ভারতের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য চুক্তির আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরুর সবুজ সংকেত প্রধানমন্ত্রীর

অর্থনীতি

17 August, 2022, 12:25 am
Last modified: 17 August, 2022, 07:09 am
প্রস্তাবিত সেপা মুক্ত বাণিজ্যের এফটিএ চুক্তি থেকে কিছুটা আলাদা—কারণ এতে পণ্য বাণিজ্যের পাশাপাশি, সেবা বিনিময়, মেধাস্বত্ব, ই-কমার্সসহ আরও অন্যান্য দিক অন্তর্ভুক্ত।

ভারতের সঙ্গে কম্প্রিহেন্সিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (সেপা) চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরুর প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মতি দিয়েছেন বলে জানিয়েছে এ বিষয়ে অবহিত সূত্রগুলি।

আগামী ৫-৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরকালে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর যৌথ বিবৃতিতে সেপা স্বাক্ষরের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতেও সম্মতি দিয়েছেন তিনি।

ইতঃপূর্বে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সেপা সম্পাদনের জন্য আলোচনা শুরুর অনুমোদন চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সার-সংক্ষেপ পাঠায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রী তাতে সম্মতি দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

এর মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো কোনো দেশের সঙ্গে এফটিএ (ফ্রি-ট্রেড এগ্রিমেন্ট বা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি) সইয়ের জন্য বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছে। চীন, জাপানসহ আরও কিছু দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষরের প্রস্তাব দিলেও তা এখনও পর্যালোচনা (সমীক্ষা) পর্যায়েই রয়েছে।

প্রস্তাবিত সেপা মুক্ত বাণিজ্যের এফটিএ চুক্তি থেকে কিছুটা আলাদা—কারণ এতে পণ্য বাণিজ্যের পাশাপাশি, সেবা বিনিময়, মেধাস্বত্ব, ই-কমার্সসহ আরও অন্যান্য দিক অন্তর্ভুক্ত।

সার-সংক্ষেপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ-ভারত সেপা স্বাক্ষরিত হলে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি ১৯০% এবং বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি ১৮৮% বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এবং বাংলাদেশ ও ভারতের জিডিপিতে যথাক্রমে ১.৭২% এবং ০.০৩% প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে বলে ঢাকা-দিল্লির যৌথ সমীক্ষায় উঠে এসেছে।

'বৃহৎ বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তি সই করা হলে তা ভালো ফলাফল আনে। তবে, এর সাথে রাজস্ব ঝুঁকিও জড়িত আছে। সদ্যসমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারত থেকে ১ লাখ ৪৪ হাজার ১৬০ কোটি টাকার পণ্য আমদানির বিপরীতে মোট ১৭ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা রাজস্ব আহরিত হয়েছে। সেপা স্বাক্ষরিত হলে, পর্যায়ক্রমে এই রাজস্ব বহুলাংশে হ্রাস পাবে'- প্রধানমন্ত্রীকে পাঠানো সার-সংক্ষেপে উল্লেখ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

'কিন্তু সেপা'র আওতায়, পণ্য বাণিজ্য ছাড়াও সেবা ও বিনিয়োগসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যান্য বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকায় সামগ্রিক অর্থনীতি ও বাণিজ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশা করা যায়'- প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।

গত অর্থবছর ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ প্রথমবারের মতো প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। একই সময়ে ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে 'সাউথ এশিয়ান ফ্রি টেড এরিয়া' চুক্তির আওতায় স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে- ভারতের বাজারে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে তামাক ও মদ জাতীয় ২৫টি পণ্য বাদে সকল পণ্যে শুল্কমুক্ত, কোটামুক্ত সুবিধা পাচ্ছে বাংলাদেশ।

তবে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে, ২০২৬ সালের পর ভারতের বাজারে এ সুবিধা থাকবে না। ফলে ভারতে পণ্য রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

মন্ত্রণালয় বলছে, বর্তমানে ভারতে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে কোনো শুল্ক বাধা না থাকলেও, বিভিন্ন ধরনের অশুল্ক বাধা রয়েছে; যার মধ্যে অ্যান্টি-ডাম্পিং ডিউটি আরোপ, পণ্যের গুণগত মান-সংক্রান্ত সার্টিফিকেশন, বন্দরের অপ্রতুল অবকাঠামো, স্থল ও নৌপথে যোগাযোগের সীমাবদ্ধতা উল্লেখযোগ্য। এগুলি দূর করা গেলে, বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এর আগে ২০২১ সালের ২৭ মার্চ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকালে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী সেপা সম্পাদনের যৌথ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা (জয়েন্ট ফিজিবিলিটি স্টাডি) দ্রুত সম্পন্ন করার নির্দেশনা দেন।

