টাকা ফেরত চায় জীবন বীমা, ব্যাংকগুলি অপারগ 

অর্থনীতি

21 August, 2022, 12:50 am
Last modified: 21 August, 2022, 05:21 pm
আমানতের টাকা ফেরত পেতে, জেবিসির একই অবস্থা হয়েছিল পদ্মা ব্যাংকে টাকা রেখে, যা তখন ফারমার্স ব্যাংক নামে ছিল। ব্যাংকটির সাতটি হিসাবে ১০৯ কোটি টাকা আমানত রেখেছিল জীবন বীমা করপোরেশন।

অবিবেচক সিদ্ধান্তের মূল্য দিচ্ছে  রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা সংস্থা জীবন বীমা করপোরেশন (জেবিসি)। গ্রাহকের বিমা প্রিমিয়ামের টাকা দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত রেখে মেয়াদ শেষেও তা আর ফেরত পাচ্ছে না।

মেয়াদোত্তীর্ণ হিসাবের অর্থ ফেরত চেয়ে করপোরেশনটি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডি, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে ডজন ডজন চিঠি লিখেও কোনো সাড়া পাচ্ছে না।    

যেমন- বেসরকারিখাতের ফার্স্ট ফাইন্যান্স লিমিটেডে দু'টি স্থায়ী আমানত হিসাব খুলে প্রায় ৪০ কোটি টাকা আমানত রাখে জেবিসি, যার মেয়াদ যথাক্রমে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি ও এপ্রিলে পূর্ণ হয়েছে। গত ৩১ জুলাই নাগাদ সুদাসলে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৮.৪৬ কোটি টাকা।

২০১৮ সালে মেয়াদোত্তীর্ণের সময় থেকেই জেবিসি আমানত হিসাব দু'টি নগদায়নের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফার্স্ট ফাইন্যান্সকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করলেও– জেবিসির টাকা দেয়নি আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি। এই চার বছরে পাওনা টাকা চেয়ে বিমা কোম্পানিটি  ফার্স্ট ফাইন্যান্সকে ৩৮টি তাগিদপত্র দিয়েছে। কিন্তু, তাতে কোনো সাড়া পায়নি।

এবিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগও বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনরকে চিঠি দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ফার্স্ট ফাইন্যান্সের চেয়ারম্যানের কাছে দুটি এবং জীবন বীমার তহবিল যাতে ছাড় করা হয় সেজন্য ব্যবস্থা নিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিবকে আরেকটি চিঠি দিয়েছে। কিন্তু, আমানতের টাকা ফেরত পাওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যায়নি।

জেবিসির আমানতের অর্থ ফেরত দিতে সর্বশেষ গত ১২ জুন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ফার্স্ট ফাইন্যান্সের এমডিকে আরেকটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। এতকিছুর পরও রুগ্ন আর্থিক অবস্থার কারণে ফার্স্ট ফাইন্যান্স কর্তৃপক্ষ আমানতের টাকা ফেরত দেয়নি বলে গত জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংককে লিখিতভাবে জানিয়েছেন জেবিসির এমডি মো. সাইফুল ইসলাম।

দুর্বল আর্থিক অবস্থার কারণে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ফার্স্ট ফাইন্যান্স লিমিটেড সাধারণ গ্রাহকের আমানতের অর্থও ফেরত দিতে পারছে না।

আমানতের টাকা ফেরত পেতে, জেবিসির একই অবস্থা হয়েছিল পদ্মা ব্যাংকে টাকা রেখে, যা তখন ফারমার্স ব্যাংক নামে ছিল। ব্যাংকটির সাতটি হিসাবে ১০৯ কোটি টাকা আমানত রেখেছিল জীবন বীমা করপোরেশন। ভিন্ন সময় নবায়ন শেষে ২০১৮ সালে সবক'টি আমানত হিসাব মেয়াদোত্তীর্ণ হয়। তখন থেকে আমানত নগদায়নের জন্য পদ্মা ব্যাংককে ২৬টি তাগাদাপত্র এবং পাঁচটি ডিও লেটার-সহ মোট ৩১টি চিঠি দিয়েছে জেবিসি। কিন্তু তা সত্ত্বেও নগদায়ন করেনি ব্যাংকটি।

