প্লাস্টিক শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা: ১০ বছর কর প্রণোদনা পাবেন উদ্যোক্তারা 

অর্থনীতি

17 July, 2023, 11:25 am
Last modified: 17 July, 2023, 11:53 am
নীতিমালায় বলা হয়েছে, আমদানিকৃত মূলধনী সরঞ্জাম, খুচরা যন্ত্রাংশ বা আনুষঙ্গিকের উপর শুল্ক ছাড়, কাঁচামাল এবং সরবরাহসমূহের উপর ট্যাক্স ক্রেডিট পাবে প্লাস্টিক শিল্প। 

প্লাস্টিক শিল্পের টেকসই উন্নয়নে স্বল্প সুদে ঋণ, প্লাস্টিক পার্ক ও অনগ্রসর অঞ্চলের উদ্যোক্তাদের প্রথম দশ বছর আয়কর অব্যাহতি ‍ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক ছাড় প্রণোদনার সুযোগ রেখে প্লাস্টিক শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা-২০২৩ চূড়ান্ত করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। 

বৈশ্বিক প্লাস্টিক বাজারে অংশগ্রহণ বাড়ানো ও বিদ্যমান বাজার সম্প্রসারণে পাঁচ বছর মেয়াদী এই নীতিমালা প্রণয়ন করেছে মন্ত্রণালয়, যা ২০২৮ সালের মধ্যে বাস্তবায়িত হবে। 

নীতিমালায় নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির মাধ্যমে প্লাস্টিক শিল্পের উন্নয়নে নীতি সহায়তা দিতে একটি সময়াবদ্ধ পরিকল্পনাও চূড়ান্ত করা হয়েছে।

এই পরিকল্পনাতে ৯টি কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে স্থানীয় শিল্পসমূহের সংখ্যা বৃদ্ধি, সক্ষমতা তৈরী, আন্তর্জাতিক বাজারে অভিগম্যতা বৃদ্ধিতে আধুনিক প্লাস্টিক শিল্প উন্নয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, রপ্তানি বৃদ্ধিতে কমপ্লায়েন্স বাড়ানো, দক্ষতা উন্নয়নের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

দেশীয় শিল্পসমূহের জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা নিশ্চিতে প্লাস্টিক খাতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলোকে স্বল্পসুদে বিশেষ করে তহবিল খরচের সঙ্গে ৩% সুদে ঋণ প্রদানের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। এসএমই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে।

উল্লেখ্য, প্লাস্টিক শিল্পের উন্নয়নে ২০২১ সালে খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করে মন্ত্রণালয়। প্রায় ‍দুই বছর পর এই নীতিমালার উপর স্টেকহোল্ডারদের মতামতের ভিত্তিতে চলতি বছরের জুনে নীতিমালাটি চূড়ান্ত করা হয়েছে।

নীতিমালায় বলা হয়েছে, নতুন পণ্য, উপজাত থেকে চূড়ান্ত পণ্য, জ্বালানি ও পানির কার্যকর এবং দক্ষ ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদনকারী শিল্পকে কর অব্যাহতি এবং ক্ষুদ্র ও কুটির প্লাস্টিক শিল্পকে কর অব্যাহতি সুবিধা প্রদান করা হবে।

নীতিমালায় প্রণোদনার বিষয়ে বলা হয়েছে, প্লাস্টিক পার্ক বা অনগ্রসর অঞ্চলসমূহে প্রথম ১০ বছর আয়কর অব্যাহতি প্রদান করা হবে। আমদানিকৃত মূলধনী সরঞ্জাম, খুচরা যন্ত্রাংশ বা আনুষঙ্গিকের উপর শুল্ক ছাড়, কাঁচামাল এবং সরবরাহসমূহের উপর ট্যাক্স ক্রেডিট পাবে প্লাস্টিক শিল্প। 

শিল্পের প্রয়োজনীয় মূল অবকাঠামো উন্নয়ন কাজেও প্রয়োজনীয় কর ছাড় প্রদান করা হবে বলে নীতিমালায় বলা হয়েছে।

এছাড়াও প্লাস্টিক শিল্পখাতকে ভূমিভিত্তিক টেলিযোগাযোগ, বিদ্যুৎ, উপযোগিতা সমূহসহ স্থানীয় পণ্য ও সেবাসমূহ ক্রয়ে ভ্যাট হ্রাস ও বন্ডেড ওয়্যার হাউস সুবিধা প্রদান করবে সরকার।

রাজধানীর পুরান ঢাকার অলিগলিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে কয়েকশ প্লাস্টিক শিল্প কারখানা। সবগুলো কারখানাকে এক ছাতার নীচে আনতে প্লাস্টিক শিল্প পার্ক গড়ে তুলছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক)।

শিল্প পার্কের জমি ভরাট শেষ হয়েছে, এখন উদ্যোক্তাদের মাঝে প্লট বরাদ্দ দিয়ে কারখানা নির্মাণ শুরু হবে।

