প্রতিশ্রুত ২০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ ধীর গতিতে দিচ্ছে চীন

২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণ (এলডিসি গ্রাজুয়েশন) হবে বাংলাদেশের, এই সময়ে চীন থেকে সহজ শর্তে ঋণ পেতেও সমস্যায় পড়ছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের ( ইআরডি) তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরে মাত্র দুটি প্রকল্পে ৪০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়া যেতে পারে দেশটি থেকে। প্রকল্প দুটি হচ্ছে: রাজশাহী ওয়াসার সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনের ছয়টি পূর্ণাঙ্গ টিভি স্টেশন স্থাপন।
এই দুটি প্রকল্পে যথাক্রমে ২৭৬.২৫ এবং ১২৫.১২ মিলিয়ন ডলার ঋণপ্রস্তাব রয়েছে।
এর আগে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে মাত্র একটি প্রকল্পে ১.১২ বিলিয়ন ডলার ঋণ চুক্তি সই হয়েছে চীনের সঙ্গে।প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের চার বছরে পর ঋণ চুক্তি সই হয়।
চট্টগ্রামে চীনা অর্থনৈতিক ও শিল্প এলাকা এবং তিস্তা নদী সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্পের মতো বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পও দীর্ঘদিন ধরে ঋণের অপেক্ষায় রয়েছে।
এদিকে স্বল্পোন্নত (লিস্ট ডেভেলপট কান্ট্রি বা এলডিসি) থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশ এলডিসি' দেশের জন্য নির্ধারিত বিশেষ সুবিধা যেমন সহজ শর্তের ঋণ পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবে না।
দ্রুতই সময় ফুরিয়ে আসলেও সরকার আশা করছে, আগামী চার বছরের মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে চীনের অর্থায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং- এর বাংলাদেশ সফরকালে স্বাক্ষরিত 'স্ট্রেনথেনিং অ্যান্ড প্রোডাকশন ক্যাপাসিটি কো-অপারেশন' শীর্ষক সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ)- অংশ হিসেবে পাওয়ার কথা এসব অর্থায়ন।
এতে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের ঋণের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, যার মাধ্যমে মোট ২৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা রয়েছে।
কিন্তু, এপর্যন্ত মাত্র ৮টি প্রকল্পে ৭৮০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি সই হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রকল্পগুলো হলো: পদ্মা রেলসেতু সংযোগ প্রকল্প, ডিপিডিসির আওতাধীন এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ এবং সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং স্থাপন।
সাম্প্রতিক দুটি প্রকল্প ছাড়াও ২০২৬ সালের মধ্যে আরো ৪টি প্রকল্প পাইপলাইনে রয়েছে।
তবে ইআরডির কর্মকর্তারা আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলছেন, ২০২৬ সালের পরে বাংলাদেশের নমনীয় বা সহজ শর্তের ঋণ পাওয়ার সুযোগ কমে আসবে। তার আগেই কম সুদের ঋণ পাওয়া গেলে, তা দেশের ভালো জন্য ভালো হবে।
এবিষয়ে মন্তব্যের জন্য দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের পক্ষ থেকে ইআরডি সচিব শরিফা খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়, কিন্তু তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
তবে নাম না প্রকাশের শর্তে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, ঋণের প্রতিটি আবেদন চীন সরকার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পর্যালোচনা করে অনুমোদন দিচ্ছে, এতে ঋণ অনুমোদনেও দেরি হচ্ছে।
অবশ্য চীন পদ্মা রেলসেতু এবং ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে'র মতো দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে ঋণ দিতে রাজি হয়েছে।
একইভাবে, ছয়টি বিভাগীয় শহরে টিভি স্টেশন নির্মাণ এবং আখাউড়া- সিলেট রেলওয়ে প্রকল্প সরকারের অনুমোদন পেয়েছে তিন বছর আগে। কিন্তু, এখনও তাতে ঋণদানের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেনি চীন।
