চীনের নেতৃত্বাধীন বাণিজ্যিক ব্লক আরসেপ-এ যোগদানের পক্ষে মন্ত্রণালয়

অর্থনীতি

01 August, 2023, 11:00 pm
Last modified: 01 August, 2023, 11:03 pm

চীনের নেতৃত্বাধীন বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্লক রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপে (আরসেপ) বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির পক্ষে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা। 

মঙ্গলবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্ত এখন মন্ত্রিপরিষদ সভায় উপস্থাপন করা হবে। 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (এফটিএ) নূর মো. মাহবুবুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় কিছু পূর্বসতর্কতাসহ আরসেপে বাংলাদেশের যোগদানের পক্ষে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।'

কবে নাগাদ আবেদন করা হবে, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অন্তর্ভুক্তি প্রক্রিয়া সম্পর্কে ওই চুক্তিতে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। 

'অর্থাৎ আরসেপে অন্তর্ভুক্তির জন্য বাংলাদেশকে শুধু একটি আবেদন করলেই হবে, নাকি কোনো প্রেসক্রাইবড মডেল অনুসরণ করতে হবে, সে সম্পর্কে এখন খোঁজখবর নিতে হবে,' বলেন তিনি।

গত বছরের জানুয়ারিতে যাত্রা শুরু করেছে ১৫ দেশের বাণিজ্যিক জোট আরসেপ। এই ১৫ দেশের মোট জনসংখ্যা ২.৩ বিলিয়ন (বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ), বাজারের আকার ২৬.৩ ট্রিলিয়ন ডলার।

নিয়মানুযায়ী, চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে অন্য দেশও আরসেপে অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করতে পারছে। ইতিমধ্যে শ্রীলঙ্কা ও হংকং ব্লকটিতে অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করেছে।

আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। 

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী ও সমপর্যায়ের দেশ ভিয়েতনাম কোন ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আরসেপে যোগদান করেছে, সেগুলোও পর্যালোচনা করা হয়েছে সভায়।

সভায় অংশ নেওয়া একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, অনেক বিষয় চিন্তা করেই আরসেপে যোগদানের পক্ষে নীতিগত সিদ্ধান্ত এসেছে। একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্ব অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র আসিয়ানসহ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো, যারা আরসেপের অন্তর্ভুক্ত। ফলে বিশ্ব অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সংযুক্ত থাকা যৌক্তিক হবে।

কর্মকর্তারা বলেন, আরসেপকে চীনের নেতৃত্বাধীন বাণিজ্যিক ব্লক বলা হলেও যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়াও এই জোটের সদস্য। তাছাড়া ভারত যেকোনো সময় প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য হিসেবে আরসেপের সদস্য হতে পারবে। 

অন্যদিকে, বাংলাদেশ এখন যেসব দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করার বিষয়ে আলোচনা করছে, তার মধ্যে ছয়টি দেশ আরসেপে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই ব্লকে যোগ দিলে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ৫ বিলিয়ন ডলার বাড়ার সম্ভাবনার চিত্র সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় উঠে এসেছে।

আরসেপভুক্ত দেশগুলো নিজেদের শুল্ক কমানোর জন্য ১০ বছর থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত সময় নিয়েছে। বাংলাদেশ আরসেপে অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করলে আরসেপভুক্ত ১৫ দেশ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। এক্ষেত্রে প্রত্যেকটা দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের পৃথকভাবে দরকষাকষি করতে হবে। ফলে একেক দেশের সঙ্গে একেক রকম দরকষাকষি করতে হবে।

সভায় উপস্থিত বেশিরভাগই আরসেপে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে মতামত দিয়েছে বলে জানান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তারা বলেন, আরসেপে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে আঞ্চলিক ভ্যালু চেইনে সংযুক্ত হওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের রপ্তানি কতটুকু বাড়তে পারে, সে সম্ভাবনা নিয়েও মতামত উঠে এসেছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ভিয়েতনাম চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি করে। দেশটিতে চীনের বিনিয়োগও প্রচুর। আবার চীনসহ আরসেপভুক্ত দেশগুলোতে ভিয়েতনামের রপ্তানির পরিমাণও উল্লেখযোগ্য। ফলে ভিয়েতনাম ইতিমধ্যে আরসেপভুক্ত দেশগুলোর ভ্যালু চেইনের সঙ্গে সংযুক্ত ও ইন্টিগ্রেটেড। 

