জামানতের অতিমূল্যায়ন: মামলা নিষ্পত্তি হলেও পুনরুদ্ধার হয়নি বেশিরভাগ ঋণ
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থঋণ আদালতে নিষ্পত্তিকৃত খেলাপি ঋণের মাত্র এক-চতুর্থাংশ পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে দেশের ব্যাংকগুলো।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই প্রতিবেদন বলছে, ডিসেম্বর, ২০২২ পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি গ্রাহকদের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া মামলার সংখ্যা ১,৫০,১৫৯টি। এসব মামলায় গ্রাহদের কাছে ব্যাংকগুলোর দাবির পরিমাণ ৮২,২৯৭ কোটি টাকা। অথচ মামলা নিষ্পতি হলেও গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো আদায় করতে পেরেছে মাত্র ২১,০৮২ কোটি টাকা, যা মোট দাবির মাত্র ২৫.৬ শতাংশ।
এর কারণ হিসেবে বিশ্লেষক ও ব্যাংকাররা জামানতের অতিমূল্যায়ন (ওভার ভ্যালুয়েশন), ঋণ প্রক্রিয়াকরণ কাজ যথাযথ গুরুত্বসহকারে না করা এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়াকে দায়ী করেছেন।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, "অনেক সময় বাস্তবতার কারণে ঋণ নিষ্পত্তি করা হয়ে থাকে। গ্রাহকের মৃত্যু কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ঋণ নিষ্পত্তি করতে হয়। এছাড়া, ব্যাংকগুলোরও ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক অনিয়ম থাকে। তারা ঋণের বিপরীতে যে জামানত নেয়, দেখা যায় তার মূল্য ঋণের তুলনায় খুবই কম।"
"এছাড়া একই জামানত বারবার ভ্যালু অ্যাডিশন করে অতিরিক্ত মূল্য দেখানো হয়। যখন ঋণ খেলাপি হয়ে যায়, তখন আদায় করতে গিয়ে ঋণের আসলও আদায় করা যায়না," যোগ করেন ওই কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, অনাদায়ী অর্থের সবচেয়ে বেশি ৫১,৩০৫ হাজার কোটি টাকা আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলো। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে ২৭,৯০২ কোটি টাকা। ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে অর্থঋণ আদালতে মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ৭২,১৮৯টিতে; আর এসব মামলায় দাবির পরিমাণ ছিল ১,৬৬,৮৮৬ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় মামলা বেড়েছে ৩,৯১৮টি; একইসঙ্গে এসব মামলায় দাবিকৃত টাকার পরিমাণ বেড়েছে ২৩,১৯২ কোটি টাকা।
বর্তমানে অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন মামলার বিপরীতের সবচেয়ে বেশি টাকা আটকে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর, যার পরিমাণ ৭১,৭৬৪ কোটি টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর রয়েছে ২,৪৬৮ কোটি টাকা, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ৮৮,৮৫৮ কোটি টাকা এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর আটকে আছে ৩,৭৯৫ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "অর্থঋণ আদালতে ব্যাপক অঙ্কের টাকার মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, কিন্তু আদায় হয়েছে খুবই কম। এটি ব্যাংকিং ব্যবস্থার দুর্বলতা ইঙ্গিত করে। ব্যাংকগুলো ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ভালো গ্রাহক নির্বাচনের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেয় না। যার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো কিছুদিন পর খেলাপি গ্রাহক হয়ে যায়।"
"এছাড়া গ্রাহককে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে যে জামানত (মটগেজ) রাখা হয়, তার অতিরিক্ত মূল্য ধরা হয়। কিছুদিন পর অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যায় কিংবা মালিক মারা যায়, তখন আর ঋণ আদায়ের সুযোগ থাকে না। সে যেই মটগেজ রেখে যায়, তা বিক্রি করেও দেখা গেছে নাম মাত্র অর্থ আদায় হয় ব্যাংকের," বলেন তিনি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০০৩ সালে অর্থঋণ আদালত গঠন হওয়ার পর ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এ আদালতে মামলা হয়েছে ২,২২,৩৪৮টি। এসব মামলায় জড়িত অর্থের পরিমাণ ছিল ২,৪৯,১৮৪ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ব্যাংকিং খাতের ঋণের ৮.১৬ শতাংশ। যদিও বিভিন্ন আদালতে ঋণের যে টাকা আটকে আছে, তা ব্যাংকগুলো ব্যালেন্স সিটে খেলাপি হিসেবে দেখায় না। ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপন (রাইট আপ) করে সেগুলোকে ব্যালেন্স সিট থেকে বাদ দেয়। তবে এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে শতভাগ প্রভিশন করতে হয়।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, গ্রাহকের ঋণের সুদ বেড়ে যতগুণই হোক, আদালতের কাছে তিনগুণের বেশি দাবি করা যায় না। এছাড়া, অনেক খেলাপি ঋণের মামলার ডকুমেন্টেটেশন ঠিকমতো না হওয়ায় আদালত এসব মামলা নিষ্পত্তি করে দেন।
তিনি বলেন, "ব্যাংকগুলো ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে দেখা যায়, জামানতে বেশি ভ্যালু অ্যাড করে। এরপর আদালতের মাধ্যমে তা নিলামে তুললে দেখা যায়, সেই সম্পত্তির মূল্য অনেক কম। সেক্ষত্রে মূল ঋণের চেয়ে অনেক কম অর্থ পাওয়া যায়।"
এদিকে, খেলাপি ঋণ আদায়ের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক অর্থঋণ আদালত স্থাপনের তাগিদ দিয়ে গত বছর নভেম্বরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে চিঠি দিয়েছে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো।