিসাবের তথ্যে সরাসরি প্রবেশাধিকার চায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর ফলে রাজস্ব বোর্ড করদাতা ও ব্যবসায়ীদের ব্যাংকিং লেনদেনের তথ্য খুব সহজেই জানতে পারবে, যা তাদের অর্থের গতিপথ নজরদারিতে সহায়তা করবে।  

এনবিআরের অভ্যন্তরীণ সূত্র জানিয়েছে, ভ্যাট অনলাইন প্রজেক্ট অফিস এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে কাজ করছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এবিষয়ে অবহিত সূত্র জানিয়েছে, এটি বাস্তবায়ন হলে ব্যাংকের কাছে চিঠি দিয়ে ব্যবসায়ীর ব্যাংক হিসাব সংক্রান্ত তথ্য চাইতে হবে না, তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি সাপেক্ষে রাজস্ব বোর্ড সরাসরি তথ্যে প্রবেশাধিকার পাবে।

সেক্ষেত্রে ভ্যাট কমিশনারদের বিশেষ অনুমোদন দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, এবং শুধুমাত্র তাদের জন্য একটি কঠোর লগইন ব্যবস্থা থাকবে। সিকিউরড পাসওয়ার্ড এবং ওটিপি ব্যবহার করে এই এক্সেস পাবেন তারা।  
ভ্যাট অনলাইন প্রজেক্টের পরিচালক কাজী মোস্তাফিজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এই কার্যক্রম শুরু আগে কিছু প্রস্তুতিমূলক কাজ করতে হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক সেটা ডেভেলপ করছে। আশা করছি, ডিসেম্বর থেকেই এটা চালু করা যাবে।'

এনবিআর বর্তমানে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব কৌশল প্রণয়ন করছে, যার মধ্যে ব্যাংকের কাছে রক্ষিত করদাতাদের তথ্যে রাজস্ব প্রশাসনের প্রবেশাধিকারের বিষয়টিও রয়েছে।

রাজস্ব কৌশলটি প্রণয়নের লক্ষ্যে গঠিত কমিটি গত বৃহস্পতিবার (২৪ আগস্ট) এর খসড়া এনবিআর চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে উপস্থাপন করেছে।  

কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, 'বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে ইনটিগ্রেশনের অংশ হিসেবে ব্যাংক হিসাবে যাতে আমাদের এক্সেস থাকে, সে বিষয়ে  প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।'

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক টিবিএসকে জানান, এখনও পর্যন্ত এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়নি। হঠাৎ করে এনবিআরকে ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবে কেন প্রবেশাধিকার দিতে হবে, সেই প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, এই ধরনের সুযোগ সতর্কতার সাথে বিবেচনা করার প্রয়োজন আছে।   

এদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যাংক হিসাবের তথ্যে এনবিআরকে সরাসরি অ্যাক্সেস দেওয়া হলে তাতে ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি তৈরি হবে, ফলে ব্যাংকে লেনদেন কমে যেতে পারে। এবিষয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব তাদের তাদের কেউ কেউ।

রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আব্দুল মজিদ-ও এনবিআরের এমন ভাবনার সঙ্গে একমত নন। টিবিএসকে তিনি বলেন, ব্যাংক হিসাব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের গোপনীয় তথ্য, যা ব্যাংক আইনেও স্বীকৃত। এনবিআর বা কর কর্মকর্তারা যদি সবার হিসাবের প্রবেশাধিকার পায়– তা গোপনীয়তার নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে।

একই কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর।

কোম্পানি আইনের বিশিষ্ট আইনজীবী তানজীব-উল আলম বলেন, কর কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাংকের গোপনীয়তার বিষয়টিই এদেশে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে।

তিনি বলেন, বর্তমানে কাস্টমস ও ভ্যাট আইনে কর আদায়ের লক্ষ্যে এনবিআরকে এ ধরনের ক্ষমতা দেওয়া আছে। এখনকার আইনে রাজস্ব বোর্ডকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেওয়া আছে। তাই একসময় ব্যাংকের যে গোপনীয়তা ছিল, তা আর নেই।'

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এ উদ্যোগকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন। তবে তা স্বচ্ছতার সঙ্গে করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

ব্যাংক হিসাবে এনবিআরের সরাসরি অ্যাক্সেসের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে একটি ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার টিবিএসকে জানান, গত বছর তার অফিস থেকে প্রায় ১০০ জনের ব্যাংক হিসাব সংক্রান্ত তথ্য জানতে চাওয়া হলেও — ওই ব্যাংকটি দিতে পেরেছে মাত্র ৩০ জনের। বাকীদের হিসাব সংক্রান্ত তথ্য তাদের কাছে নেই বলে দাবি করে ব্যাংকটি।

এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, 'বর্তমানে কারো হয়তো চারটি ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট আছে, বা সেগুলো দিয়ে লেনদেন করছে। কিন্তু ভ্যাট বিভাগের কাছে তথ্য দেয়া হয়েছে হয়তো দুটির। ফলে সঠিক ট্রানজেকশন জানা যাচ্ছে না। আবার কোন প্রতিষ্ঠান হয়তো ব্যাংক থেকে বিশাল অংকের লোন নিল। ওই টাকা কি বিনিয়োগ হয়েছে কি-না তাও সঠিকভাবে জানা সম্ভব হচ্ছে না।'
 
