কক্সবাজারের এক সমবায় সমিতি যেভাবে ৯০ বছর ধরে হাজারো মানুষের হাল ধরেছে
কক্সবাজারের বদরখালীর টুটিয়াখালী পাড়ার বাসিন্দা আব্দুল জব্বার। বয়স এখন ১০০ ছুঁই ছুঁই। তিনি এই এলাকায় বড় হলেও তার আদি নিবাস বাঁশখালীর পুঁইছড়িতে। গত শতাব্দীর শুরুতে সামন্তবাদী জমিদারদের হাতে নিজেদের প্রায় ২০ একর জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে তার পরিবার আশ্রয় নেন বদরখালীর ম্যানগ্রোভ বনে।
পরিবারের সেই সংগ্রামের দিনগুলোর কথা এখনও মনে আছে প্রায় শতবর্ষী আব্দুল জব্বারের। পরে অবশ্য তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের এক উদ্যোগে জব্বারের পরিবারসহ আশেপাশের আরও অনেক ভূমিহীন পরিবার আশার আলো দেখেছিল। ১৯২৯ সালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা বাস্তুহারা ২৬২টি পরিবারকে বদরখালী, চকরিয়ার উপকূলীয় এলাকার ৩ হাজার ৭৭৭ একর ম্যানগ্রোভ ভূমি বরাদ্দ দেয় ব্রিটিশ সরকার।
পরের বছর এই আশ্রয়হীন মানুষদের আবাসন, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষ সেখানে প্রতিষ্ঠা করে 'বদরখালী সমবায় কৃষি উপনিবেশ সমিতি'।
সরকারি নথিপত্র অনুযায়ী, ১৯২৭ সালে অবিভক্ত বাংলার সমবায় বিভাগের তৎকালীন রেজিস্ট্রার ওই অঞ্চল পরিদর্শন করেন এবং সেখানকার ভূমিহীন মানুষদের নিয়ে সমবায় সমিতি গঠনের প্রস্তাব করেন। বদরখালীর ভূমি বণ্টন এবং সেখানে সমবায় সমিতির গঠনের উদ্যোগটি নেওয়া হয়েছিল তৎকালীন রেজিস্ট্রারের প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করেই।
বর্তমানে আব্দুল জব্বারের যৌথ পরিবার এখানেই বাস করে, বিগত ৯০ বছর ধরে সমবায় সমিতির সদস্য হয়ে নিজের জমি চাষাবাদ করেন তারা। তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাও নিশ্চিত হয়েছে এর মাধ্যমেই।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত নয় দশকে এই সমিতি একটি সম্প্রদায়ে রূপ নিয়েছে, বদরখালী ইউনিয়নের বাসিন্দাদের সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হচ্ছে এর মাধ্যমেই। স্থাবর সম্পত্তির মালিকানার বিবেচনায় এটি দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর সমবায় সমিতি বলে দাবি তাদের।
বদরখালী সমবায় কৃষি উপনিবেশ সমিতির সভাপতি দেলোয়ার হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমাদের এখন প্রায় ১,৫০০ সদস্য আছে, তাদের প্রত্যেকের ১১.৬০ একর জমি রয়েছে। বদরখালী ইউনিয়নের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ সমিতির মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছেন।"
সমিতির সদস্য মোস্তফা গালিব বলেন, "সমিতির মূল উদ্দেশ্য ছিল গৃহহীন মানুষদের আশ্রয় নিশ্চিত করা। সামাজিক সম্প্রীতি রক্ষায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মানুষের জন্য আলাদা পাড়া তৈরি করা হয়েছে।"
নিজেরা জমি চাষ করবে এ শর্তে এখানে মানুষকে জমি দেওয়া হয়েছে। এখানকার প্রধান কৃষি পণ্য ধান, লবণ, মাছ ও চিংড়ি। স্থানীয়রা জানান, এখানে উৎপাদিত লবণ ও চিংড়ি চাহিদা মিটিয়ে এখন বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপ-পরিচালক মোঃ কবির হোসেন বলেন, "বদরখালী ইউনিয়নে কোনো ভূমিহীন কৃষক নেই। সকলেরই সমান আবাসন, কৃষি ও বাণিজ্যিক জমি রয়েছে। এমনকি সমিতির বরাদ্দ হয়নি এমন জমি থেকে উপার্জিত অর্থও সদস্যদের মধ্যে সমানভাবে বিতরণ করা হয়।"