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, রাজশাহী ওয়াসার সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট প্রকল্পের ঋণপ্রস্তাব ২০২১ সালের ১৩ এপ্রিল, চীনের কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। এই ঋণ প্রস্তাব এখন চীন সরকার পর্যালোচনা করছে। যদিও ইআরডি আশা করছে, চলতি বছরের ডিসেম্বরে চীনের সঙ্গে ঋণ চুক্তি সই হবে।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ছয়টি পূর্ণাঙ্গ টিভি স্টেশন স্থাপন প্রকল্পের ঋণ প্রস্তাব চীনের কাছে পাঠানো হয়। মূল্যায়ন শেষে আগামী বছরের মার্চের মধ্যে এ সংক্রান্ত ঋণ চুক্তি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, চীনা ঋণের প্রকল্পে ব্যয় বেশি হলেও, দেশটির শর্ত ততোটা খারাপ না।
'ঋণ যত নমনীয় শর্তের হয়, সেটি ততোই ভালো। কিন্তু, নমনীয় ঋণের সুযোগ আমরা আর বেশিদিন পাব না। তাই আমাদের প্রকল্প নির্বাচনে সতর্ক হতে হবে'।
ভবিষ্যতে বোঝা হয়ে উঠবে এমন প্রকল্প না নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
'অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে, এমন প্রকল্পই আমাদের নিতে হবে। চীনের ঋণের ফাঁদে পড়ার অবস্থা এখনও আমাদের হয়নি। প্রকল্প নির্বাচনে সতর্ক থাকলে, আমরা ফাঁদে পড়বও না'।
ইআরডির তথ্যমতে, চীনের ঋণে সুদ হার ২% এবং এর সঙ্গে কমিটমেন্ট চার্জ ০.২৫ এবং ম্যানেজমেন্ট ফি ০.২৫ শতাংশ; ৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ চীনের ঋণ ১৫ থেকে ২০ বছরে শোধ দিতে হয়।
ঋণের অপেক্ষায় থাকা গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প:
চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ৭৮৩ একর জায়গার ওপর নির্মাণাধীন চাইনিজ ইকোনমিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনের কাজ স্থবির হয়ে আছে ৫ বছর ধরে।
গত আগষ্ট মাসে জোনটি স্থাপনে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) এবং চীনের প্রতিষ্ঠান চায়না রোড অ্যান্ড ব্রিজ করপোরেশনের (সিআরবিসি) মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়।
যদিও, ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, এই প্রকল্পের ঋণ চুক্তি ২০২৫ সালের আগে হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
জোনটির জন্য প্রাথমিক আবেদন ২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর চীনা দূতাবাসে পাঠানো হয়; আনুষাঙ্গিক নথিপত্র পাঠানো হয় ২০২০ সালের ২২ জানুয়ারিতে। চীন থেকে এখনো কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে তিস্তা নদী সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্পে ৭২৫ মিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়া কথা রয়েছে। এই প্রকল্পের প্রস্তাবনা নিয়ে এখনো চীন সরকার পর্যালোচনা করছে। ২০২৫ সালের মধ্যে এই প্রকল্পের জন্য ঋণ চুক্তির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ইআরডি।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন অব চায়নার সাথে প্রকল্পের কারিগরি সম্ভাব্যতা যাচাই, বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন ও নির্মাণ কাজ শুরুর লক্ষ্যে একটি সমঝোতা স্মারকে সই করে।
এই সমঝোতায় সই চীন থেকে ঋণ পেতে বাংলাদেশের জন্য সহায়ক হওয়ার কথা ছিল।
ঋণের অর্থে বাংলাদেশ সরকার তিস্তা নদীর মূল চ্যানেল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে ১৭০.৮৭ কিলোমিটার ভূমি পুনরুদ্ধার করতে চায়। একইসঙ্গে, প্রয়োজন অনুসারে বাধ নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।
পুনরুদ্ধার করা ভূমির মূল্য হবে ১,৫৭০.৮৪ মিলিয়ন ডলার। আর বাধ নির্মাণের ফলে যে পরিমাণ সম্পত্তি রক্ষা পাবে তার মূল্য প্রাক্কলন করা হয়েছে ১,৩৪৬.০২ মিলিয়ন ডলার।
প্রকল্প থেকে পাওয়া মোট সুবিধার মূল্য ধরা হয়েছে ২,৯১৬.৮৯ মিলিয়ন ডলার।
২০১৯ সালের এপ্রিলে একনেকে অনুমোদন পেলেও আখাউড়া থেকে সিলেট সেকশন পর্যন্ত এমজি রেলওয়ে ট্র্যাকের ডিজি রেলওয়ে ট্র্যাকে রুপান্তর প্রকল্পে চীনের কাছ থেকে ঋণের চূড়ান্ত প্রতিশ্রুতি আদায় করা সম্ভব হয়নি।
এই প্রকল্পে ১২৭ কোটি ডলার ঋণ দেওয়া কথা রয়েছে চীনের। ২০২৪ সালে এই প্রকল্পের জন্য ঋণ চুক্তি হতে পারে বলে জানান ইআরডির কর্মকর্তারা।
চীনের অর্থায়নে বাস্তবায়নের জন্য পাইপলাইনে থাকা উল্লেখযোগ্য প্রকল্পগুলো হলো: মোংলা বন্দর অবকাঠামোর সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়ন, ডিজিটাল কানেক্টিভিটি স্থাপন, ছয়টি জাহাজ ক্রয়, জয়দেবপুর– ময়মনসিংহ– জামালপুর সেকশনে বিদ্যমান এমজি লাইনের পাশাপাশি ডিজি ট্র্যাক নির্মাণ এবং পৌরসভাগুলোর জন্য পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন, নিস্কাশন ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নির্মাণ।