ওই কর্মকর্তা বলেন, 'বাংলাদেশ এই ইন্টিগ্রেশনের বাইরে থাকলেও আমাদের কাঁচামাল আমদানির মূল উৎস চীন। এ অবস্থায় আরসেপে যোগদান করে বাংলাদেশ কীভাবে সুফল পেতে পারে, সে বিষয়টি সভায় গুরুত্ব পেয়েছে।'

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে কম্প্রেহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ চুক্তি করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভারতও আরসেপে যোগদানের বিষয়ে আলোচনা করে রেখেছে, চূড়ান্তভাবে যোগ দেয়নি। যেকোনো সময় দেশটি চাইলে আরসেপের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে যোগ দিতে পারবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করে আবার আঞ্চলিক ভ্যালু চেইনে সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়টি অন্যতম ইস্যু হিসেবে সভায় আলোচিত হয়েছে ।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, আরসেপে যোগ দিলে করলে প্রথম ১০ বছরের মধ্যে ৯০ শতাংশ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক কমাতে হবে। বাকি ১০ শতাংশের শুল্ক কমানোর জন্য বাড়তি ১৫ বছর সময় পাওয়া যাবে।

তিনি বলেন, আরসেপভুক্ত প্রত্যেকটা দেশের সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচনা করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোথায় কোন ধরনের আইন-কানুন রয়েছে, সেগুলো ভালোভাবে পর্যালোচনা করতে হবে। সেবা খাত, বিনিয়োগ ও ট্রিপস-এর (ট্রেড-রিলেটেড অ্যাসপেক্টস অভ ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস) আওতায় বাংলাদেশ যেসব সুবিধা পায়, সেগুলো মাথায় রেখে আলোচনা করতে হবে। 

এছাড়া, বাংলাদেশ কোথায় কোথায় রিজার্ভেশন রাখবে, সে বিষয়েও আগে থেকে পর্যাপ্ত সমীক্ষা করার প্রয়োজন রয়েছে বলে মন্তব্য করেন ওই কর্মকর্তা।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ডিস্টিঙ্গুইশড ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এটি 'ভাল উদ্যোগ'। তিনি আরও বলেন, এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উত্তরণের প্রাক্কালে বাংলাদেশের আরসেপে যোগদান এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নিয়ে আলোচনা একটি 'সময়োপযোগী পদক্ষেপ'।

তিনি বলেন, আরসেপে যোগদান করতে হলে বাণিজ্য উদারীকরণ ও শুল্ক হ্রাস করতে হয়। স্থানীয় শিল্পের প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য মান বাড়ানো, সমন্বয় ও মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এই অর্থনীতিবিদ টিবিএসকে বলেন, আসিয়ান চুক্তিতে দুই ধরনের নিয়ম ছিল। কম্বোডিয়াসহ কয়েকটি দেশ অন্যদের চেয়ে অতিরিক্ত সুবিধা পেত। বাংলাদেশও আরসেপ থেকে একই ধরনের সুবিধা পেতে পারে।

অর্থাৎ বাংলাদেশ আরসেপভুক্ত দেশগুলো থেকে বেশি সুবিধা পাবে, কিন্তু কম দেবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ আরসেপে যোগ দিলে এসব দেশ থেকে পণ্য আমদানির সময় শুল্ক থেকে সরকারের আয় কমে যাবে।

তিনি আরও বলেন, 'সরকারকে রপ্তানি বাড়িয়ে এর ক্ষতি পোষাতে হবে। সেজন্য বিদেশি বিনিয়োগের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশে আরসেপভুক্ত দেশগুলো থেকে বিনিয়োগ বাড়লে রপ্তানিও বাড়বে। এর মাধ্যমে রপ্তানি বহুমুখীকরণও সম্ভব হবে।'

বর্তমানে বাংলাদেশের রপ্তানির ১২ শতাংশ দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব এশিয়া ও আসিয়ান দেশগুলোতে যায় বলে জানান তিনি।।

বাংলাদেশ-চীন চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন মৃধা বলেন, আরসেপে যোগদানকারী দেশগুলোতে গত দেড় বছরে চীনের বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।

