চট্টগ্রামের বে-টার্মিনাল নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের ঋণ বিলম্বিত হতে পারে আরও এক বছর
চট্টগ্রামের বে টার্মিনাল প্রকল্পের জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার ব্যাপারটি আরও এক বছর বিলম্বিত হতে পারে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা এবং এর পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব মূল্যায়নসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ না হলে, বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আরও বছরখানেকের জন্য বিপত্তিতে পড়তে পারে বাংলাদেশ।
এর আগে, ২০১৭ সালে এই প্রকল্পের চারটি অংশের একটি 'ব্রেকওয়াটার অ্যান্ড অ্যাকসেস চ্যানেল'-এর জন্য ৩৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন করেছিল বিশ্বব্যাংক। কিন্তু প্রকল্পের অন্যান্য অংশের জন্য অর্থায়ন নিশ্চিত করতে বিলম্ব হওয়ায়, পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্মাণ কাজ শুরু করা যায়নি।
এরমধ্যে নির্মাণ সামগ্রীসহ অন্যান্য পণ্য বা পরিষেবার মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রকল্পের ব্যয় বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ কারণে বিশ্বব্যাংক থেকে অতিরিক্ত অর্থায়নের প্রয়োজন হবে বলে জানা গেছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) সূত্রে।
তবে চলমান সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা এবং মহাপরিকল্পনা সংশোধনের পরে অর্থায়নের সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
কর্মকর্তারা জানান, দক্ষিণ কোরিয়ার দুই কোম্পানি- কুনহওয়া কনসাল্টিং অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড এবং ডিওয়াই ইঞ্জিনিয়ারিং- সম্ভাব্যতা সমীক্ষা যাচাইয়ের কাজ করছে। এই সমীক্ষার জন্য সরকার ২২ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এ বছরের শেষ নাগাদ সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা শেষ করে পরের বছর মে মাসের মধ্যে প্রয়োজনীয় অনুমোদন নিশ্চিত করা না গেলে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন আরও এক বছর পিছিয়ে যাবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের কাছাকাছি পরিকল্পিত বে-টার্মিনাল নির্মাণ বাংলাদেশের জন্য বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা দ্বার উন্মোচন করবে করবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।
গত ২ আগস্ট প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, টার্মিনালের অপ্টিমাইজড অপারেশন (কার্যক্রম) থেকে বার্ষিক ৩৬৩ মিলিয়ন ডলার অর্জনের সম্ভাবনা রয়েছে।
বে টার্মিনালের কার্যক্রম শুরু হলে বন্দরে জাহাজগুলোকে অপেক্ষাকৃত অনেক কম সময় অপেক্ষা করতে হবে, জাহাজ পরিষেবা ব্যবস্থাপনাও হবে আরও উন্নত। যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং এর প্রতিযোগিতামূলক স্থানকে আরও শক্তিশালী করে তুলবে।
তবে এই প্রকল্পের যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও, প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজটি হতাশাজনকভাবে বিলম্বিত হয়েছে। ২০১১ সালে সরকারি সিদ্ধান্ত এবং পরবর্তীতে ২০১৮ সালের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বে-টার্মিনালের কাজ উদ্বোধন করলেও প্রকল্পটি বাস্তবায়নের অগ্রগতি এখনও অধরাই রয়ে গেছে।
বে-টার্মিনাল নির্মাণের প্রাথমিক সম্ভাব্যতা সমীক্ষাটি হয়েছিল ২০১৭ সালে। জার্মানির এইচপিসি হামবুর্গ পোর্ট কনসালটিং এবং বাংলাদেশের কেএস কনসালটেন্টস লিমিটেডের সহযোগিতায় জার্মান ফার্ম শেল হর্নের নেতৃত্বে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। সমীক্ষাটির অর্থায়নে সরকার ৬ কোটি টাকা ব্যয় করে।
ব্যয় বৃদ্ধি
প্রাথমিক সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, চট্টগ্রামের বে টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ২.৫ বিলিয়ন ডলার।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন হিসাব অনুযায়ী, প্রকল্পের ব্রেকওয়াটার অ্যান্ড অ্যাকসেস চ্যানেল অংশের নির্মাণ ব্যয় ৪০০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে, এই অংশের সম্পূর্ণ খরচ বিশ্বব্যাংকের ঋণের মাধ্যমে বহন করা হবে।
