চট্টগ্রাম-কলকাতা কোস্টাল রুটে আগ্রহ হারাচ্ছেন জাহাজ মালিকরা

অর্থনীতি

26 October, 2022, 04:50 pm
Last modified: 26 October, 2022, 04:54 pm
শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাহাজ চলাচলে স্বল্প সময়ের অনুমতি, জাহাজের সেইফটি সিকিউরিটি নিশ্চিতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের আরোপ করা কড়াকড়িসহ বিভিন্ন কারণে এই রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

২০১৭ সালে চারটি জাহাজ নিয়ে চট্টগ্রাম-কলকাতা রুটে পণ্য পরিবহন শুরু করে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান মেরিন ট্রাস্ট লিমিটেড। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি এখন এই রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে।

শুধু মেরিন ট্রাস্ট কোম্পনিই নয়, এই রুটে প্রথম জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান নীপা পরিবহন লিমিটেডসহ আরও কয়েকটি শিপিং কোম্পানি চট্টগ্রাম- কলকাতা রুটে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে এই রুটে পণ্য পরিবহনে নেমে এসেছে স্থবিরতা। 

শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাহাজ চলাচলে স্বল্প সময়ের অনুমতি, জাহাজের সেইফটি সিকিউরিটি নিশ্চিতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের আরোপ করা কড়াকড়িসহ বিভিন্ন কারণে এই রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

এছাড়া জ্বালানি তেলের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি, খরচের তুলনায় ফ্রেইট চার্জ না বাড়াও প্রতিষ্ঠানগুলোর এ রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার অন্যতম কারণ।

চট্টগ্রাম থেকে কলকাতা বন্দরে ৩৬ ঘন্টায় পণ্য পৌঁছানো গেলেও জাহাজ সংকটের কারণে এই রুটের পণ্য পরিবহনের জন্য ব্যবসায়ীদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে ১ মাসেরও বেশি সময়। 

সড়কপথ এড়িয়ে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহেনের জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২০১৫ সালে কোস্টাল শিপিং চুক্তি হয়। চুক্তির পর চট্টগ্রাম বন্দর-কলকাতা শ্যামা প্রসাদ মুর্খাজী বন্দর রুটে সরাসরি কনটেইনারবাহী জাহাজ চলাচল শুরু হয়।

কিন্তু ক্রমাগত জাহাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন এই চুক্তির সুফল পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগের পরও বাধ্য হয়ে এখন এই রুট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন জাহাজ মালিকরা। 

শুরুতে এই রুটে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ১০টির বেশি জাহাজ চলাচল করলেও এখন চালু আছে মাত্র দুটি জাহাজ। 

ব্যবসায়ীরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে ২০২২ সালের পর জাহাজ চালু রাখা সম্ভব হবে না।

তাই তারা বাংলাদেশ সরকারের কাছে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান এবং এই রুটে জাহাজের সংখ্যা বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন।

মেরিন ট্রাস্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহিকুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'নানা প্রতিকূলতায় পড়তে হয় আমাদের। জাহাজ চলাচলের অনুমতি পেতে ভোগান্তি পোহাতে হয়। ভারতীয় শিপিং কর্তৃপক্ষের নানা শর্তের কারণে আমরা এই রুটে জাহাজ পরিচালনা করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলি।' 

তাদের প্রতিষ্ঠান এখন জাহাজ চারটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বন্দরে পরিচালনা করছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'দেশের বন্দরে চলাচলের উপযোগী ৪টি জাহাজ কিনতে আমাদের ৮০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করলেও হতো।'

একটি তিক্ত অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম-কলকাতা রুটে মেরিন ট্রাস্ট ১ নামে একটি জাহাজ চলাচল করত। গত মার্চে সেটি কলকাতা বন্দরে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। জাহাজটি উদ্ধারে তাদের ১২ কোটি টাকা ব্যয় হয়। 

'এখন কলকাতা বন্দর ৩৪ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করছে। ক্ষতিপূরণ দিয়ে জাহাজটি বাংলাদেশে এনে চলাচল উপযোগী করতে প্রায় ৬০ কোটি টাকা লাগবে। জাহাজটির বর্তমান মূল্য ৬০ কোটি টাকা হবে না। এছাড়া দুর্ঘটনার পর কলকাতা বন্দরে ১৫ নাবিক আটকা পড়েন। এখনও ৬ জন নবিককে মুক্তি দেওয়া হয়নি। হতাশ হয়ে আমরা চট্টগ্রাম-কলকাতা রুটে জাহাজ পরিচালনা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছি,' বলেন তিনি।