সংকটকালে ইউনিয়নের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সমিতির রয়েছে ৫ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল। সমিতির সদস্যরা বলছেন, ধর্মগোলা নামে একটি পুরানো ঐতিহ্য থেকে এ চল শুরু করেন তারা, প্রথমদিকের বছরগুলোতে সবাই যৌথ খাদ্য ব্যাংকের জন্য খাদ্যশস্য দিত।
সমিতির সিনিয়র সদস্য গোলাম শরীফ বলেন, "১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় ধর্মগোলা এ অঞ্চলের মানুষের মাঝে খাবার বিতরণ করেছিল। তখন এই এলাকায় কেউ অনাহারে মারা যায়নি কারণ আমরা প্রায় ১২০০ মণ চাল মজুদ করে রেখেছিলাম।"
১৯৩০ সালে মুসলিম শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য সমিতি কয়েকটি মক্তব, ধর্মীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তী সময়ে ১৯৩৫সালে বদরখালী বহুমুখী (সরকারি) প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১৯৪৫ সালে বদরখালী কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়, ১৯৫৪ সালে বদরখালী ফাজিল মাদ্রাসা এবং ১৯৯৩ সালে বদরখালী ডিগ্রি কলেজ স্থাপিত হয়।
বর্তমানে ১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তিনটি উচ্চ বিদ্যালয়, দুটি কলেজ এবং বেশ কয়েকটি মাদ্রাসাসহ এই এলাকায় অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
সমিতির সাবেক সভাপতি রশিদ আহমেদ বলেন, সমিতির অর্থায়নে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে।
"সরকার কর্তৃক এ ধরনের শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার আগে সমিতি এ অঞ্চলের শিশুদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করেছিল। এলাকায় স্থাপিত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পুরো খরচ বহন করত সমিতি। এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৮০%"
বদরখালীর বাসিন্দাদের জন্য সুদবিহীন শিক্ষা ঋণও দেয় সমিতি।
বদরখালীর বাসিন্দা আবদুর রশিদ বলেন, "১৯৭৭ সালে হাইস্কুলে পড়ার সময় ২০০০ টাকা এবং ১৯৮০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় ৫০০০টাকা ঋণ নিয়েছিলাম আমি। পরে শিক্ষকতার চাকরি পাওয়ার পর কোনো সুদ ছাড়াই ঋণ পরিশোধ করেছিলাম"।
যে সব পরিবার তাদের সন্তানদের জন্য গৃহশিক্ষক নিয়োগ করেছিল তাদের জন্য জমি বরাদ্দ দিত সমিতি এমনও সময় ছিল।
বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য বদরখালীতে একটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে। তবে প্রথমদিকে সমিতির অফিসে প্যারামেডিক ডাক্তারের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হতো।
বর্তমানে এ এলাকায় ৪৫টি মসজিদ, একটি মন্দির, ১৪টি মক্তব, ২০টি কবরস্থান এবং একটি শ্মশান আছে, সমিতির নিজস্ব খরচে এসব পরিচালিত হয়।
সমিতির সেক্রেটারি মঈন উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সমিতিটি এই ইউনিয়নের একটি মিনি সেক্রেটারিয়েটে পরিণত হয়েছে। এটি এখানকার অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত, সামাজিক ও ধর্মীয় সকল অবকাঠামো নিয়ে কাজ করার কেন্দ্র। এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সমিতির বর্তমান বার্ষিক ব্যয় হয় প্রায় ৮ কোটি টাকা থেকে ১০ কোটি টাকা।
কক্সবাজার জেলা সমবায় কর্মকর্তা মোঃ জহির আব্বাস বলেন, "এ সমবায় সমিতি দেশের সমবায়ের জন্য একটি অনন্য মডেল। ৯০ বছর ধরে ইউনিয়নের মানুষের সব মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে আসছে এটি।"