তালিকাভুক্ত ছয় কোম্পানি থেকে যেভাবে লভ্যাংশ হারাচ্ছে সরকার 

অর্থনীতি

06 February, 2023, 11:50 am
Last modified: 07 February, 2023, 04:41 pm
উন্নয়ন কাজ ও ব্যবসা সম্প্রসারণে রাষ্ট্র মালিকানায় পরিচালিত কোম্পানিকে বিভিন্ন সময় মূলধন যোগান দিয়েছে সরকার। এই মূলধনের ৬০% ইক্যুইটি ও ৪০% ঋণ দেয় সরকার। ইক্যুইটি মূলধন শেয়ার মানি ডিপোজিট, যা পরবর্তীতে কোম্পানির শেয়ারে কনভার্ট করতে হবে। তবে সরকারের কাছ থেকে মুলধন নিলেও শেয়ারে রূপান্তর না করায় ইক্যুইটির বিপরীতে সরকার ডিভিডেন্ট বঞ্চিত হয়েছে। নতুন শেয়ার ইস্যু করা হলে সরকার বছর শেষে ডিভিডেন্ট পেত। 
ইনফোগ্রাফ- টিবিএস

প্রকল্প অর্থায়নে সরকারের কাছ থেকে প্রতিবছর মূলধন নিয়েছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত কোম্পানিটির নেওয়া মূলধনের পরিমাণ ২৯৮ কোটি টাকা।

ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি) এর নির্দেশমতে, তিতাস গ্যাস কোম্পানিকে শেয়ারমানি ডিপোজিট হিসাবে নেওয়া মূলধনকে নতুন শেয়ারে রূপান্তর করে পেইড-আপ ক্যাপিটালে স্থানান্তর করতে হবে।

কিন্তু কী পদ্ধতি বা কী ধরনের শেয়ার ইস্যু করা হবে, শেয়ার মূল্যও বা কী হবে- সেটা নির্ধারণ না হওয়ায় নতুন শেয়ার ইস্যু করতে পারছে না তিতাস গ্যাস। ফলে এফআরসি- এর নির্দেশনাকে পাশ কাটিয়ে পূর্বের শেয়ার ধরেই শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) গণনা করছে।

আরেক সরকারি কোম্পানি বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবলস ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ব্যবসা সম্প্রসারণে দুই দফায় ১৯০ কোটি টাকা মূলধন সাপোর্ট নিয়েছে।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে নেওয়া ১৪০ কোটি টাকার মূলধনের বিপরীতে প্রতিটি নতুন শেয়ার ১১০.২০ টাকায় ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ২৬ কোটি টাকার বিপরীতে ১২০.১০ টাকায় ইস্যুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

তবে অর্থমন্ত্রণালয় এ বিষয়ে এখনো কোনো চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত না দেওয়ায় নতুন শেয়ার ইস্যু করতে পারছে না কোম্পানিটি।

শুধু এই দুটি কোম্পানিই নয়, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আরও চার কোম্পানি শেয়ার মানি ডিপোজিটের বিপরীতে নতুন শেয়ার ইস্যু করা নিয়ে জটিলতায় পড়েছে।

২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত কোম্পানিগুলো সরকারের কাছ থেকে উন্নয়ন প্রকল্প ও ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা মূলধন নিয়েছে, যা ইতোমধ্যে কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে।

কোম্পানিগুলো হচ্ছে- পাওয়ার গ্রীড কোম্পানী, তিতাস গ্যাস, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, রূপালী ব্যাংক, ডেসকো ও বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবলস কোম্পানি। 

এফআরসি- এর নির্দেশনামতে, এই মূলধনের বিপরীতে কোম্পানিগুলোকে এখন সরকারের অনুকূলে নতুন শেয়ার ইস্যু করে শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হিসাব করতে হবে।

শেয়ার মানি ডিপোজিট নতুন শেয়ার কনভার্সন নিয়ে অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), এফআরসি ও কোম্পানিগুলো বৈঠক করলেও কোনো সুরাহা হচ্ছে না।