ওই সময় সুদাসলে পদ্মা ব্যাংকের কাছে পাওনা দাঁড়ায় ১২৫ কোটি টাকা। কিন্তু, এই অর্থ পরিশোধের আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় ব্যাংকটি পরিশোধের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয় জেবিসিকে। ২০২৩ সাল থেকে শুরু হওয়া সাত বছর মেয়াদি এই আমানতে সুদ ধার্য করা হয় ৬ শতাংশ, প্রস্তাবটি জীবন বীমা মেনে নেয়।

গত বছর পদ্মা ব্যাংককে যখন এ সুযোগ দেওয়া হয়, জেবিসির তখনকার এমডি মো. জহুরুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছিলেন, "মন্দের ভালো হিসেবে পদ্মা ব্যাংকের প্রস্তাব আমরা মেনে নিয়েছি। যেহেতু তারা টাকা দিতে পারছে না, সেক্ষেত্রে টাকা আদায় করতে আমাদের মামলা করতে হতো। মামলা করে টাকা আদায় করাও সময়ের ব্যাপার।"

এদিকে, বেসরকারিখাতের মধুমতি ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় তিন কোটি টাকা আমানত রেখেছিল জেবিসি, যার মেয়াদোত্তীর্ণ হয় ২০২১ সালের ৫ মার্চ। তার দু'দিন আগেই জেবিসি আমানত হিসাবটি নগদায়নের সিদ্ধান্ত জানিয়ে চিঠি দিলে ৭ মার্চ ব্যাংকটি শুধু এক বছরের সুদ পরিশোধ করে এবং ১৪ মার্চ আমানতের মূল অর্থ নগদায়ন করে।

বাংলাদেশ ব্যাংককে লেখা চিঠিতে জীবন বীমার এমডি বলেছেন, আমানত হিসাবটি নগদায়ন করে দিতে মধুমতি ব্যাংক ৭ দিন দেরি করেছে। এই সাত দিনের জন্য ৪০,২৭৪ টাকা পাওনা দাবি করে জেবিসি ১০টি তাগিদপত্র দিলেও তা পরিশোধ করছে না ব্যাংকের মতিঝিল শাখা।

এছাড়া, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক থেকেও আমানতের টাকা ফেরত পাচ্ছে না জেবিসি। নিয়মিত বিরতিতে ব্যাংকটিকে তাগাদাপত্র দিয়েও কোন সাড়া পাচ্ছেন না করপোরেশনের কর্মকর্তারা।

জীবন বীমা কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "এটা জনগণের টাকা, মুনাফার উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ করা হয়েছে। মেয়াদ শেষ হওয়ার পরই ফেরত দেওয়ার কথা। কিন্তু, তারা (ব্যাংকগুলি এবং নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি) টাকা ফেরত না দেওয়ার কারণে জেবিসিকে সমস্যায় পড়তে হয়েছে।"

তিনি বলেন, "টাকা নগদায়ন করতে বারবার তাগাদা দেওয়া হয়েছে, তারপরও তারা কর্ণপাত করছে না। কীভাবে সেই টাকা আদায় করা যায়, তা ভাবা হচ্ছে। আলোচনাও চলছে।"

সংশ্লিষ্টরা জানান, দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণ আমানতকারীদের কাছ থেকে খুব বেশি আমানত পায় না। ফলে সরকারি প্রতিষ্ঠানের তহবিল সংগ্রহের দিকে এসব প্রতিষ্ঠানের ঝোঁক থাকে বেশি। অনেক সময় বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের মোটা অংকের আমানত পাওয়ার জন্য ওই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ঘুষ হিসেবে কমিশনও দেয়া হয়। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা- অনেক দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত রেখে নির্ধারিত সময়ে তা ফেরত পায় না।

জেবিসির আমানত রাখার ক্ষেত্রেও এ ধরণের কোনো ঘটনা ঘটেছে কি-না, তা জানা যায়নি। এ বিষয়ে করপোরেশনের এমডি সাইফুল ইসলামকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এসব আমানত রাখা হয়েছে আমার যোগদানের আগেই।

বর্তমানে কোন কোন প্রতিষ্ঠানে জেবিসির মোট কত টাকা আমানত আছে, তা জানাতে চাননি প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা। তবে ২০২০ সালের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জেবিসির আমানতের পরিমাণ ছিল প্রায় ৭৬০ কোটি টাকা। 

 

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.