রমজানে পণ্য সংকট হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দায়ী করবে উৎকণ্ঠিত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়

অর্থনীতি

19 January, 2023, 11:50 pm
Last modified: 19 January, 2023, 11:58 pm
ডলার সংকট ও আমদানির এলসি খোলাসহ বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে এখনও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায়– আগামী রমজান মাসে দেশের বাজারে পণ্য ঘাটতি দেখা দিলে, তার দায়দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর বর্তাবে বলে সতর্ক করতে যাচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ জানান, রোববার এবিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একটি চিঠি দেওয়া হবে।

ডলার সংকট ও আমদানির এলসি খোলাসহ বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে এখনও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায়– আগামী রমজান মাসে দেশের বাজারে পণ্য ঘাটতি দেখা দিলে, তার দায়দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর বর্তাবে বলে সতর্ক করতে যাচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ জানান, রোববার এবিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একটি চিঠি দেওয়া হবে।

তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, চিঠিতে রোজার মাসে বাড়তি চাহিদা থাকে এমন ভোগ্যপণ্য – ভোজ্যতেল, চিনি, মসুর ডাল, ছোলা ও খেজুর ইত্যাদি আমদানিতে – কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহের অনুরোধ করা হবে।

এর পাশাপাশি খাদ্যপণ্য আমদানির জন্য বিশ্বব্যাংকের সহযোগী সংস্থা- মাল্টিলেটারাল ইনভেস্টমেন্ট গ্যারান্টি এজেন্সি (মিগা) প্রস্তাবিত এক বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ঋণ গ্যারান্টির প্রস্তাব পর্যালোচনা করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ থাকবে বলেও জানান সচিব।

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংককে বার বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলা নির্বিঘ্ন রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়া এবং রমজানের আগে ভোজ্যতেল, চিনি, মসুর ডাল, ছোলা ও খেজুরের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্য আমদানিতে ডলার সংকট অব্যাহত থাকায় হতাশ হয়ে এ চিঠি পাঠাচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

বুধবার ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারকদের সঙ্গে এবং বৃহস্পতিবার বিশ্ব ব্যাংকের রাজনৈতিক ঝুঁকির বিপরীতে নিশ্চয়তা দানকারী সংস্থা- মিগার প্রতিনিধিদের সঙ্গে পৃথক দুটি বৈঠক করেন বাণিজ্য সচিব। বৈঠকগুলোয় আমদানিকারকদের এলসি খোলার সমস্যা এখনও সমাধান না হওয়া ও মিগার ঋণ প্রস্তাবের সভরেন গ্যারান্টার হতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনীহার বিষয়টি উঠে আসার পর এ চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়।

তপন কান্তি ঘোষ টিবিএসকে জানান, 'আমদানিকারকদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সভার রেজুলেশন বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে'।

নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের এলসি খোলা স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহ করতে গত নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু, জরুরি ভোগ্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ডলার সরবরাহ না বাড়িয়ে ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে – এলসি মার্জিন ন্যূনতম পর্যায়ে নেওয়ার সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা কোনো কাজে আসছে না বলে মনে করছেন আমদানিকারক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

এ অবস্থায় গত ৪ জানুয়ারি ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স থেকে নির্ধারিত পরিমাণ ডলার কোটা হিসেবে সংরক্ষণ রাখার অনুরোধ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে চিঠি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এই চিঠি দেওয়ার পর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ ব্যক্তিগতভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এবিষয়ে কথা বলেছেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে বাণিজ্য সচিব জানান, তারা বলেছেন, সরকারের নীতি হলো- সার ও জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো প্রয়োজনীয় ডলার সংস্থান করতে না পারলে, বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার সহায়তা দেবে। অন্যদিকে, ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় ডলার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকেই সংস্থান করতে হবে।

তপন কান্তি ঘোষ টিবিএসকে আরও বলেন, ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে পর্যাপ্ত ডলার পাওয়া না গেলে- যাতে রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ করা হয়, চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে সে অনুরোধ করা হবে।   

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, এ্যালোকেশন অব বিজনেস অনুযায়ী, ভোজ্যতেল, চিনি, মসুর ডাল, খেজুর, ছোলাসহ বিভিন্ন পণ্যের স্বাভাবিক সরবরাহ নিশ্চিত করা ও বাজার দর স্থিতিশীল রাখা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।

কিন্তু, ডলার সংকটের কারণে চিনিসহ বিভিন্ন পণ্যের এলসি খোলা, এলসি নিষ্পত্তি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বেশ কমে গেছে। তাই এখনই এলসি খোলা সম্ভব নাহলে- রমজানে পণ্যের ঘাটতি দেখা দিতে পারে বলে মনে করছে মন্ত্রণালয়।  