কোস্টাল চুক্তির পরই চট্টগ্রাম-কলকাতা রুটে প্রথম হার্বার ১ জাহাজ পরিচালনা শুরু করে নীপা পরিবহন লিমিটেড। জাহাজটি ৩০টি যাত্রা পরিচালনা করেছিল এই রুটে। পরবর্তীতে এমভি স্যামুয়েল নামে আরও একটি জাহাজ যুক্ত করেছিল নীপা পরিবহন। জাহাজটি ৫টি ট্রিপ দেওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটি তাদের দুটি জাহাজই বন্ধ করে দেয়। 

নিপা পরিবহন লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী এবং বাংলাদেশ কনটেইনার শিপ ওনারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নাছির আহমেদ চৌধুরী রিপন টিবিএসকে বলেন, 'ভারতীয় ডিজি শিপিং এই রুটে জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে শুরুতে এক বছরের জন্য অনুমতি দিত। কিন্তু এখন সেটি নেমে এসেছে এক মাস বা তারও কমে। এতে আমরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। এছাড়া জাহাজের সেইফটি সিকিউরিটি নিশ্চিত করতে যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে সেগুলো কোস্টাল রুটে চলাচলকারী জাহাজগুলোতে মেইনটেইন করা কঠিন।'

উদাহারণ টেনে নাছির আহমেদ চৌধুরী রিপন আরো বলেন, 'শুরুতে এই রুটে নাবিকদের বেতন বাবদ আমাদের প্রতি মাসে ব্যয় হতো প্রায় ৪ লাখ টাকা। শর্ত অনুযায়ী, জাহাজে নাবিক ও অফিসারদের গ্রেড ও সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এই ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ টাকার বেশি। বাড়তি এ ব্যয় সমন্বয় করতে পারছে না জাহাজ মালিকরা।'

জাহাজগুলো কলকাতা থেকে রাসায়নিক, লোহার সামগ্রী, বিলেট ও সুতা বহন করে। অপরদিকে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালি কনটেইনার এবং কৃষি-প্রক্রিয়াজাত খাদ্য আইটেম পরিবহন করছে। 

শিপিং এজেন্ট ম্যাংগো লাইনের তথ্যমতে, ২০১৫ সাল থেকে এই রুটে চলাচল করে হার্বার ১, মেরিন ট্রাস্ট ১, মেরিন ট্রাস্ট ৩, ট্রান্স সামুদেরা, নু কোল্লান ১, নু কোল্লান ২, সেজ্যোতি, ইনভিক্টা ১-সহ ১০টির বেশি জাহাজ। 

পণ্য পরিবহনের জন্য চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করতে জন্য ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির আওতায় এই রুটে কার্গো জাহাজের পরীক্ষামূলক চলাচল প্রায় শেষের দিকে।

সমুদ্রগামী জাহাজের মাধ্যমে কলকাতায় পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর, যেমন শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দর হয়ে যেতে হয়। সময় লাগে প্রায় ২ সপ্তাহ। খরচ হয় কনটেইনারপ্রতি প্রায় ৬০০ মার্কিন ডলার। 

অন্যদিকে কোস্টাল চুক্তির আওতায় চলাচলকারী জাহাজগুলোতে কলকাতায় পণ্য পৌঁছাতে সময় লাগে দেড় দিন। ব্যয় হয় ২০০ ডলারের কম। 

কোস্টাল শিপিং চুক্তি অনুসারে কলকাতাসহ সাতটি বন্দরে এবং বাংলাদেশের সবগুলো সমুদ্রবন্দর ও তিনটি নৌবন্দরে পণ্য পরিবহন করা যাবে। 

এমভি ট্রান্স সামুদেরা জাহাজের শিপিং এজেন্ট ম্যাংগো লাইনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এয়াকুব ভুঁইয়া সুজন বলেন, চট্টগ্রাম থেকে কলকাতায় ১২০ থেকে ২০০ টিইইউএস (বিশ ফুট সমতুল্য) কনটেইনার পরিবহন ধারণক্ষমতার জাহাজ চলাচল করে। খালি কনটেইনার ভাড়া ৫০ থেকে ৮০ ডলার। পণ্যভর্তি কনটেইনার ১৫০ থেকে ১৬০ ডলার। গত ৫ বছর ধরে ফ্রেইট চার্জ অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। অথচ জ্বালানি খরচ বেড়ে গেছে প্রায় ৫০ শতাংশ।

বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি খায়রুল আলম সুজন বলেন, চট্টগ্রাম-কলকাতা সার্ভিস জাহাজ চলাচল চালু রাখতে ব্যবসাবান্ধব স্থায়ী নীতি চালু করা উচিত, যাতে দুই দেশের ব্যবসায়ীরা উপকৃত হয়।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফরুকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন্, 'এটি দুই দেশের পলিসির বিষয়। তাই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দিক থেকে এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।'

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.