১৬ ব্যাংক, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শিল্পখাতে খেলাপি ঋণ গড়ে ৪০ শতাংশের বেশি

অর্থনীতি

03 October, 2022, 04:30 pm
Last modified: 03 October, 2022, 05:01 pm
বিশেষ করে, যেসব প্রতিষ্ঠান অতীতেও বিভিন্ন কেলেঙ্কারির জন্য পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি বেড়েছে।
ইনফোগ্রাফ: টিবিএস

দেশে শিল্পখাতে ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) খেলাপি ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে, যেসব প্রতিষ্ঠান অতীতেও বিভিন্ন কেলেঙ্কারির জন্য পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি।

চলতি বছরের জুন শেষে দেখা যায়, দেশের ১৬টি ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শিল্পখাতে মোট খেলাপি ঋণের গড় হার দাঁড়িয়েছে ৪০ শতাংশের ওপরে।স্বতন্ত্রভাবে, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রত্যেকটিরই বকেয়া শিল্প ঋণের অন্তত ৩০ শতাংশ খেলাপি অবস্থায় রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যথাযথভাবে ক্রেডিট রিস্ক মূল্যায়ন ছাড়াই বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়ার কারণে খেলাপির পরিমাণ এত বেশি বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দেশের ব্যাংক ও এনবিএফআইগুলোর কাছে শিল্পখাতে প্রায় ৬.৬৯ লাখ কোটি টাকা বকেয়া ঋণ জমেছে। এরমধ্যে ৫৮ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে, যা মোট অঙ্কের প্রায় ৯ শতাংশ। ৩ মাস আগেও শিল্পখাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫২ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা। 

প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, খারাপ অবস্থায় থাকা ৯টি ব্যাংক ও ৭টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শিল্পখাতে মোট ঋণের পরিমাণ ৫৬ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা। এরমধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ রয়েছে ২৪ হাজার ৬১১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪৩.২৩ শতাংশ।

ব্যাংকগুলো হলো- বেসিক ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক। অন্যদিকে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি, সিভিসি ফাইন্যান্স, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, ফাস ফাইন্যান্স, আইআইডিএফসি ফাইন্যান্স এবং ইন্টারন্যাশনাল লিজিং।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সঠিকভাবে ঋণ বিতরণ না করায় কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। বেশিরভাগ ঋণ বিতরণ হয়ে থাকে বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে, যাতে আদায়ে ব্যর্থ হলে খেলাপির পরিমাণটা বেড়ে যায়। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান আবার অতিরিক্ত মুনাফার লাভে যাছাই-বাছাই ছাড়াই কিছু প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিচ্ছে, যা সহজেই হয়ে যাচ্ছে খেলাপি।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, শিল্প খাতে ছোট প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানের খেলাপি হওয়ার হার বেশি। 

"বড় প্রতিষ্ঠানগুলো খেলাপি হওয়ার পরও বারবার ঋণ পাচ্ছে। তাই এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছেই। এছাড়া পুনঃতফসিলীকরণ ও পুনর্গঠন সুবিধার কারণে এ খাতের দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ, খেলাপি ঋণের চেয়ে অনেক বেশি," যোগ করেন তিনি। 

তিনি বলেন, "বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠানের কাছে খেলাপি ঋণ বেশি। কারণ এরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। যারা ধরাছোঁয়ার বাইরে তাদের নতুন করে ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দিতে হবে। নতুন ঋণ যাতে না বাড়ে এটি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই এ খাতে খেলাপি ঋণ কমবে।"

ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও এমরানুল হক টিবিএসকে বলেন, "আমাদের দেশের সব ব্যাংকই শিল্প খাতে ঋণ দিতে উৎসাহিত করে। এই ঋণ সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি এবং বড় অঙ্কের হয়। এ কারণেই যখন এই ধরনের ঋণ খেলাপি হয়ে যায়, তখন সামগ্রিকভাবে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের অঙ্কটাও বেড়ে যায়।"

তিনি আরও বলেন, কিছু ব্যাংকে খেলাপি শিল্প ঋণের পরিমাণ বেশি, কারণ ব্যাংকগুলো প্রকল্প ঋণের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে ঝুঁকি মূল্যায়ন করে না।

প্রকল্পের জন্য কত টাকা প্রয়োজন, প্রকল্পটি কার্যকর কিনা, এর ব্যবস্থাপনা সক্ষম কিনা এবং বাজারে ঋণগ্রহীতার প্রতিযোগিতা কতটুকু- এসব বিষয় সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করা হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি। 

তিনি আরও বলেন, "শিল্প ঋণ খুবই টেকনিক্যাল একটি বিষয়। যেসব ব্যাংকের ভালো টেকনিক্যাল নলেজ রয়েছে, তারা এই ঋণগুলো ভালোভাবে পরিচালনা করতে পারে; আর যারা যথাযথ মূল্যায়ন ছাড়াই ঋণ দেয়, তাদের ক্ষেত্রেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়তে দেখা যায়।"

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালের জুন শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। এরমধ্যে শিল্পখাতে খেলাপি ৫৮ হাজার ১৪৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, যা ব্যাংকিং খাতের মোট খেলাপি ঋণের ৪৬.৪১ শতাংশ। শিল্পখাতের খেলাপি ঋণের ব্যাংকগুলোতে রয়েছে ৪৭ হাজার ৬১৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। 

অন্যদিকে, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে দেওয়া মোট ১৫ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা ঋণের ১০ হাজার ৫২৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকাই খেলাপি ঋণ, যা শিল্পখাতে দেওয়া খেলাপি ঋণের ৬৬ শতাংশ।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে। বেসরকারি ব্যাংকে শিল্পখাতে খেলাপির পরিমাণ ১৯ হাজার ৬৮৯ কোটি বা ৫.৬৬ শতাংশ। এসব ব্যাংকের মোট শিল্প ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৭ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা।

এরপর রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ৬ ব্যাংকে খেলাপি ১৯ হাজার ৫২৯ কোটি ২৬ লাখ টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ২২.৫৬ শতাংশ। এই ব্যাংকগুলোর শিল্পঋণের পরিমাণ ৮৬ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১ লাখ ২৮ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকা, যা ৩ মাস আগে ছিল ১ লাখ ২১ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা। সে হিসেবে ৩ মাসের ব্যবধানে শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বা ৫.৫১ শতাংশ।

এদিকে, শিল্পঋণ বিতরণ বাড়লেও আদায়ের হারের অবস্থা নাজুক। চলতি বছরের জুন শেষে আদায় কমেছে ১৩ শতাংশের বেশি। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ সময়ে শিল্পখাতে ঋণ আদায় হয়েছে ৮৮ হাজার ২৩১ কোটি টাকা, যা ৩ মাস আগে ছিল ১  লাখ ১ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। সে হিসেবে ৩ মাসের ব্যবধানে শিল্পখাতে ঋণ আদায় কমেছে ১৩ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা বা ১৩.৩৯ শতাংশ।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.