ইউক্রেন থেকে গম আমদানির আলোচনা শুরু করবে বাংলাদেশ

অর্থনীতি

04 August, 2022, 12:05 am
Last modified: 04 August, 2022, 12:19 am
রাশিয়ার বকেয়া অর্থ পরিশোধ করে দেয়ায়- সেখান থেকেও গম আমদানির আশা সঞ্চার হয়েছে...

ইউক্রেনের খাদ্যশস্য রপ্তানি শুরু এবং রাশিয়া থেকে আমদানির বকেয়া অর্থ পরিশোধ করে দেয়ায়– দুটি দেশ থেকেই বাংলাদেশের জন্য গম ও অন্যান্য পণ্য আমদানির সুযোগ তৈরি হয়েছে। 

তবে রাশিয়ার ব্যাংকগুলি আন্তর্জাতিক লেনদেনের বহুল ব্যবহৃত মাধ্যম সুইফট থেকে বাদ পড়ায়–মস্কো থেকে আমদানির মূল্য পরিশোধের জটিলতা এখনও কাটেনি।  

কিন্তু, ইউক্রেন থেকে আমদানির ক্ষেত্রে এ ধরনের বিপত্তি না থাকায়– দেশটি থেকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে শস্য আমদানির সুযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও আমদানিকারকেরা।  

যুদ্ধের মধ্যেই ইউক্রেন থেকে শস্য রপ্তানি শুরু হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশের জন্য ভালো সুযোগ বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন। 

তিনি বলেন, 'আমরা যত দ্রুত সম্ভব ইউক্রেন থেকে আমদানির জন্য দেশটির সাথে প্রয়োজনীয় আলোচনা শুরু করব'।   

যুদ্ধ শুরুর পর, গত সোমবার প্রথমবারের মতো ভুট্টার চালান বোঝাই একটি জাহাজ ইউক্রেনের কৃষ্ণসাগরের বন্দর ছেড়ে যায়। এতে বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহের এ অন্যতম করিডর সচল হওয়ার আশা উজ্জ্বল হয়েছে। এখন বাংলাদেশের জন্যও দেশটি থেকে গমের চালান বুকিং দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হলো।  

ইউক্রেন ও রাশিয়া–উভয় দেশ বিশ্বের খাদ্যের ঝুড়ি বলে পরিচিত। যৌথভাবে দেশদুটি বাংলাদেশের গম আমদানির বৃহত্তম উৎস। এখন দুই সপ্তাহ পরীক্ষামূলকভাবে ইউক্রেন খাদ্য রপ্তানি করবে; এই প্রক্রিয়া বাধামুক্তভাবে সম্পন্ন হলে, কৃষ্ণসাগরের বন্দরে আটকে পড়া জাহাজগুলির বহর লাখ লাখ টন খাদ্যশস্য নিয়ে বিশ্বের নানান গন্তব্যের দিকে যাত্রা শুরু করবে।  

এর আগে গত ২২ জুলাই জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায়- রাশিয়া আর ইউক্রেনের মধ্যে একটি শস্য রপ্তানির চুক্তি সই হয়। বৈশ্বিক খাদ্য সংকট নিরসনে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। চুক্তিটি চূড়ান্ত হতে লেগেছে দুই মাস সময়, আর কার্যকর থাকবে ১২০ দিন।  

এদিকে, খাদ্য সচিব ইসমাইল হোসেন জানান, আইনি জটিলতার কারণে বাংলাদেশের কাছে রাশিয়ার পাওনা ১২ কোটি টাকার একটি আমদানি বিল সোমবার সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করেছে ঢাকা। এতে করে- রাশিয়া থেকে আগামী দিনে গম আমদানিতে আরেকধাপ অগ্রগতি হয়েছে বাংলাদেশের। 

তিনি বলেন, 'তাদের পেমেন্টটি ক্লিয়ার করে দেওয়ায়– এখন আমরা তাদের সঙ্গে দ্রুত নতুন চুক্তির বিষয়ে কথা বলব এবং সেক্ষেত্রে পেমেন্ট সিস্টেমটা কী হবে- সেটা নিয়ে আলোচনা করব'।

এ ছাড়াও বাংলাদেশ– বেলারুশ, কাজাখস্তান, সার্বিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও ভারতের সঙ্গে গম আমদানির চুক্তির চেষ্টা করছে বলে জানান খাদ্য সচিব।   

এদিকে রাশিয়াকে দেওয়া পেমেন্টের ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে, সোনালী ব্যাংকের প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকর্তা সুভাষ চন্দ্র দাস– এটি কোন মুদ্রায় পরিশোধিত হয়েছে তা নিশ্চিতভাবে জানাতে পারেননি। 