বৈঠকে উপস্থিত সূত্রগুলো জানিয়েছে, কোম্পানিগুলোকে দেওয়া মূলধনের বিপরীতে সরকার বাজারমূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ কমে ফেসভ্যালু ১০ টাকায় নতুন শেয়ার চাইছে। বাজার মূল্য বেশি হওয়ায় ওইদামে নতুন শেয়ার ইস্যুর বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে কোম্পানি ও সংশ্লিষ্টরা।

তিতাসের শেয়ার বিভাগের এক কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, "বর্তমানে কোম্পানির ২৫% শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীর মালিকানায় রয়েছে। বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে নতুন শেয়ার ইস্যু করলে সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা ক্ষতিগ্রস্থ হবেন।"

তিনি বলেন, সরকার ফেসভ্যালুতে শেয়ার ইস্যু করতে চাইলেও কোম্পানীর পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়েছে। আবার কোম্পানীতে নতুন শেয়ার যুক্ত হলে ইপিএস কমে যাবে। কারণ ওই মূলধন ইতোমধ্যে বিনিয়োগ করা হয়েছে, ফলে আয় বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।"

শেয়ারের দাম নির্ধারণ ও সুরাহা করতে সব পক্ষের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে। ওই কমিটির মতামত ও সরকারের সিদ্ধান্তের পরই নতুন শেয়ার ইস্যুর বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে জানান তিনি।

২০২০ সালের মার্চে শেয়ার মানি ডিপোজিটের বিপরীতে ছয়মাসের মধ্যে সাধারণ শেয়ার ইস্যুর নির্দেশনা দেয় এফআরসি।

ওই নির্দেশনায় বলা হয়, কোনো কোনো জনস্বার্থ সংস্থা তাদের বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে কোম্পানির শেয়ার ইস্যু করা হবে, এই প্রতিশ্রুতিতে নগদ অর্থ বা সম্পত্তি গ্রহণ করে শেয়ার মানি ডিপোজিট হিসাবভুক্ত করে।

তবে উক্ত অর্থকে শেয়ারহোল্ডারদের ইক্যুইটি হিসাবে প্রদর্শন করে বিভিন্ন কৌশলে অপব্যবহার করে এবং শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) গণনার সময় বিবেচনা না করে উচ্চহারে ইপিএস প্রদর্শন করে। 

ওই নির্দেশনার তিন বছর পার হতে চলেও পরিপালন করতে পারেনি কোম্পানিগুলো। সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে নিয়ে বৈঠক করলেও নতুন শেয়ার ইস্যুর পদ্ধতি বা দাম নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। 

শেয়ার মানি ডিপোজিটের বিপরীতে নতুন শেয়ার ইস্যুর বিষয়টি শিগরিই সমাধান হবে আশা করছেন এফ আরসি'র চেয়ারম্যান ড. মো. হামিদ উল্লাহ ভুঁইয়া।

তিনি টিবিএসকে বলেন, "মূলধনের বিপরীতে নতুন শেয়ার ইস্যুতে এখন দাম নিয়ে নেগোসিয়েশন চলছে। সরকার ফেসভ্যালুতে শেয়ার ইস্যু করতে চাইছে। কিন্তু বাজারে দাম বেশি নতুন শেয়ারের দাম কী হবে, সেটার সুরাহা হয়নি।"

এরপর কী?

উন্নয়ন কাজ ও ব্যবসা সম্প্রসারণে রাষ্ট্র মালিকানায় পরিচালিত কোম্পানিকে বিভিন্ন সময় মূলধন যোগান দিয়েছে সরকার। 

এই মূলধনের ৬০% ইক্যুইটি ও ৪০% ঋণ দেয় সরকার। ইক্যুইটি মূলধন শেয়ার মানি ডিপোজিট, যা পরবর্তীতে কোম্পানির শেয়ারে কনভার্ট করতে হবে।

