নারিকেল তেল: প্লাস্টিকের বোতলের কাছে যেভাবে হেরে গেলো স্থানীয় টিনের কৌটার ব্র্যান্ড        

অর্থনীতি

20 October, 2022, 03:30 pm
Last modified: 22 October, 2022, 04:19 pm
বর্তমানে ব্র্যান্ড এবং নন-ব্র্যান্ড মিলিয়ে নারিকেল তেলের বাজারের আকার প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। আর ব্র্যান্ডেড অয়েল মার্কেটের ৮০ শতাংশই ম্যারিকোর দখলে রয়েছে।

খোলা বাজারের আধিপত্য ভেঙে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের হাত ধরে বাংলাদেশের বাজারে টিনের কৌটায় নারিকেল তেলের 'ব্র্যান্ড ইমেজ' তৈরি হয়। দীর্ঘ ৬৫ বছর টিনের কৌটায় স্থানীয় উদ্যোক্তারা ভালো ব্যবসা করলেও প্লাস্টিকের বোতলে নারিকেল তেল বাজারজাতের চমক দেখিয়ে এখন বাজারের দখলে রয়েছে বিদেশি কোম্পানি।

স্থানীয় বাজারের নারিকেল তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য বলছে, ১৯৩৫ সালের দিকে মোড়কজাত ব্র্যান্ডেড নারিকেল তেলের যাত্রা শুরু হয়েছিল 'হেনা কেমিক্যালস'–এর একটি ব্র্যান্ডের হাত ধরে। এরপর দীর্ঘ ৬৫ বছর অর্থাৎ ২০০৫ সাল পর্যন্ত এই মার্কেটে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আধিপত্য ছিল।

তবে ২০০০ সালের পর বিদেশি একটি কোম্পানি এই বাজারে প্লাস্টিকের বোতলে নারিকেল তেল বাজারজাতকরণ শুরুর পর থেকেই পাল্টাতে থাকে দৃশ্যপট। বর্তমানে বিদেশি এই কোম্পানিটি নারিকেল তেলের বাজারের ৮০ শতাংশ দখল নিয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৩৫ সালের কিছু পরে হেনা কেমিক্যালস এর দেখানো পথ ধরে 'হাঁসমার্কা' ব্র্যান্ড নিয়ে নারিকেল তেলের বাজারজাত শুরু করে লালবাগ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি ওয়ার্কস লিমিটেড। ১৯৭২ সালের দিকে মৌসুমী ইন্ডাস্ট্রিজ 'কিউট' নামের ব্র্যান্ডে নারিকেল তেলের ব্যবসায় আসে। নারিকেল তেলের ব্যাপক চাহিদা থাকায় ১৯৮৮ সালের দিকে 'জুঁই' ব্র্যান্ড নামে নারিকেল তেল বাজারে আনে স্কয়ার গ্রুপ। এছাড়াও রিগার্ড কেমিক্যাল সহ আরও বেশ কিছু কোম্পানি ও শিল্পগ্রুপ ১৯৯৫-২০০২ পর্যন্ত নারিকেল তেল ব্যবসায় নিজস্ব ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠায় বিনিয়োগ করেছিল। 

এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ডেল্টা গ্রুপের লিলি নারিকেল তেল, কেয়া গ্রুপের নারিকেল তেল, যমুনা গ্রুপের অ্যারোমেটিক নারিকেল তেল এবং মিল্লাত গ্রুপের মিল্লাত নারিকেল তেল। সে সময় এই কোম্পানিগুলো ব্যাপকভাবে প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে বাজারের বড় একটা অংশ দখলে নিয়েছিল যার নেতৃত্বে ছিল লালবাগ কেমিক্যাল। তখন সবগুলো কোম্পানিই তেল বোতলজাত করার জন্য টিনের কৌটা ব্যবহার করেছিল।

টিনের কৌটা থেকে প্লাস্টিক বোতল

টিনের কৌটা সরিয়ে প্লাস্টিকের বোতলে নারিকেল তেল নিয়ে ২০০২ সালে দেশের বাজারে প্রবেশ করে ভারতীয় কোম্পানি ম্যারিকো লিমিটেড। ম্যারিকো বাংলাদেশ নামে নিবন্ধন নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি 'প্যারাস্যুট' ব্র্যান্ডের অধীনে নারিকেল বাজারজাত শুরু করে।

টিনের কৌটায় নারিকেল তেল দেখে অভ্যস্ত মানুষ তখন আকর্ষণীয় প্লাস্টিকের বোতল এবং ব্র্যান্ড নামে নতুনের গন্ধ পায়। কোম্পানিটিও সাধারণ মানুষের আবেগের জায়গা এবং ক্রয়ক্ষমতা হিসেব-নিকেশ করে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে অল্পদিনেই নিজের জায়গা তৈরি করে নেয়। ফলস্বরূপ ক্রেতারা একই দাম হওয়ায় টিনের কৌটা ছেড়ে প্লাস্টিকের বোতলকে প্রাধান্য দেয়। 

