পরিষেবা ফি বাড়িয়ে কর বহির্ভূত রাজস্ব আয় বাড়াতে চায় সরকার
আগামী অর্থবছরে কর বহির্ভূত রাজস্ব (নন-ট্যাক্স রেভিনিউ) সংগ্রহ বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এতে করে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা নিতে জনসাধারণকে বাড়তি খরচ গুনতে হবে।
তবে খরচ বাড়লেও প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবার মান কতটা উন্নত হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে বিশ্লেষকদের। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় মালিকানার লোকসানি প্রতিষ্ঠান চালু রেখে বাড়তি রাজস্ব সংগ্রহের উদ্যোগের সফলতা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন তারা।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকার এই খাত থেকে ৪৬,০০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নিয়েছে।
চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে সরকার কর-বহির্ভূত রাজস্ব খাত থেকে ৪৫,০০০ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। তবে সংশোধিত বাজেটে সেই লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৪০,০০০ কোটি টাকা করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্যমতে, ইতোমধ্যে বিভিন্ন সংস্থাকে বাড়তি রাজস্ব সংগ্রহের নির্দেশনা দিয়েছে অর্থ বিভাগ। সে অনুযায়ী সংস্থাগুলো তাদের আয় বাড়ানোর উদ্যোগও নিচ্ছে।
ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর আগামী অর্থবছরে চলতি অর্থবছরের তুলনায় দ্বিগুণ আয়ের প্রাক্কলন করেছে। চলতি অর্থবছরে ১,৩৩৫ কোটি টাকা আয়ে লক্ষ্য রয়েছে এই অধিদপ্তরের। আগামী অর্থবছরে তা বাড়িয়ে ২,৬৫৩ কোটি টাকা আয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ইসরাত চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, ই-পাসপোর্ট চালুর পর অনেকেই মেয়াদ থাকা সত্ত্বেও নতুন পাসপোর্ট নিতে চাচ্ছেন। দেশ ও বিদেশ থেকে পাসপোর্টের আবেদন বেড়েছে। তাতে আশা করা হচ্ছে, আগামী অর্থবছরে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের আয় দ্বিগুণ হবে।
এদিকে, চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বাজেট বিষয়ক ত্রিপক্ষীয় সভায় নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন অধিদপ্তর বা পরিদপ্তরের সেবার ফি হালনাগাদ করার নির্দেশনা দিয়েছে অর্থবিভাগ। এর পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে নৌপরিবহণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি, ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউট, নাবিক ও প্রবাসী শ্রমিক কল্যাণ পরিদপ্তরের বিভিন্ন ফি পুনঃনির্ধারণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ বিষয়ে টিবিএসকে জানান, ইতোমধ্যে দপ্তরগুলো নতুন ফি প্রস্তাব করে তা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। এখন সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সভা করে প্রস্তাবিত ফি চূড়ান্ত করে অর্থ বিভাগকে জানানো হবে।
একই কারণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের (আরজেএসসি) ৩৪ ধরনের সেবার ফি বাড়ানো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বৈঠক করে নতুন পরিষেবা ফির খসড়াও তৈরি করেছে।
সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের(আইএমএফ) ৪.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণের শর্তপূরণ করতে গিয়েই কর বহির্ভূত রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আইএমএফ বলছে, কর বহির্ভূত রাজস্ব আয় কম হওয়ায় গত অর্থবছরে দেশের মোট রাজস্ব আয় কমে গেছে।
২০২১-২২ অর্থবছরে সরকার এই খাত থেকে প্রায় ৩৬,০০০ কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছে। তার আগের ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকার এই খাত থেকে রাজস্ব পেয়েছিল ৫৮,৮৬২ কোটি টাকা। যদিও ওই অর্থবছরে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত তারল্যের ১৬,০০০ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হয়।
আগামী অর্থবছরে এ খাত থেকে সরকারের ৪৬,০০০ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্য থাকলেও আইএমএফ বলছে, সরকার এ পরিমাণ সংগ্রহ করতে পারবে না। সংস্থাটি বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়া সংক্রান্ত যে নথিপত্র প্রকাশ করেছে, সেখানে আগামী অর্থবছরে কর বহির্ভূত রাজস্ব থেকে সরকার ৪৪,৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব পেতে পারে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে।