ব্যবসায়ী পর্যায়ে সঠিক ভ্যাট আদায়ের তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'পুরান ঢাকায় বিভিন্ন মার্কেটে শত শত কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। এসব লেনদেনের ওপর ট্রেড ভ্যাট হিসেবে ৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় হওয়ার কথা। কিন্তু, এগুলোর সঠিক তথ্য জানা যাচ্ছে না।"

ব্যাংকের সাথে সংহতি হলে তা কীভাবে কাজ করবে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোটি কোটি ব্যাংক হিসাবের তথ্য জানা সম্ভব নয়, কিংবা তার দরকারও নেই। 'রিস্ক ম্যানেজমেন্ট এর মাধ্যমে ব্যাংক হিসাব শনাক্ত করা হবে- যাতে যেকোন সময় চাইলেই সেগুলোর তথ্য সংগ্রহ করা যায়।'   

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, দেশে গত ডিসেম্বর নাগাদ ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ছিলো ১৩ কোটি ৬২ লাখ, যেখানে মোট জমার পরিমাণ ছিল প্রায় ১৬ লাখ কোটি টাকা। এরমধ্যে ১ কোটি টাকার উপরে লেনদেন হয়েছে, এমন একাউন্টের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার।

এনবিআরের ভ্যাট অনলাইন প্রজেক্ট অফিসের হিসাব অনুযায়ী, দেশে বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন (বিআইএন) নম্বরধারীর সংখ্যা ৪ লাখ ৫৭ হাজার, যার মধ্যে গত মাসে কর রিটার্ন জমা হয়েছে ৩ লাখের বেশি। অর্থাৎ, বিআইএন হোল্ডারদের এক-তৃতীয়াংশও রিটার্ন জমা দিচ্ছে না।

দেশের জিডিপির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে না কর সংগ্রহের অনুপাত

এনবিআরের তথ্য বলছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জিডিপিতে রাজস্বের অবদান (ট্যাক্স টু জিডিপি রেশিও) না বেড়ে উল্টো কমতির দিকে, সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে এই অনুপাত ৮.৭ শতাংশে নেমেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন।  

অথচ অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে এই অনুপাত ১২.৩ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। এসব লক্ষ্য অর্জনে সক্রিয়ভাবে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব কৌশল প্রণয়ন করছে এনবিআর।

প্রাথমিকভাবে চলতি বছরের মার্চে এটি চূড়ান্ত হওয়ার কথা থাকলেও, তা হয়নি। আগামী ডিসেম্বর নাগাদ তা চূড়ান্ত হবে বলে জানায় অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো। থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ও অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে আগামী ডিসেম্বর নাগাদ এটি চূড়ান্ত হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।  

খসড়া রাজস্ব কৌশলে যা রয়েছে

মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব প্রতিবেদনের খসড়া অনুযায়ী, ব্যাংকের সাথে সংহতি ছাড়াও কাস্টমসের এসাইকুডা ওয়ার্ল্ড (ASYCUDA) সিস্টেম, এবং অন্যান্য সিস্টেম সাথেও ভ্যাট এর সংহতির কথা বলা হয়েছে।
অন্যদিকে, এনবিআরের কাঠামো ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে– এনবিআর ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগকে 'রাজস্ব বিভাগ' নামে একীভূত করা এবং এ বিভাগের জন্য একজন পূর্ণ প্রতিমন্ত্রী নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। রাজস্ব বিভাগে একটি গবেষণা ও নীতি বিশ্লেষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কথাও রয়েছে প্রস্তাবনায়।  

অর্থপাচার রোধে একটি বিশেষায়িত মানি লন্ডারিং ইউনিট স্থাপনের প্রস্তাবও রয়েছে খসড়া কৌশলপত্রে।

এনবিআরের একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, বর্তমানে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর (সিআইআইডি) এবং এনবিআরের কেন্দ্রীয় ইন্টেলিজেন্স সেল- অর্থপাচার রোধে কাজ করে। প্রস্তাব অনুযায়ী, বিশেষায়িত এ ইউনিটগুলোয় দক্ষ ও অভিজ্ঞদের পদায়ন করে– তাদেরকে দীর্ঘসময় এ বিভাগগুলোয় কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।

এছাড়া, ভ্যাট প্রক্রিয়া সরলীকরণ, সংহতি ও আধুনিকায়নের জন্য ব্যাপকতর অটোমেশন, ভ্যাট দাতাদের স্বেচ্ছায় বিধিমালার মান্যতা নিশ্চিত করা, ডিজিটাল অর্থনীতি থেকে ভ্যাট সংগ্রহ, ট্রান্সফার প্রাইসিং ও ঝুঁকি-ভিত্তিক নিরীক্ষা এবং বিগ ডেটা এনালিটিক্সের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করা হয়েছে।  

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.