দাম বাড়লো ইট, সিমেন্ট, রডের

অর্থনীতি

26 February, 2023, 12:05 pm
Last modified: 27 February, 2023, 08:07 pm
নির্মাণ উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় উন্নয়ন কাজের গতি কমে এসেছে বলে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) এবং ঠিকাদারদের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছিল। করোনা মহামারি থেকে শুরু করে পরবর্তীতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সাপ্লাই চেইন ব্যাহত হওয়ায় উপকরণ স্বল্পতা, উপকরণের দামবৃদ্ধির কারণে ঠিকাদাররা কাজ বন্ধ রাখে। নতুন এই রেট শিডিউলের সুবাদে কাজে গতি আসবে বলে তারা মনে করেন।

ইট, বিটুমিন, সিমেন্ট এবং রড সহ নির্মাণ উপকরণগুলোর জন্য বিভিন্ন প্রকল্পে শিডিউল অব রেট পুনঃনির্ধারণ করেছে সরকার। নির্মাণ সামগ্রীর দামবৃদ্ধির সাথে প্রকল্প ব্যয়ের সমন্বয় করার জন্য কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে আসছিলেন ঠিকাদাররা।

প্রথম শ্রেণীর অধিক পোড়া বা ঝামা ইটের দাম ১০ টাকা থেকে ৩ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ টাকায়। আর অটোমেটিক মেশিনে তৈরি এক নাম্বার গ্রেডের ইটের দাম ১১.৫ টাকা থেকে ৪.৫ টাকা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ১৬ টাকায়।

মানভেদে ইটের দাম ৩০% থেকে ৩৯% বাড়িয়ে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের নির্মাণকাজের শিডিউল অব রেট পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনের আওতায় ইট ছাড়াও প্রধান নির্মাণ উপকরণ বিটুমিনের দাম ৪২%, সিমেন্টের দাম ২২% ও রডের দাম ২৮% পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সরকারের সব দপ্তরের দর তফসিলের জন্য নতুন এই দাম কার্যকর হবে। ইতোমধ্যেই অনুমোদন হয়েছে এমন কাজগুলোর মোট ব্যয়ের তথ্য উপকরণগুলোর নতুন দামের ভিত্তিতে পুনঃনির্ধারণ করে তা জমা দেয়ারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে নির্দেশনায়।

পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় চলমান প্রায় ১৫০০ প্রকল্পের ব্যয় ধরা আছে ১,৭৬২ লাখ কোটি টাকার বেশি। চলতি অর্থবছরের এডিপির আকার ২.৪৭ লাখ কোটি টাকা থেকে নামিয়ে আনা হচ্ছে ২.২৮ লাখ কোটি টাকায়। সরকারের উন্নয়ন কাজের ৮০ শতাংশের বেশি নির্মাণধর্মী হওয়ায় এডিপি বাস্তবায়নে ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে প্রতিটি প্রথম শ্রেণীর ঝামা ইটের দাম ধরা হয়েছে ১৩ টাকা। বর্তমানের শিডিউল অব রেটে এই ইটের দাম ধরা আছে ১০ টাকা। এ হিসাবে ঝামা ইটের দাম বাড়ছে প্রতিটি ৩ টাকা বা ৩০ শতাংশ।

রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে ঝামা ইটের দাম ৯.৬ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ১২.৫ টাকায়। আর খুলনা ও বরিশালে ৯.৮ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ১২.৫ টাকায়। এ হিসাবে রাজশাহী ও রংপুরে ঝামা ইটের দাম প্রতিটি ২.৯ টাকা এবং খুলনা ও বরিশালে ২.৭ টাকা করে বাড়ছে।

সারা দেশেই স্বয়ংক্রিয় মেশিনে তৈরি প্রথম শ্রেণীর ইটের দাম ৪.৫ টাকা করে বাড়ানো হয়েছে। ১১.৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে এই ইটের ব্যয় দেখানো হবে ১৬ টাকা। এ হিসাবে শতকরা দাম বৃদ্ধির হার ৩৯ ভাগ।

প্রতি কেজি বিটুমিনের [গ্রেড ৬০/৭০] রিটেইল পর্যায়ে ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগে দাম বাড়ছে ২৩ টাকা। বিদ্যমান রেট শিডিউলে উপকরণটির দাম ৬৯ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৯২ টাকায়। শতকরা হিসেবে দাম বাড়ছে ৩৩ ভাগ। চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে ৩২ শতাংশ এবং দেশের অন্যান্য এলাকায় ৩৪% করে বাড়ছে ৬০/৭০ গ্রেডের বিটুমিনের রিটেইল দাম।

একই গ্রেডের বিটুমিনের বাল্ক দাম ঢাকা ও ময়মনসিংহে ৪১% হারে বাড়ছে। বাল্ক সংগ্রহে প্রতি কেজি ৬৩ টাকা থেকে বেড়ে দাম দাঁড়িয়েছে ৮৯ টাকায়।

