'খাজা কনফেকশনারী' যেভাবে বগুড়ার ঘরে ঘরে পরিচিত নাম হয়ে উঠল  

অর্থনীতি

18 September, 2022, 01:40 pm
Last modified: 18 September, 2022, 01:51 pm
এই প্রতিষ্ঠান নিজের আয়েই চলে। অর্থাৎ তাদের কোনো ব্যাংক ঋণ নেই। শূন্য থেকে গড়ে ওঠা এই প্রতিষ্ঠানে এখন ২৫০ জন মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে।

আব্দুস সোবহান খাজার বয়স যখন ৪২, তখন চাকরি হারিয়ে দিশেহারা অবস্থায় পড়েন। জীবনযুদ্ধের মাঝখানে এসে চাকরি হারিয়ে চোখে অন্ধকার দেখা শুরু করেন। সংসার আর দুই ছেলের পড়াশোনার খরচ যোগানোর একমাত্র অবলম্বনই ছিল এই চাকরি। তবে পথ হারাননি সোবহান।

এর মধ্যে কেটে গেছে ২৮ বছর। সোবহানের বয়স এখন ৭০। সময়ের বিবর্তনে আশ্রয়হারা সেই সোবহানই এখন আড়াইশ পরিবারের আশ্রয়দাতা।

গল্পটা বগুড়ার চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা আব্দুস সোবহানের। প্রতিকূলতার কাছে হার না মানা এই ব্যক্তি বগুড়ায় বিভিন্ন খাবার, কেক উৎপাদনে ব্র্যান্ড তৈরি করেছেন। শূন্য থেকে শুরু করা খাজা কনফেকশনারীর মাধ্যমে তিনি এখন কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।

সোবহান বগুড়ার এক ঐতিহাসিক খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে কেক তৈরির কাজে যুক্ত ছিলেন। দীর্ঘদিন চাকরি করে ১৯৯৪ সালে চাকরি হারান। এই সময় তার সম্বল বলতে বগুড়া শহরের গোয়ালগাড়িতে একটি বাড়ি। চারতলায় ভিত দেওয়া এই বাড়ির একতলাও ঠিকঠাক তোলা ছিল না। কোনোমতে বসবাস করতেন সন্তানদের নিয়ে। এর মধ্যে দিশেহারা সোবহান সিদ্ধান্ত নিলেন বাড়ির নিচতলাতেই শোবার ঘরের পাশে ছোট আকারে কারখানা তৈরি করে কেক উৎপাদন করবেন।

কিন্তু পুঁজি তো তার কাছে নেই। বাড়িতে এসে স্ত্রী গোলাপ বানুর সাথে পরামর্শ করেন। তখন স্ত্রীর তার বাবার বাড়িতে পাওয়া ১১ বিঘার জমি থেকে দুই বিঘা বিক্রি করে টাকা দিতে চাইলেন। পরে জমি বিক্রির টাকা দিয়ে ২ শতক জমিতে কেক ও বেকারী পণ্য উৎপাদন শুরু করেন ১৫ জন শ্রমিক নিয়ে। শুরুতে এক চুলায় কেক উৎপাদন করা হতো। সাথে অল্প পরিমাণ বেকারী আইটেম। এসব পণ্য বাড়ির সামনেই বিক্রি করতেন। কিন্তু প্রতিযোগিতার বাজারে টিকতে পারেন না। লোকসান গুনতে থাকেন নিয়মিত। দুই বিঘা জমি বিক্রির পুঁজি হারিয়ে যায় এক সময়। ২০০০ সালে পুঁজি হারিয়ে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়। এই সময় গোলাপ বানু তার ১১ বিঘা জমিই বিক্রি করে তার স্বামীকে ব্যবসার জন্য দেন।

ছবি- সংগৃহীত

তখন সোবহানের ছোট ছেলে বায়েজিদ শেখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণীবিদ্যা বিভাগে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন। বাবার ব্যবসায় ক্রমাগত লোকসানের কারণে পড়াশোনা বাকি রেখে বগুড়ায় চলে আসেন। তিনিও শেখেন কেক তৈরির কাজ। ৪৫ বছর বয়সী বায়েজিদ শেখ এখন খাজা কনফেকশনারী পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন। পরে অবশ্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ডিগ্রী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন।

বায়েজিদ জানান, খাবার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে যোগদানের আগে তার বাবা দর্জির কাজ করতেন। ওই সময়ের একটি সেলাই মেশিন ছিল তাদের। কেক উৎপাদনের জন্য ওভেন কেনার টাকা যোগাড় হচ্ছিল না; বাধ্য হয়ে তখন ওই সেলাই মেশিন তিন হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। এরপর মোট ৯ হাজার টাকায় ২০০১ সালের দিকে একটি ওভেন কেনেন। বায়েজিদ, তার বড় ভাই খোবায়েব শেখ ও দু'জন শ্রমিক নিয়ে আবার বাড়িতেই কেক উৎপাদন শুরু করেন। শুরুতে তারা শুধুমাত্র জন্মদিনের কেক তৈরী করতেন। এই সময় প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ পাউন্ড কেক বিক্রি হতো।