নৌ পরিবহণ অধিদপ্তর সমুদ্রগামী, ফিশিং ও কোস্টাল জাহাজের কর্মকর্তাদের যোগ্যতা সনদ ও সনদ নবায়নসহ ৫৮ ধরনের সেবার বিপরীতে ফি নিয়ে থাকে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই অধিদপ্তর ৩৯ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহ করেছিল।
বিভিন্ন কোর্সের বিপরীতে রাজস্ব সংগ্রহ করে ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউট ও মেরিটাইম একাডেমি। এছাড়া নাবিক ও প্রবাসী কল্যাণ পরিদপ্তর নাবিক, ক্যাডেট ও নৌ কর্মকর্তাদের সাময়িক আবাসন ব্যবস্থা করেও আয় করে থাকে।
এদিকে, শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট(বিএসটিআই) ইতোমধ্যে ৩২ ধরনের পণ্যের রসায়ন পরীক্ষার ফি দ্বিগুণ করেছে। বিএসটিআই ২০২১-২২ অর্থবছরে আয় করেছিল ১৩৯ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে সংস্থাটি ১৪৫ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে।
একই মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কর্পোরেশন যেমন- চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন এবং বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্য ও সেবা দাম বাড়বে বলে জানা গেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রধান আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় আমদানি-রপ্তানি সনদ ও লাইসেন্স ফি বাড়ানোর পাশাপাশি কয়েকটি ক্ষেত্রে নতুন ফি আরোপ করেছে।
এছাড়া রেলপথ মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, ভুমি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে কর বহির্ভূত রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর পরিকল্পনা জমা দিতে বলেছে অর্থ বিভাগ।
'সেবার মান না বাড়িয়ে ফি বাড়িয়ে দেওয়া অযৌক্তিক'
সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের(পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, কর বহির্ভূত রাজস্ব বাড়ানো গেলে সেটি ভালো।
"কিন্তু আমাদের দেশে যেসব খাত থেকে এ ধরনের রাজস্ব আসে, সেখানে আয় বাড়ানোর সম্ভাবনা কম। কারণ সরকারের কমার্শিয়াল ভেঞ্চারগুলোর বেশিরভাগই লোকসানি। আর এই লোকসানের অন্যতম কারণ হলো- অনিয়ম, অদক্ষত ও সুশাসনের অভাব," বলেন তিনি।
এছাড়া, কমার্শিয়াল প্রতিষ্ঠানের বাইরে যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেখান থেকে রাজস্ব বাড়ানোর বিশেষ সুযোগ নেই। আর সেটি করতে গেলেও সাধারণ মানুষের ওপর খরচের বোঝা চাপানো হবে যাবে। সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবার মান বাড়ানোরও উদ্যোগ নিতে হবে। সেবার মান না বাড়িয়ে ফি বাড়ানো যৌক্তিক হবে না বলে উল্লেখ করেন এই বিষেশজ্ঞ।
তিনি বলেন, "তবে সম্প্রতি বেশকিছু ভালো সড়ক, সেতু হয়েছে; সেগুলোতে টোল বাড়ানো যেতে পারে।"
কর বহির্ভূত রাজস্বের প্রধান উৎস
সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক, বীমা, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পার্ক এবং চিড়িয়াখানার থেকে আগত লভ্যাংশ সরকারের কর বহির্ভূত রাজস্বের অন্যতম প্রধান উৎস।
বিভিন্ন আর্থিক ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানকে সরকারের দেওয়া ঋণের সুদ আয়ও কর বহির্ভূত রাজস্ব। সরকারি প্রতিষ্ঠান জনসাধারণকে যে পর্যটন ও ভ্রমণ সেবা দেয়, সেখান থেকে প্রাপ্ত আয়ও কর বহির্ভূত আয়।
কোম্পানি ও আমদানি-রপ্তানি আইনের আওতায় রেজিস্ট্রেশন স্কিম, সমবায় সমিতি রেজিস্ট্রেশন ও নবায়ন স্কিমও কর বহির্ভূত রাজস্ব আয়। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক সেবা ফি, বিভিন্ন সেতুর টোল, ভিসা ফি, পাসপোর্ট ফি, টেলিযোগাযোগ ও ডাক বিভাগের আয়, রেলওয়ে, কৃষি, যোগাযোগ, সেচ, পানি সম্পদ, বন ও পরিবহন খাত থেকে যে আয় হয়, সেগুলোকে কর বহির্ভূত আয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
এছাড়া, সরকারি সম্পত্তি ভাড়া ও ইজারা দেওয়ার মাধ্যমেও সরকার আয় করে। টেলিকমিউনিকেশন, মাইনিং ও এনার্জি ইন্ডাস্ট্রিজের রয়্যালটি ও লাইসেন্স ফিও কর বহির্ভূত রাজস্ব আয়।
এর বাইরে জরিমানা, দণ্ড ও বাজেয়াপ্তকরণের মাধ্যমে সরকার রাজস্ব সংগ্রহ করে থাকে, যা কর বহির্ভূত রাজস্বের আয়ের অন্তর্ভূক্ত।