তিনি টিবিএসকে বলেন, 'বাংলাদেশ আরসেপে যোগ দিলে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগও বাড়বে। রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের পাশাপাশি বাংলাদেশের শিল্প খাত প্রযুক্তি স্থানান্তরের মাধ্যমে বিকাশিত হওয়ার সুযোগ পাবে।'

নূর মো. মাহবুবুল হক বলেন, 'আমরা এখন যাদের সঙ্গে এফটিএ নিয়ে আলোচনা করছি, তার মধ্যে ভারত ছাড়াই ছয়টি দেশ—জাপান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন—আরসেপে রয়েছে। অর্থাৎ আরেসেপভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে আমরা দ্বিপাক্ষিক চুক্তির বিষয়ে আলোচনা করছি। যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ এফটিএ করতে আগ্রহী, তাদেরই যেহেতু একটা ফোরাম আছে, সেখানে দ্বিপাক্ষিকভাবে ও গ্রুপভিত্তিক দরকষাকষিতে বাংলাদেশ কীভাবে সম্পৃক্ত হবে, সে বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।'

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, দেশের টেক্সটাইল খাতে যে রূপান্তর হচ্ছে, তাতে আগামী দিনে তুলার চেয়ে ম্যানমেড বা কৃত্রিম ফাইবার গুরুত্ব পাচ্ছে। আরসেপভুক্ত দেশগুলোতে বাংলাদেশ তা কতটা রপ্তানি করতে পারব, সে বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।

তারা বলেন, আমদানির ক্ষেত্রে উচ্চ শুল্কারোপ ও নানা বাধা দিয়ে দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিচ্ছে বাংলাদেশ। ফলে দেশের উদ্যোক্তারা বিদেশে পণ্য রপ্তানির চেয়ে দেশের বাজারে বিক্রি করাকেই বেশি লাভজনক মনে করেন। এ অবস্থায় আরসেপে যোগ দিলে দেশীয় শিল্প কতটা প্রতিযোগিতা-সক্ষম হবে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

স্থানীয় শিল্পের প্রতিযোগিতা-সক্ষমতার কথা বিবেচনা করেই ভারত শেষ মুহূর্তে আরসেপে যোগদান থেকে বিরত থেকে। দেশটির সঙ্গে আসিয়ানের এফটিএ রয়েছে। এতে ভারতের স্থানীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তারা আরসেপে যোগ দেয়নি।

আমদানি নীতি আদেশ, রপ্তানি নীতি আদেশ, ট্যারিফ পলিসি, এফটিএ পলিসিসহ বাংলাদেশ এখন যেসব পলিসি প্রণয়ন করছে, তা এলডিসি উত্তরণ ও বাণিজ্য উদারীকরণের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে করা হচ্ছে বলে জানান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

আরসেপে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে শুল্ক কমানোর জন্য যে ১০ থেকে ২৫ বছর সময় পাওয়া যাবে, এই সময়টা বাংলাদেশ কীভাবে ব্যবহার করবে, অর্থনৈতিক রুপান্তরের সঙ্গে এগুলোর সমন্বয় কেমন হবে এবং এলডিসি উত্তরণের সঙ্গে আরসেপের সংযোগ কীভাবে হতে পারে, এসব বিষয়ে কাজ করতে হবে বলে জানান তারা।

মঙ্গলবারের সভাটি ছিল আরসেপ নিয়ে বাংলাদেশের চতুর্থ সভা। এর আগে আরসেপ সম্পর্কে বিভিন্ন দূতাবাসের মাধ্যমে প্রতিবেদন সংগ্রহ করে তা নিয়ে প্রথম সভাটি করেছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সভায় আরসেপে যোগদানের বিষয়ে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা নিয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

অন্তর্ভুক্তির পক্ষে ট্যারিফ কমিশন

ট্যারিফ কমিশন তাদের সমীক্ষায় আরসেপে যোগদানের সুবিধা-অসুবিধাগুলো খতিয়ে দেখেছে। তাদের প্রতিবেদনে মূলত এ জোটে যোগ দেওয়ার পক্ষেই মত দেওয়া হয়েছে।

ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরসেপে যোগ দিলে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি ১৭.৩৭ শতাংশ বাড়বে, যার পরিমাণ ৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.