মন্ত্রণালয়ের আরেক কর্মকর্তা জানান, চলমান ডলার সংকটের সময়ে সার ও জ্বালানি তেলের মতো জরুরি পণ্যের পাশাপাশি এখনও অনেক বিলাসবহুল পণ্য আমদানি অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু, রমজান উপলক্ষ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য আমদানির এলসি খোলার জন্য ডলার সরবরাহ করা নাহলে- তা অত্যন্ত দুঃখজনক হবে'- এমন বক্তব্য চিঠিতে উল্লেখ করবে মন্ত্রণালয়।

'এখন দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব পণ্যের এলসি খোলা সম্ভব নাহলে– রমজানে বাজারে পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিতে পারে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে (যা ২০২৩ সালের শেষে বা ২০২৪ এর শুরুতে হতে পারে) এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে- বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বড় ধরনের চাপে পড়বে। কিন্তু, ডলার সংকটের কারণে ভোগ্যপণ্য আমদানি ব্যাহত হলে– সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ করা ছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হাতে আরও কোন উপায় নেই'- বলে জানান ওই কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক টিবিএসকে জানান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠির প্রেক্ষিতে গত নভেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তো প্রতিদিন নির্দেশনা দেবে না। তবে কোন কোম্পানি- কি পরিমাণ এলসি খুলছে, তা মনিটর করা হচ্ছে। সে তথ্য সাংবাদিকদের জানানো হবে।

তিনি আরও দাবি করেন, গত বছরের তুলনায় এবছর খেজুর আমদানি দেড়গুণ হয়েছে। 'যে পণ্যে বেশি লাভ দেখছে, ব্যবসায়ীরা সে পণ্য আমদানি করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ধারণা কেন সৃষ্টি হচ্ছে, তা বোধগম্য নয়'।  

৬ শতাংশ সুদ চায় মিগা

গম, ভোজ্যতেল, চিনিসহ নিত্যপণ্য আমদানিতে ডলার সংকট মোকাবেলায় বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় এক বছর মেয়াদে ৫০০ মিলিয়ন ডলার থেকে ১ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ঋণের যোগান দেওয়ার বিষয়ে মিগার প্রস্তাব নিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে বিশ্বব্যাংকের সংস্থাটির তিন সদস্যের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেন বাণিজ্য সচিব। সেখানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ছাড়াও দেশের একটি শীর্ষ আমদানিকারক- টিকে গ্রুপের এক কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।

সভায় উপস্থিত ছিলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এমন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে টিবিএসকে বলেন, ব্যবসায়ীরা মিগার প্রস্তাবিত এই ঋণ সুবিধা নিতে চান। কিন্তু, বাংলাদেশ ব্যাংক মৌখিকভাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে যে, তারা গ্যারান্টার হতে আগ্রহী নয়। সেক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যাংক বা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্যারান্টিতে এই ঋণ সুবিধা নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

তবে মিগার প্রতিনিধিদল জানিয়েছে, তারা বেসরকারি খাতের গ্যারান্টিতে পাওয়া বিদেশি ঋণের গ্যারান্টার হয় না। শুধুমাত্র বাংলাদেশ ব্যাংক গ্যারান্টার হলেই প্রস্তাবিত ঋণ সুবিধা পাওয়া যাবে বলে মিগা প্রতিনিধিদের বরাত দিয়ে জানান ওই কর্মকর্তা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, মিগা এইচএসবিসি, স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড, সিটি ব্যাংক থেকে বাংলাদেশের জন্য ঋণের গ্যারান্টার হবে। গ্যারান্টার হিসেবে মিগা ২% সার্ভিস চার্জ এবং ঋণদাতা ব্যাংকগুলোর জন্য ৪% সুদ প্রস্তাব করেছে। অর্থাৎ, এই ঋণের রিপেমেন্ট রেট হবে ৬%, যা অনেক বেশি বলে মনে করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক গ্যারান্টার হতে রাজি হচ্ছে না, তা ঠিক নয়। যেহেতু মিগা বিদেশি কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে ঋণ এনে দেবে, তাই এই ঋণের সুদহার অনেক বেশি।

'তাছাড়া, এখন বাংলাদেশে এক ডলারের বিনিময় দর ১০৫ টাকা, এক বছর পর এই দর কতো হবে, মিগার গ্যারান্টিতে পাওয়া ঋণের মডালিটি কি হবে, ঋণের অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের তহবিলে যুক্ত হবে, নাকি বেসরকারি ব্যাংকে যাবে – এসব নিয়ে আরও আলোচনা করতে হবে' জানান সচিব।   

বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও পৃথক সভা করেছে মিগার প্রতিনিধিদল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মেজবাউল হক বলেন, এই মুহূর্তে বিষয়টি নিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। মিগার ঋণ গ্যারান্টি প্রস্তাবের শর্তগুলো পর্যালোচনা করে পরবর্তীতে সরকার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।

দেশের শীর্ষস্থানীয় ভোক্তাপণ্য প্রস্তুতকারক ও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান– সিটি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের মূল সমস্যা হলো ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলা সম্ভব হলেও বিদেশি ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে এলসি কনফার্মেশন পাওয়া যাচ্ছে না। মিগা'র গ্যারান্টিতে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ পাওয়া গেলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব'।  

 

 

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.