এর আগে গত জুনে বাংলাদেশের কাছে তিন লাখ টন গম রপ্তানির প্রস্তাব দিয়েছিল রাশিয়া। গত মাসে টিবিএস পরিদর্শনে এসে বাংলাদেশে রাশিয়ার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত একাতেরিনা এ সেমেনোভা জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে ২ লাখ টন রাশিয়ান শস্য আমদানির আলোচনা 'খুব শিগগিরই শেষ হতে চলেছে'। 

তবে রাশিয়ার এই দূত গম আমদানি প্রক্রিয়ায় কিছু টেকনিক্যাল সমস্যার কথা উল্লেখ করেন। এর মধ্যে রয়েছে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার পণ্য আমদানিতে স্থানীয় ব্যাংকগুলোতে এলসি (ঋণপত্র) খোলার মতো জটিলতা।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার রাশিয়ার সঙ্গে পেমেন্ট জটিলতা দূর করতে আলোচনা চলমান রয়েছে বলেও জানান। 

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর- রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে কোনো গমের চালান বাংলাদেশে আসেনি।

তার আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে, ইউক্রেন থেকে ২৩ লাখ টন গম আমদানি করে বাংলাদেশ; যা ছিল মোট আমদানির ১৭ শতাংশ। রাশিয়া থেকে আসতো প্রায় ২১ শতাংশ। এককভাবে ভারত থেকে এসেছে সবচেয়ে বেশি বা ২৪ শতাংশ। 

যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর একে একে গম আমদানির এই তিনটি উৎসই বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রভাবে দেশে খোলা ও প্যাকেটজাত আটা-ময়দা এবং এর থেকে তৈরি সব ধরনের পণ্যের দাম হু হু করে বেড়ে যায়।

ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর সবচেয়ে বেশি নির্ভরতা তৈরি হয়েছিল ভারতের উপর–কিন্তু গত ১৩ মে দেশটি গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিলে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়।

তবে সরকার থেকে সরকার (জিটুজি) ভিত্তিতে গম আমদানির সুযোগ খোলা রাখে ভারত। এর আওতায়, নিষেধাজ্ঞার পর গত জুনের শেষ নাগাদ দেড় লাখ টন গম বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন ভারতের খাদ্য সচিব। 

এখন বিশ্ববাজারে গমের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমে প্রায় যুদ্ধপূর্ব অবস্থায় ফিরছে– যার ফলে পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হচ্ছে। 

ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পর- ফেব্রুয়ারির শেষদিকে গমের একটি বহুল বিক্রিত ধরনের প্রতিবুশেল মূল্য ৭.৭০ ডলার থেকে একলাফে বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ ডলারে। এ তথ্য জানা গেছে, পণ্যটি লেনদেনের একটি বৈশ্বিক হাব- শিকাগো ফিউচার্স কনট্রাক্ট সূত্রে। 

মধ্য জুন পর্যন্ত এ মূল্য দুই অঙ্কের ঘরেই ছিল–কিন্তু তারপর থেকে কমতে থাকে। সোমবার প্রতিবুশেল ৮ ডলারের সামান্য কিছু বেশিতে কেনাবেচা হয়েছে।

এই বাস্তবতায় আমদানিকারকরা বলছেন, তাদের প্রধান প্রধান আমদানির উৎসগুলি বন্ধ থাকায় এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমতে থাকায়–বৈশ্বিকবভাবে মূল্য কমলেও, এ থেকে তারা লাভবান হতে পারবেন না।

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকার সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক দুটি কোম্পানির মাধ্যমে দুটি চালানে মোট ১ লাখ টন গম আমদানি করছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো আর্জেন্টিনা থেকে গম এনে বাংলাদেশকে দিবে। এভাবে কেনার কারণে বাংলাদেশকে চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে। যেখানে প্রতি বুশেল (২৫ কেজি) গম কিনতে খরচ হচ্ছে ১১.৯ ডলার।

কিন্তু, ইউক্রেন গম রপ্তানি শুরু করতে পারায়–তা বাংলাদেশের জন্য শুভসংবাদ বয়ে এনেছে। আমদানিকারকরা বলছেন, এতে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। 

টিকে গ্রুপের পরিচালক (ফাইন্যান্স অ্যান্ড অপারেশন্স) মো. শফিউল আতহার তসলিম টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের গম আমদানির উৎসগুলি আবার উন্মুক্ত হচ্ছে। আর কোনো সমস্যা যদি না হয়, তাহলে আমরা শিগগিরই ইউক্রেন থেকে গম আমদানির এলসি খুলতে পারব'।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম কমে যাওয়ার এই সুযোগ নেওয়ার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দ্রুত উদ্যোগ নেয়া দরকার। 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.