সুইস ব্যাংক কী? কীভাবে কাজ করে?

অর্থনীতি

টিবিএস ডেস্ক
14 August, 2022, 02:10 pm
Last modified: 14 August, 2022, 05:07 pm
১৮ শতকের শুরু থেকে ফরাসি ও অন্যান্য অভিজাত ইউরোপীয়দের অর্থসম্পদ জমা রাখার পছন্দের কেন্দ্রে পরিণত হয় জেনেভা। ১৭১৩ সালে সুইস সরকার গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ না করতে ব্যাংকগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আইন করে। আর সেখান থেকেই নীরবতা ও গোপনীয়তা রক্ষার এক শক্তিশালী সংস্কৃতির জন্ম যার ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে আজকের সুইস ব্যাংকিং।

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ব্যাংক ক্রেডিট সুইসের ৩০ হাজার অ্যাকাউন্টে থাকা ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থের তথ্য চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ফাঁস হয়। ধারণা করা হয়, বিশ্বের অন্যতম খ্যাতনামা এই বেসরকারি ব্যাংকে জমা অর্থের বেশিরভাগই বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী, প্রতারক ও ব্যবসায়ীদের কালো টাকা যাদের ওপর আন্তর্জাতিকভাবে রয়েছে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা। 

জার্মান সংবাদপত্র সুইডেশ জেইতুং-এর কাছে প্রাথমিকভাবে ফাঁসকৃত তথ্যগুলো পাঠানো হয়। সংবাদমাধ্যমটি পরবর্তীতে দ্য অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট এবং দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান ও লে মন্ডেসহ ৪৬টি সংবাদ প্রকাশনার সঙ্গে সেসব নথি শেয়ার করে।  

তদন্তে আবারও সুইস ব্যাংক ও তাদের গোপনীয়তা রক্ষা নিয়ে পুরোনো বিতর্কই সামনে আসে। দেশটির শতাব্দী পুরোনো গোপনীয়তা রক্ষার সংস্কৃতি বহুদিন ধরেই বিভিন্ন দেশের চাপের মুখে। সরকার দেশের ধনকুবেরদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত কর সংগ্রহের চেষ্টা করলেও সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এসব সুইস ব্যাংক।

১৮ শতকের শুরু থেকে ফরাসি ও অন্যান্য অভিজাত ইউরোপীয়দের অর্থসম্পদ জমা রাখার পছন্দের কেন্দ্রে পরিণত হয় জেনেভা। ১৭১৩ সালে সুইস সরকার গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ না করতে ব্যাংকগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আইন করে। আর সেখান থেকেই নীরবতা ও গোপনীয়তা রক্ষার এক শক্তিশালী সংস্কৃতির জন্ম যার ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে আজকের সুইস ব্যাংকিং।

১৯৩৪ সালে সুইজারল্যান্ড ব্যাংক ও সেভিংস ব্যাংকগুলো নিয়ে একটি ফেডারেল আইন জারি করে যা দ্য ব্যাংকিং ল অব ১৯৩৪ বা সুইস ব্যাংকিং অ্যাক্ট নামে পরিচিত। আইনটির সবচেয়ে বহুল চর্চিত আর্টিকেল ৪৭-এ গ্রাহকদের তথ্য যেকারো কাছে প্রকাশ করাকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কোনো অপরাধের অভিযোগ ছাড়া গ্রাহকদের অনুমতি ব্যতীত সরকারের কাছেও এসব তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর ব্যাংকিং গোপনীয়তা আইনগুলোর মধ্যে অন্যতম এই আর্টিকেল ৪৭।

আন্তর্জাতিক সীমারেখার বাইরে লেনদেন করা সহজ হয়ে উঠলে সুইস ব্যাংকগুলো বিশ্বের অতি ধনীদের কাছে নিরাপদে অর্থ রাখার আকর্ষণীয় ভোল্টে পরিণত হয়। এছাড়া সুইজারল্যান্ড  অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ দেশ হওয়ার পাশাপাশি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ায় ব্যাংকগুলো সহজেই গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে।

চলচ্চিত্রে এধরনের ব্যাংকগুলোর চিত্রায়নে দেখা যায় যে লম্বা টানেলের মধ্য দিয়ে ভূগর্ভস্থ ভল্টে যাওয়া যায় যেখানে ব্যাংক কর্মকর্তারা গ্রাহকদের গোপনীয়তা রক্ষার প্রশ্নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ নট এনাফ (১৯৯৯) থেকে জেমস বন্ডের একটি সংলাপ প্রায়ই শোনা যায়, সেটা হলো: 'আপনি যদি একজন সুইস ব্যাংকারকে বিশ্বাস করতে না পারেন, তাহলে পৃথিবী কোথায় পৌঁছাল?'

নিরাপদ ও সহজ ব্যাংকিং

সুইস ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো ডিপোজিটরদের কাছে আকর্ষণীয় হওয়ার মূল কারণ শুধু তাদের গোপনীয়তা রক্ষাই নয়, এখানকার ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ঝুঁকিও বেশ কম। সুইস অর্থনীতি ভীষণভাবে স্থিতিশীল। ব্যাংকগুলোও উচ্চ পেশাদারিত্ব বজায় রেখে কাজ করে থাকে।

সুইস ব্যাংকে বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে প্রাপ্তবয়স্ক যেকেউ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে। অ্যাকাউন্ট খোলা কঠিন কোনো কাজ নয়। পাসপোর্টের মতো পরিচয় নির্ণয়কারী প্রমাণপত্রের সঙ্গে ব্যাংকের সাধারণ যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমেই অ্যাকাউন্ট খোলা যায়। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে অর্থ ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। কী পরিমাণ অর্থ জমা রাখতে হবে তা বিভিন্ন ব্যাংকের নীতিমালা ও অ্যাকাউন্টের ধরনের ওপর নির্ভর করে।

আন্তর্জাতিক গ্রাহকদের পৃষ্ঠপোষকতা করা সুইস ব্যাংক ও সুইস অর্থনীতির জন্য সামগ্রিকভাবেই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুসারে, সুইজারল্যান্ডের ব্যবস্থাপনায় থাকা ৭.৯ ট্রিলিয়ন সুইস ফ্রাঙ্কের প্রায় অর্ধেকই বিদেশি গ্রাহকদের। সুইজারল্যান্ডের জিডিপির দশমাংশই আসে ব্যাংকিং শিল্প থেকে। দেশটির চাকরির বাজারেও ব্যাংকিং বেশ বড় জায়গা দখল করে রেখেছে। দেশটিতে ২৪০টির বেশি ব্যাংক রয়েছে। তবে মোট ব্যাংকিং সম্পদের প্রায় ৫০ শতাংশ ক্রেডিট সুইস ও ইউবিএস নিয়ন্ত্রণ করে বলে জানিয়েছে দ্য গার্ডিয়ান।

'কালো টাকা' সম্পর্কিত তথ্য প্রদান

সুইস ব্যাংকে ভারতীয়দের রাখা কালো টাকা ভারতের একটি বড় রাজনৈতিক ইস্যু। ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নেতারা প্রায়ই সুইস ব্যাংক থেকে অর্থ ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন। সুইস কর্তৃপক্ষ বলছে তারা কর ফাঁকি এবং জালিয়াতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারত সরকারকে সহযোগিতা করে আসছে।

২০১৮ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে কর সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য আদানপ্রদানের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু হয়, যার অধীনে সুইস আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে থাকা সমস্ত ভারতীয়দের তথ্য ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমবারের মতো ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া হয়।


  • সূত্র:ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.