সে মোতাবেক, বাংলাদেশের পক্ষে বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউট (বিএফটিআই) এবং ভারতের পক্ষে সেন্টার ফর রিজিওনাল ট্রেড (সিআরটি) বিস্তারিত যৌথ সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করে গত মে মাসে দুই দেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। এতে ভারতের সঙ্গে সেপা আলোচনা শুরু করার বিষয়ে ইতিবাচক মতামত উঠে এসেছে।

যৌথ সমীক্ষা প্রতিবেদনের উপর আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তাতে ভারতের সঙ্গে সেপা স্বাক্ষরের জন্য কিছু সতর্কতা অবলম্বন করে আলোচনা শুরুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরের আগে নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মোহাম্মদ ইমরান গত ২৬ জুলাই ভারতের বাণিজ্য সচিব বি. ভি. আর. সুভ্রামনিয়ামের সাথে সাক্ষাৎ করে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।

তখন ভারতের বাণিজ্য সচিব সেপা স্বাক্ষরের জন্য আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করা এবং দুই প্রধানমন্ত্রীর যৌথ বিবৃতিতে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার উপর জোর দিয়ে বলেছেন, 'এই এফটিএ আলোচনা এমনভাবে করতে হবে, যাতে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে বেশি উপকৃত হয়'।

যৌথ সমীক্ষার চূড়ান্ত খসরায় বলা হয়েছে, চুক্তিটি হলে আগামী ৭-১০ বছরের মধ্যে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ৩-৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে এবং বাংলাদেশে ভারতীয় রপ্তানি বাড়বে ৪-১০ বিলিয়ন ডলার।

দুই দেশের জন্যই এতে আন্তঃবিনিয়োগের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে প্রতিবেদনটি জানিয়েছে।

প্রতিবেদনটি বলছে, 'বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রস্তাবিত সেপা চুক্তি সম্পর্কে পরিশেষে বলা যায়, এটি কেবল সম্ভবই নয় বরং এর মাধ্যমে পণ্য ও সেবা বাণিজ্যের পাশাপাশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও পারস্পরিকভাবে লাভবনা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে'।

বাণিজ্য নীতি বিশ্লেষক এবং বাণিজ্য আলোচক ড. মোস্তফা আবিদ খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সেপা আলোচনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত, বিদ্যমান শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা যাতে এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পরও অব্যাহত থাকে—তা নিশ্চিত করা। 'এ ছাড়া, যেসব অশুল্ক বাধার কারণে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, সেগুলো দূর করা'।

'আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরুর আগে ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের কী কী প্রয়োজন, সে বিষয়ে বিস্তারিত একটি অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের সঙ্গে আলোচনা করাও জরুরি। তা না হলে সেপা থেকে যে ধরনের সুফল পাওয়ার আশা করা হচ্ছে, তা সম্ভব নাও হতে পারে'- জানান তিনি।

বাংলাদেশ-ভারত চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ- এর সভাপতি এবং এফবিসিসিআই এর সাবেক সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ টিবিএসকে বলেন, বর্তমান বিশ্বে ভ্যালু চেইন-ই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

'ভারত তুলা উৎপাদন করে, যা দিয়ে আমরা সুতা ও পোশাক উৎপাদন করতে পারি।  সেপা সই হলে, দুই দেশের মধ্যে যৌথ বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বাড়বে'- বলেন তিনি।

মাতলুব আহমাদ উল্লেখ করেন যে, সেপা সই হলে উভয় দেশ পরস্পরের উন্নয়নে একে-অপরের দক্ষতা ও সম্পদ কাজে লাগাতে পারবে। তাতে উভয় দেশই লাভবান হবে। এতে বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের অনেক সুযোগও সৃষ্টি হবে।

'যৌথ সমীক্ষার চূড়ান্ত খসরায় দুই দেশের মধ্যেকার আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধির যে সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে, আমি তার সাথে একমত পোষণ করি'। সেপার মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের বাধাগুলি দূর হলে বাণিজ্যের পরিমাণও অনেক বাড়বে বলেও আশা প্রকাশ করেন দেশের শীর্ষস্থানীয় এ ব্যবসায়ী নেতা।

এর আগে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেছিলেন, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, যোগাযোগ, লজিস্টিকস ও নানাবিধ নীতি সমন্বয় জড়িত থাকায়, সেপা চুক্তি সই উভয় দেশের জন্যই জয়ী হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।

তিনি বলেন, সেপার মাধ্যমে শুধু শুল্ক সমন্বয় বা কমানো নয়; 'ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলে আমরা কীভাবে বিনিয়োগ বাড়াতে পারি এবং ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের এদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগে আকর্ষণ করতে পারি—সেদিকে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে'।

'বিশেষ করে, আমাদের অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহে ভারতীয় বিনিয়োগ আনা গেলে এবং দেশটির বাজার ধরা গেলে আমরা শুল্কমুক্ত সুবিধা কাজে লাগিয়ে লাভবান হতে পারব,'যোগ করেন তিনি।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.