বাংলাদেশ প্লাস্টিক গুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিজিএমইএ) সভাপতি শামীম আহমেদ বলেন, "প্লাস্টিক শিল্পকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেই সরকার এই নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। নীতিমালার বাস্তবায়ন করা গেলে, সত্যিই প্লাস্টিক শিল্পের টেকসই উন্নয়ন সাধিত হবে।" 

তিনি বলেন, "নীতিমালা করা হয়েছে, বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে। নীতিমালায় যেসব প্রণোদনার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, তা এই শিল্পের উন্নয়নে সহায়ক হবে।"

বাজার সম্প্রসারণে বড় লক্ষ্যমাত্রা

প্লাস্টিক শিল্প উন্নয়ন নীতিমালাতে প্লাস্টিক শিল্পের বাজার সম্প্রসারণে বড় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

বর্তমানে দেশে ও বিদেশে প্লাস্টিক পণ্যের বাজার প্রায় ২.৯৯ মার্কিন ডলার, যার ৮৩.৪% দেশীয়, আরও অবশিষ্ট ১৬.৬ শতাংশ আন্তর্জাতিক বাজার।

নীতিমালায় প্লাস্টিক শিল্পখাতে ১৫% হারে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্লাস্টিক ও প্যাকেজিং শিল্পের বাজার ২০২৮ সালের মধ্যে বিলিয়ন ডলার ও ২০৩০ সালের মধ্যে ২০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা।

নীতিমালায় বলা হয়েছে, এই খাতে দক্ষ জনশক্তি তৈরীতে ২০২৮ সালের মধ্যে ১০ জনকে চাহিদাভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও ৫ লাখ নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, জিডিপিতে প্লাস্টিক খাতের অবদান নূন্যতম ২% বৃদ্ধি করা ও ২০৩০ সালের মধ্যে প্লাস্টিক ও প্যাকেজিং পণ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে শতভাগ বর্জ্যমুক্ত জাতি (জিরো ওয়েস্ট নেশন) হিসাবে স্বীকৃতির কথা। 

শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, দেশে প্লাস্টিক পণ্যের মাথাপিছু ব্যবহার প্রায় ৫-৭ কেজি, যেখানে বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক পণ্যের গড় মাথাপিছু ব্যবহার প্রায় ৫০ কেজি।

ফলে বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও যথাযথ নীতিগত সহায়তার অভাবে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানির বাজার সুবিধা অর্জনে অনেক পিছিয়ে রয়েছে।

শামীম আহমেদ বলেন, "বিগত কয়েক বছরে এই সেক্টরে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা দেওয়া হলে, বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব। কারণ প্লাস্টিক ব্যবহারে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। কাজেই এই খাতে নতুন নতুন বিনিয়োগও আসছে, বাজার সম্প্রসারণ হচ্ছে।"

বাংলাদেশের প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানির চিত্র

২০২২-২৩ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৪.২১ শতাংশ রপ্তানি কমলেও বিগত অর্থবছরের তুলনায় বেড়েছে ৬.৬৭ শতাংশ।

প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি আগের বছরের তুলনায় ২৬.২৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০.৯৮ কোটি ডলারে। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি হয়েছিল ১৬.৬২ কোটি ডলারের।

শামীম আহমেদ বলেন, "রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, করোনা মহামারীর মধ্যেও প্লাস্টিক শিল্পখাতের পণ্য রপ্তানিতে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। বিশ্ববাজারে প্লাস্টিক পণ্যের চাহিদা থাকায় এই রপ্তানি বাড়ছে। আগামীতে এই খাতে আরও রপ্তানির সুযোগ রয়েছে।"

বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক ব্যবহার ও বাজার

গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চ অনুসারে, ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিকের বাজারমূল্য ৬০৯.০১ বিলিয়ন ডলার; ২০২৫ সালের মধ্যে যা ৭২১.১৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বৈশ্বিক প্লাস্টিক বাজারের মাত্র ০.৬ শতাংশ বাংলাদেশের দখলে রয়েছে। কাজেই বাংলাদেশের প্লাস্টিক বিশ্ববাজারে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করতে পারে।

বর্তমানে মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহারে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। উন্নত এই দেশটিতে মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ ১০৯ কেজি, চীনে ৩৮ কেজি, ভারতে ১১ কেজি ও বাংলাদেশে ৫-৭ কেজি।

প্লাস্টিক উন্নয়ন নীতিমালায় বলা হয়েছে, প্লাস্টিক শিল্পের বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলার জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মপদ্ধতি ও কৌশলগত দিক নির্দেশনার অভাব রয়েছে।

এছাড়াও মান নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত পরীক্ষার সুবিধা, উদ্ভাবনী প্রযুক্তি, প্লাস্টিক বর্জ্যের যথাযথ ব্যবস্থাপনা, ব্যবসাবান্ধব কর ও শুল্ক সুবিধা ইত্যাদির ঘাটতি রয়েছে।  

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.