সময়ের সাথে সাথে তাদের কেকের চাহিদা বাড়তে থাকে। এক বছরের মধ্যে শহরের সাতমাথা এলাকায় অন্য এক সহযোগীকে সঙ্গে নিয়ে প্রথম আউটলেট চালু করেন। এ সময় খোবায়েব ও বায়েজিদ বগুড়ার একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় চাকরির অফার পান। দুই ভাইয়ের বেতন মিলে তখন ২০ হাজার টাকার প্রস্তাব আসে। কিন্তু তারা হিসেব করে দেখলেন তাদের উৎপাদিত কেক বিক্রি করেই মাসে ১৫ থেকে ১৬ হাজার আয় হচ্ছে। এই সময়ে তারা চাকরি না করে উদ্যোক্তা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ২০০৪ সালে এসে অল্প পরিসরে বেকারী পণ্য (বিস্কুট, রুটি) উৎপাদন শুরু করেন। এরপর ২০০৫ সালে আরেকটি ওভেন কেনেন। তখন তাদের উৎপাদনের পরিধি বেড়ে যায়। ভ্যানচালককে সাথে নিয়ে দুই ভাই মিলে দোকানে দোকানে কেক, বিস্কুট, রুটি বিক্রি করতেন তখন।

বায়েজিদ বলেন, ব্যবসা পুরোপুরি ভালো অবস্থানে গেলে খোবায়েব স্থানীয় সরকার বিভাগে ঠিকাদারির কাজ শুরু করেন। তখন এই ব্যবসা এককভাবে দেখাশোনা করেন তিনি। ২০০৫-০৬ সালের দিকে চীন থেকে ডেক ওভেন, মিক্সার মেশিন নিয়ে আসলে ব্যবসা আরও বিকশিত হয়। ২০০৭ সালের দিকে শ্রমিক সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ জনে। এই প্রতিষ্ঠানের বড় পরিসনে উত্থান এখান থেকেই। এরপর নতুন করে তাদের আর সংগ্রাম করতে হয়নি।

বর্তমানে বগুড়া শহরের সুলতানগঞ্জ এলাকায় ৭ শতক জমিতে একটি রুটির কারখানা রয়েছে। এই জায়গাটি তারা কিনেছেন। একই এলাকায় ভাড়া বাড়িতে ৬ শতক জমিতে বিস্কুটের কারখানা রয়েছে। কেকের কারখানা এখন ১০ শতক জমিতে। এই জায়গার মধ্যে ৪ শতক ভাড়া নেওয়া। ২০১৭ সালে সদরের নুনগোলা এলাকায় ২ বিঘা জমি কিনে সেমাই, মিষ্টি, দই, চানাচুর, মাঠার কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। এসবের মধ্যেই তাদের সুলতানগঞ্জের অসম্পূর্ণ বাড়ি সাততলা করা হয়েছে।  

বায়েজিদ বলেন, দীর্ঘ সময়ের মধ্যে শুধু বগুড়া শহরে ১১টি তাদের আউটলেট করা হয়েছে। চারটি থানায় আউটলেট রয়েছে। আর গাইবান্ধায় ২টি আউটলেট করা হয়েছে চাহিদার প্রেক্ষিতে।

এর মধ্যে বায়েজিদরা তাদের মায়ের নামে জমি কিনেছেন আলাদা করে। সবচেয়ে বড় কথা, এই প্রতিষ্ঠান নিজের আয়েই চলে। অর্থাৎ তাদের কোনো ব্যাংক ঋণ নেই। তাদের উৎপাদিত পণ্য এখন দেশের উত্তরাঞ্চলসহ দেশের প্রায় সব অঞ্চলে যাচ্ছে। শূন্য থেকে গড়ে ওঠা এই প্রতিষ্ঠানে এখন ২৫০ জন মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে বলে জানান বায়েজিদ।

ছবি- সংগৃহীত

সম্ভাবনা ও সংকট

দেখে এখন খাদ্যপণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। গুণগত মানের খাবার উৎপাদন করলে তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। সম্ভাবনাময় এই খাতে প্রশিক্ষিতদের এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন বায়েজিদ। 

তিনি বলেন, 'পড়াশোনায় কম আগ্রহীদের এখন কারিগরি বা কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। যার যে বিষয়ে আগ্রহ আছে তাকে সে বিষয়ে নিয়োজিত করতে হবে। তাহলে আমাদের দেশের বেকার সমস্যারও সমাধান হবে।'

খাদ্য উৎপাদনে বড় রকমের সংকট নেই। তবে খাদ্য উৎপাদন করতে গেলে স্থানীয় প্রশাসনের অন্তত ১৫ শাখা থেকে অনুমোদন নিতে হয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দপ্তর থেকে লোকজন এসে চাপে রাখে।

বায়েজিদের ভাষ্যে, 'আমাদের দেশ এখনো ইউরোপ-আমেরিকার মতো হয়নি। দেশ তাদের মতো হলে আমাদেরও স্বচ্ছতার অভাব থাকবে না। তবে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে চাপে ফেলে উদ্যোক্তাদের ক্ষতি করার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসার অনুরোধ থাকবে।'  

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.