সে সময়ই ম্যারিকো-র উত্থানের সাথে শুরু হয় স্থানীয় কোম্পানিগুলোর পতন।

বর্তমানে কেবলমাত্র লালবাগ ক্যামিকেলের হাঁসমার্কা নারিকেল তেল, মৌসুমির কিউট এবং স্কয়ারের জুঁই টিকে থাকলেও অন্যরা ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে।

স্থানীয় নারিকেল তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ম্যারিকোর দেখানো পথ ধরে দেশীয় কোম্পানিগুলোও প্লাস্টিকের বোতলে নারিকেল তেল বাজারজাত করে। কিন্তু কিছুদিন পর দেখা যায় এই বোতলে তেল নির্দিষ্ট মেয়াদের আগেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে বাজার থেকে তেল উঠিয়ে নিতে হয়েছিল কোম্পানিগুলোকে। কিন্তু ম্যারিকোর তেল নষ্ট হচ্ছে না। তখন কোম্পানিগুলো বুঝতে পারে ম্যারিকোর ব্যবহার করা প্লাস্টিকের বোতল বিশেষভাবে তৈরি। আর এই প্রযুক্তি আয়ত্বে আনতে দেশি কোম্পানিগুলোর চার থেকে পাঁচ বছর লেগে যায়। এর মধ্যেই ম্যারিকো ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী ভ্যালু এডেড নারিকেল তেল দিয়ে দেশের বাজার দখল করে নেয়।

ম্যারিকোর আর্থিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০০৬ সালে কোম্পানিটির বিক্রি ছিল ৮০ কোটি টাকা। সেটা ২০২১-২২ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৮০০ কোটি টাকায়। দেখা যাচ্ছে শুধু নারিকেল তেল বিক্রিতে কোম্পানিটির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯০০ শতাংশ। 

বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম এবং নিলসেন কর্তৃক জানা যায়, দেশের শীর্ষ ১০ ব্র্যান্ডের মধ্যে প্যারাস্যুটও আছে আর মানুষ সবচাইতে বেশি পছন্দ করে হলো 'প্যারাসুট অ্যাডভান্সড।' ২০২১-২২ অর্থবছরে কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্যের উল্লেখ করেন ম্যারিকো বাংলাদেশের চেয়ারম্যান স্বগত গুপ্তা।

কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশীষ গোপাল বার্ষিক প্রতিবেদনে আরও যোগ করেন, বাংলাদেশি গ্রাহকদের জন্য বিশ্বমানের পণ্য তৈরি, নিজস্ব ব্র্যান্ড নির্মাণ এবং একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক-ই তাদের ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির মূল কৌশলগত স্তম্ভ।

বর্তমানে ব্র্যান্ড এবং নন-ব্র্যান্ড মিলিয়ে নারিকেল তেলের বাজারের আকার প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। আর ব্র্যান্ডেড অয়েল মার্কেটের ৮০ শতাংশই ম্যারিকোর দখলে রয়েছে।

যে কারণে পিছিয়ে স্থানীয় প্রতিষ্ঠান

প্রায় দুই যুগ ধরে নারিকেল তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা এক কর্মকর্তা বলেন, মূলত তিন কারণে দেশীয় কোম্পানিগুলো ম্যারিকোর সাথে পেরে উঠেনি। সেগুলো হলো- সঠিক সময়, সঠিক স্থান এবং সঠিক সিদ্ধান্ত। 

তিনি আরো বলেন, "ম্যারিকোর বাংলাদেশে নারিকেল তেলের বাজার নিয়ে স্টাডি ছিল। তারা জানতো এই বাজারের গ্রোথ সম্পর্কে। তারা আরো জানতো যে দেশীয় কোম্পানিগুলোর এই বিষয়ে, বিশেষ করে পাবলিক সেন্টিমেন্ট নিয়ে তেমন স্টাডি নেই। আর এই সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য তারা সময়মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ স্কয়ারের মতো বড় প্রতিষ্ঠানও ম্যারিকোর মতো করে ভাবতে পারেনি।"

"এছাড়া দেশিও উদ্যোক্তারা নারিকেল তেলের ব্যবসা শুরু করলেও তারা কসমেটিকসে বেশি মনোযোগ দিয়েছেন। অথচ এই তেল বিক্রি করেই যে বছরে ৩০০ কোটি টাকা মুনাফা সম্ভব সেটা তাদের ভাবনাতেই ছিল না। আর ম্যারিকো এই কাজটিই করে দেখিয়েছে।"

এদিকে মৌসুমী ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (কিউট ব্র্যান্ড) কাজী মঈন উদ্দিন আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "দেশীয় উদ্যোক্তাদের অবহেলার সুযোগেই বিদেশি প্রতিষ্ঠান নারিকেল তেলের বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে।"

তিনি বলেন, "এই বাজারকে এগিয়ে নিতে যে দক্ষ জনশক্তির দরকার তা আমরা তৈরি করতে পারিনি, যা বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ছিল।" 

তবে এখনো অনেক কোম্পানি নারিকেল তেলের ব্যবসায় নতুন করে বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে। সিটি গ্রুপ রহিমা ফুড নামের একটি কোম্পানি কিনে নিয়ে সেখানে নারিকেল তেলের উৎপাদনে যাওয়ার জন্য কাজ শুরু করেছে। 
 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.