ডিমের বাজার থেকে প্রতিদিন ৮-১২ কোটি টাকা বাড়তি মুনাফা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে: ভোক্তা অধিদপ্তর
দেশে দৈনিক চার কোটি ডিমের চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে প্রতি ডিম ২-৩ টাকা বেশি দামে বিক্রি করে প্রতিদিন ৮ থেকে ১২ কোটি টাকা বাড়তি মুনাফা করা হয়েছে—যা খামারি, পাইকারি ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত সবার পকেটে ঢুকেছে বলে জানিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর (ডিএনসিআরপি)।
সোমবার ডিমের উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে ভোক্তা অধিদপ্তরের সভাকক্ষে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা তুলে ধরেন ডিএনসিআরপির মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান।
সফিকুজ্জামান বলেন, 'এতদিন আমাদের কাছে ডিম উৎপাদনের সঠিক খরচের হিসাব ছিল না। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে আমরা সেটা জেনেছি। খুচরায় কত দাম হবে, সেটাও বলা হয়েছে। সুতরাং, কেউ একটা ডিমের দাম ১২ টাকার বেশি নিলে তাদের বিরুদ্ধে শুধু জরিমানা নয়, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হবে।'
তিনি বলেন, 'ডিম এমন একটা পণ্য যা সারা দেশের সব শ্রেণির মানুষের ওপরেই প্রভাব ফেলে। গত বছর ডিমের বাজারে অস্থিরতার সময় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল রশিদ ছাড়া ডিম ক্রয়-বিক্রয় না করতে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা সেটা মানেননি। এবারও আমরা বাজার মনিটরিংয়ে যাওয়ার পর একই অবস্থা দেখতে পাই। কিন্তু রশিদ ছাড়া কেউ বেচাবিক্রি করলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে জরিমানাসহ কঠোর ব্যবস্থা নেব। আর কোনো ছাড় দেয়া হবে না।'
সভায় উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীরা ভোক্তা অধিদপ্তরকে বলেন, প্রতিটি ডিমের উৎপাদন খরচ ১০.৫০ টাকা হলে, তা খুচরায় ১২ টাকা বিক্রি করতে সমস্যা দেখা দেবে।
পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, 'ডিমের উৎপাদন খরচ ১০.৮০-১০.৮৫ টাকা। সুতরাং, খুচরা মূল্য ১৩ টাকা হওয়া উচিত।'
তেজগাঁও বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি হাজী মো. আমান উল্লাহ ভিকেন, ডিমের দাম ১৩ টাকার নিচে নামলে সেটা খামারিরা লোকসানে পড়বেন।
সভায় ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, 'কাজী ফার্মস, প্যারাগনের মতো বড় প্রতিষ্ঠান সাড়ে ১০ টাকায় ডিম উৎপাদন করে সর্বোচ্চ ১১.৪০ টাকায় ডিম বিক্রি করেছে। আমরা কি যৌক্তিক উপায়ে ১০ শতাংশও লাভ করতে পারবো না?'
জবাবে ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সফিকুজ্জামান বলেন, 'কে কত লাভ করবে সেই আলোচনা করতে হলে উৎপাদনকারী, ব্যবসায়ীদেরকে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। সেই সুযোগ রয়েছে। এখন আমরা ১২ টাকা ধরেই বাজারে অভিযান পরিচালনা করব।'
ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, 'চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ডিম উৎপাদনের পরিকল্পনা করা দরকার। চাহিদা অনুযায়ী জেলা বা উপজেলা অনুযায়ী ম্যাপিং করে যখন যেখানে উৎপাদন করা দরকার, যখন উৎপাদন কমিয়ে আনা দরকার, সেইমতো ব্যবস্থা করতে হবে। এ বিষয়ে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।'
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (এক্সটেনশন) ড. মো. শাহীনুর আলম বলেন, 'উৎপাদনের সঙ্গে বিপণনের সামঞ্জস্যতার জন্য সরকার নানা ধরনের পলিসি, কর্মকৌশল, গাইডলাইন তৈরির কাজ শুরু করেছে। একই সঙ্গে মধ্যস্বত্বভোগীদেরকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতেও কাজ করছে।'
তবে ডিমের বাজারে যারা অস্থিরতা তৈরিতে কাজ করেছে, তাদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে জানিয়ে প্রতিযোগিতা কমিশনের সদস্য মো. হাফিজুর রহমান বলেন, 'আমরা মামলা করার জন্য তথ্য সংগ্রহ করছি।'
এক সপ্তাহের ব্যবধানে ডিমের দাম ডজনে ১৮০ টাকায় (প্রতি ডিম ১৪-১৫ টাকা) উঠে যায়।
গত রবিবার প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম ডিমের উৎপাদন খরচ ১০.৫০ টাকা বলে উল্লেখ করেন। একই সঙ্গে খুচরা পর্যায়ে প্রতি পিস ডিমের দাম কোনোভাবেই ১২ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয় বলেও জানান।
এই ঘোষণার পর খুচরা বাজারে ডিমের দামে প্রভাব না পড়লেও পাইকারু বাজারে কমতে শুরু করেছে। পাইকারিতে যে ডিম ১২.৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল, সেটি রবিবার রাতে ১২ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
সোমবার রাতে এটা প্রতি পিস ডিমের দাম ১২ টাকার নিচে নেমে আসবে বলে জানান পাইকারি বিক্রেতারা।
দাম বাড়ার কারণ
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট পোল্ট্রি খামারের (ব্রয়লার ও লেয়ার) সংখ্যা ২ লাখ ৫ হাজার ২৩১টি। এর মধ্যে ৮৫ হাজার ২২৭টি খামার নিবন্ধিত।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলেন, ন্যায্য দাম না পাওয়ায় প্রায় অর্ধেক লেয়ার খামার বন্ধ হয়ে গেছে।
ডিম উৎপাদনকারীরা জানান, মহামারির আগে দেশে ডিমের দৈনিক উৎপাদন ছিল প্রায় ৫ কোটি পিস। কিন্তু মহামারিকালে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির কারণে অনেক খামার বন্ধ হয়ে যায়।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রি সেন্ট্রাল কাউন্সিল বলেছে, অনেক লেয়ার ফার্ম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বর্তমান দৈনিক ডিম উৎপাদন ৪ কোটি পিসের নিচে নেমে এসেছে।
ব্রিডারস অ্যাসোসিয়েশন অভ বাংলাদেশের সিনিয়র সহসভাপতি আবু লুৎফে ফজলে রহিম খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'চাহিদা ও যোগানের মধ্যে একটা বড় পার্থক্য রয়েছে। কারণ প্রকৃত চাহিদা কত, তা আমরা জানি না। অনেক সময় দাম বেশি হলে, উৎপাদন বেড়ে যায়। আবার উৎপাদন যখন বেশি হয়, তখন দাম পড়ে যায়।'
উৎপাদকদের মতে, বিভিন্ন উপকরণের দাম বাড়ায় ফিডের দাম বেড়েছে, এতে বেড়েছে উৎপাদন খরচ।