তবে সরকারের কাছ থেকে মুলধন নিলেও শেয়ারে রূপান্তর না করায় ইক্যুইটির বিপরীতে সরকার ডিভিডেন্ট বঞ্চিত হয়েছে। নতুন শেয়ার ইস্যু করা হলে সরকার বছর শেষে ডিভিডেন্ট পেত। 

এফআরসি'র নির্দেশনা অনুযায়ী, শেয়ার মানি ডিপোজিট নেওয়া ছয় কোম্পানিকে সরকারের অনুকূলে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার নতুন শেয়ার ইস্যু করতে হবে। যা কোম্পানিগুলোর বর্তমান পেইড-আপ ক্যাপিটালের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। 

তালিকাভুক্ত এই ছয় কোম্পানির পেইড-আপ ২৮৪২.৩১ কোটি টাকা। যারমধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯৮৯.২২ কোটি টাকা পেইড-আপ ক্যাপিটাল তিতাস গ্যাসে কোম্পানির। আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭১৭.৭২ কোটি টাকা পেইড-আপ পাওয়ার গ্রীড কোম্পানি।

পাওয়ার গ্রীড কোম্পানির আর্থিক হিসাব অনুযায়ী, সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় প্রকল্পে অর্থায়ন ও বিদ্যুৎ লাইন সম্প্রসারণে ৮০৪৩.২৬ কোটি টাকা মূলধন নিয়েছে। 

এফআরসি'র নির্দেশনা মতে, এই মূলধনকে শেয়ারে কনভার্ট করতে হবে। তবে পেইড-আপ ক্যাপিটালের চেয়ে সরকার থেকে নেওয়া মূলধন অনেক বেশি হওয়ায় নতুন শেয়ার করলে কোম্পানির শেয়ার প্রতি আয় ও লভ্যাংশও বহুলাংশে হ্রাস পাবে। 

ফলে মূলধনের বিপরীতে প্রেফারেন্স শেয়ার ইস্যু করার সিদ্ধান্ত নিলেও সরকার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত পায়নি পাওয়ার গ্রীড। 

কারণ প্রেফারেন্স শেয়ার ইস্যু করলে কোম্পানির সাধারণ শেয়ার বাড়বে না, তবে এই শেয়ারের বিপরীতে রিটার্ন বা ডিভিডেন্ট ফিক্সড থাকবে। ওই ডিভিডেন্ট বাদ দেওয়ার পর কোম্পানির ইপএস গণনা করা হবে। 

মো. হামিদ উল্লাহ ভুঁইয়া বলেন, "প্রেফারেন্স শেয়ার ইস্যু করাটাও পজিটিভ দিক। কারণ পাওয়ার গ্রীড অনেক মূলধন নিয়েছে, নতুন শেয়ার করলে ইপিএস মারাত্মক ফল করবে। এখন সরকার সিদ্ধান্ত দিলেই চুড়ান্ত হবে।"

তিনি বলেন, "কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে আসার আগেই নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত ছিল শেয়ার মানি ডিপোজিটের বিষয়টি সেটেল করে পুঁজিবাজারে আসার নির্দেশনা দেওয়া, কিন্তু তারা তখন তা করেনি। বরং এখন নতুন অর্ডিনারি শেয়ার ইস্যু নিয়ে আপত্তি তুলছে কারণ শেয়ার বাড়লে কোম্পানি ইপিএস কমে যাবে, যার প্রভাব পড়বে শেয়ারহোল্ডারদের উপর।"

রূপালী ব্যাংক মূলধন নিয়েছে ৬৭৯.৯৯ কোটি টাকা, যা আর্থিক হিসাবে শেয়ার মানি ডিপোজিট হিসাবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু নতুন শেয়ার বিষয়ে কোনো অগ্রগতি জানায়নি।

মেঘনা পেট্রোলিয়াম ও ডেসকো মূলধন নিয়েছে যথাক্রমে ১১.৬০ কোটি টাকা ও ৬০৭.৬৯ কোটি টাকা। তারাও নতুন শেয়ার ইস্যুর বিষয়ে অগ্রগতি সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.