গত ফেব্রুয়ারির ৫-১৫ তারিখ এই প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করেছে। অতিরিক্ত অর্থায়নের জন্য বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে বলে জানান বন্দর কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কেবল বে-কন্টেইনার প্রকল্পের ব্রেকওয়াটার অ্যান্ড অ্যাকসেস চ্যানেল অংশের ব্যয়ই নয়, অন্যান্য অংশের ব্যয়ও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রকল্পটির আরও তিনটি অংশ রয়েছে- মাল্টিপারপাস টার্মিনাল এবং কন্টেইনার টার্মিনাল ১ ও কন্টেইনার টার্মিনাল ২ সহ সড়ক এবং রেল সংযোগ ব্যবস্থা।
এরমধ্যে মাল্টিপারপাস টার্মিনাল এবং সড়ক ও রেল সংযোগের জন্য অর্থায়ন করবে সরকার। বাকি দুটি টার্মিনাল পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেলের ভিত্তিতে নির্মাণ করা হবে।
জি-টু-জি সহযোগিতায় আইএফসি এবং সুমিটোমোর সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কন্টেইনার টার্মিনাল ১ নির্মাণ করবে সিঙ্গাপুরের পিএসএ। অন্যদিকে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডের সাথে জি-টু-জি চুক্তির মাধ্যমে নির্মিত হবে কন্টেইনার টার্মিনাল ২।
টার্মিনাল দুটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকায় নির্মিত হবে এবং এদের মধ্যে একটির পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
নতুন সময়সীমা
মূলত ২০২১ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বন্দর কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা জানান, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেলে সম্মত বিনিয়োগকারী না পাওয়ায় প্রকল্পটির নির্মাণ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি।
আগামী বছর চট্টগ্রাম বে-কন্টেইনার নির্মাণের কাজ শুরু করতে চাইছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এ লক্ষ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্নের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তারা।
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের পিপিপি সেলের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) ড. মো. রফিকুল ইসলাম খান জানান, সরকারের লক্ষ্য আগামী বছরে বে-টার্মিনালের নির্মাণ কাজ শুরু করা।
তবে, গত পাঁচ বছরে নির্মাণ সামগ্রীর ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় প্রকল্পের সামগ্রিক ব্যয় বাড়বে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী রাফিউল আলম বলেন, আগামী বছরের মে মাসের মাঝামাঝি বে-টার্মিনাল প্রকল্পের অনুমোদন প্রক্রিয়া শেষ না হলে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের সময়সীমা বিলম্বিত হতে পারে।
এছাড়া, সিঙ্গাপুর এবং দুবাইয়ের দুই এন্টারপ্রাইজ পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ভিত্তিতে প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত রয়েছে। অনুমোদনের যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষ হলে, এই পিপিপি সংস্থাগুলো তাদের বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে কাজ শুরু করতে পারবে।
রাফিউল আলম আরও বলেন, "এ অবস্থায় অনুমোদন প্রক্রিয়া শুরু করতে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও মহাপরিকল্পনা হালনাগাদ করণের কাজ আগামী চার মাসের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য রয়েছে।"
২০২৯ সালে অপারেশনে যাওয়ার লক্ষ্য
আগামী বছর চট্টগ্রাম বে-টার্মিনাল প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু করতে চায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ)। একই বছরের মে মাসের মধ্যে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির বৈঠকে প্রকল্পটি উপস্থাপনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান বার্ষিক কনটেইনার হ্যান্ডলিং ক্ষমতা ৩০ লাখ টুয়েন্টি-ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট (টিইইউ)-এর বেশি। বে-টার্মিনাল নির্মিত হলে ২০৩০ সাল নাগাদ কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।