চট্টগ্রাম ও সিলেটে ৬০/৭০ গ্রেডের বিটুমিনের পাইকারি দাম ৩৮% হারে বাড়লেও দেশের অন্য চার বিভাগে বাড়ছে ৪২% করে।

একইভাবে খুচরা এবং বাল্ক সংগ্রহে অন্যান্য গ্রেডের বিটুমিনের দামও সারা দেশেই উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো হচ্ছে।

প্রতি বস্তা অর্ডিনারি পোর্টল্যান্ড সিমেন্টের দাম খুচরা পর্যায়ে ৭০ টাকা ও বাল্ক সংগ্রহে ৮০ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ৪৯০ টাকা থেকে ১৪% বাড়িয়ে খুচরা সিমেন্টের দাম ধরা হয়েছে ৫৬০ টাকা। আর ৪৪০ টাকা থেকে বাড়িয়ে বাল্ক সংগ্রহে প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম ধরা হয়েছে ৫২০ টাকা। এ হিসাবে পাইকারি সিমেন্টের দাম বেড়েছে ১৮%।

প্রতি বস্তা পোর্টল্যান্ড কম্পোজিট সিমেন্টের খুচরা দাম ৪৬০ টাকা থেকে ১৪% বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২৫ টাকায়। এ হিসাবে বস্তায় দাম বেড়েছে ৬৫ টাকা। আর বাল্ক সংগ্রহে একই মানের সিমেন্টের দাম ৪১০ টাকা থেকে ২২% বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০০ টাকায়। শতকরা হিসেবে দাম বেড়েছে ২২%।

নির্মাণ উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় উন্নয়ন কাজের গতি কমে এসেছে বলে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) এবং ঠিকাদারদের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছিল। করোনা মহামারি থেকে শুরু করে পরবর্তীতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সাপ্লাই চেইন ব্যাহত হওয়ায় উপকরণ স্বল্পতা, উপকরণের দামবৃদ্ধির কারণে ঠিকাদাররা কাজ বন্ধ রাখে। নতুন এই রেট শিডিউলের সুবাদে কাজে গতি আসবে বলে তারা মনে করেন।

এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্পের পরিচালক ড. মো. ওয়ালিউর রহমান টিবিএসকে বলেন, ঠিকাদার কাজ বন্ধ রাখায় অনেক প্রকল্পেই স্থবিরতা দেখা দিয়েছিল। রেট শিডিউল হালনাগাদ করার কারণে ঠিকাদাররা কিছুটা সুবিধা পাবেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, এবার কিছুটা হলেও কাজে গতি আসবে।

সার্বিক হিসেবে প্রকল্পের ব্যয় কতটা বাড়বে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, প্রতিটি প্রকল্পেই প্রাইস কন্টিনজেন্সি ও ফিজিক্যাল কন্টিনজেন্সি হিসেবে চার শতাংশের মতো অতিরিক্ত বরাদ্দ থাকে। তাছাড়া পরিসংখ্যান ব্যুরোর তৈরি করা মূল্যস্ফীতির তথ্যের আলোকেও ব্যয় বাড়ানোর কিছু সুযোগ থাকে। কন্টিনজেন্সির বাইরে প্রকল্পের ব্যয় খুব একটা বাড়বে না বলেও মনে করেন তিনি।

তবে ব্যয় বৃদ্ধির সুবাদে প্রকল্পের কাজে গতিবৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকলেও সিদ্ধান্তটি সরকারের বাজেটে চাপ বাড়াবে বলে মনে করেন বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ড. শামসুল হক।

তিনি বলেন, প্রকল্পের গতির বিষয় বিবেচনা করলে সিদ্ধান্তটি প্রশংসার দাবিদার। উপকরণের দাম বৃদ্ধির লোকসানের কারণে ঠিকাদাররা অনেক দিন ধরেই কাজ করছিল না।

"তবে এটাও দেখতে হবে, সরকারের রাজস্ব আয় প্রত্যাশা অনুযায়ী হচ্ছে না। বিভিন্ন খাতে সরকারের ব্যয়ও বেড়েছে। এ অবস্থায় উপকরণের দাম বৃদ্ধির কারণে ব্যয়ও বেশ কিছুটা বাড়বে," মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রির (বিএসিআই) সভাপতি শফিকুল হক তালুকদার বলেন, নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেক প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় ঠিকাদারদের ভোগান্তি ও বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করে কাঁচামালের দাম বাড়ানোয় স্বস্তিতে থাকবেন তারা। 

নতুন দর পর্যালোচনা করে তিনি বলেন, প্রতিটি জিনিসের দাম বাজারদরের চেয়ে কিছুটা কম রয়েছে। 

"ভবিষ্যতে দাম বাড়লে ঠিকাদাররা আবারও সমস্যায় পড়বেন," বলেন তিনি। এছাড়াও সময়ে সময়ে মূল্য পর্যালোচনা এবং রেট শিডিউল হালনাগাদের আহবান জানান তিনি।  

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.